চুক্তি আর প্রেষণে আসা লোক দিয়ে চলছে বিটিভি by কাজী আলিম-উজ-জামান

রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারমাধ্যম বাংলাদেশ টেলিভিশনের (বিটিভি) শীর্ষস্থানীয় ১৫টি পদের মধ্যে পাঁচটিতে রয়েছেন চুক্তিভিত্তিক কর্মকর্তা। আর তিনটিতে আছেন প্রেষণে আসা কর্মকর্তা। এঁরা ক্ষমতাসীন দলের আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত।
প্রতিষ্ঠানটিতে বছরের পর বছর বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সিলেকশন গ্রেড ও পদায়ন আটকে আছে। এই অবস্থায় শীর্ষস্থানীয় পদগুলোতে বাইরে থেকে লোক আনায় চাকরিরতদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এতে প্রাত্যহিক কাজকর্মে স্থবিরতা এসেছে। অনেকের মতে, খবরও অনুষ্ঠানের মান দর্শকদের চাহিদা মেটাতে পারছে না।
জানতে চাইলে তথ্যসচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন প্রথম আলোকে বলেন, যোগ্য লোকের সংকটের কারণেই চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিতে হচ্ছে। যাঁরা বিটিভিতে আছেন, তাঁরা হয়তো পদোন্নতি পাওয়ার যোগ্যতায় আসছেন না। আর বিটিভিতে অনেক দিন সরাসরি নিয়োগ নেই। তাই স্থলাভিষিক্ত করার সমস্যা রয়ে গেছে।
বর্তমানে সরকারি এই প্রতিষ্ঠানে আটটি বিভাগে প্রায় দেড় হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্মরত আছেন। বিটিভির সর্বোচ্চ পদ মহাপরিচালক (ডিজি)। এ ছাড়া উপমহাপরিচালকের (ডিডিজি) পদ দুটি, উপমহাপরিচালক (বার্তা ও অনুষ্ঠান) আর পরিচালকের পদ রয়েছে আটটি। মহাব্যবস্থাপকের (জিএম) পদ দুটি। এ ছাড়া প্রধান প্রকৌশলী ও অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীর দুটি পদ রয়েছে।
এর মধ্যে প্রধান পাঁচটি পদ দখল করে আছেন তিনজন। তাঁরা সবাই চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত। মহাপরিচালক পদে আবু জাফর সিদ্দিকীর (সমপ্রতি প্রয়াত) মেয়াদ শেষ হলে ওই পদে গত ৮ মার্চ ম. হামিদকে এক বছরের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়। এর আগে তিনি এফডিসির মহাপরিচালক ছিলেন। ম. হামিদ ক্ষমতাসীন দলের আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত। ২০০১ সালে চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ম. হামিদকে বিটিভির পরিচালক (অনুষ্ঠান ও পরিকল্পনা) পদ থেকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়েছিল।
উপমহাপরিচালক (বার্তা) হিসেবে চুক্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে এম. মনোয়ারুল ইসলামকে। একই সঙ্গে তিনি উপমহাপরিচালকের (অনুষ্ঠান) অতিরিক্ত দায়িত্বেও আছেন। প্রতিষ্ঠানটির নথিপত্রে দেখা যায়, মনোয়ারুল ইসলাম পরিচালক (বিপণন) হিসেবে অবসরে গিয়েছিলেন। গত আগস্টে চুক্তিতে তাঁকে বার্তা ও অনুষ্ঠান বিভাগের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই দুই বিভাগে তিনি কোনো সময় সক্রিয়ভাবে কাজ করেননি বলে বিটিভির সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে।
এ অবস্থায় মুখ্য বার্তা সম্পাদকের পদটি ফাঁকা রয়েছে। তিন বার্তা সম্পাদকের মধ্যে ইকবাল হোসেনকে পিআইডি এবং গোপাল চন্দ্র দেবকে বাংলাদেশ বেতার থেকে প্রেষণে আনা হয়েছে।
পরিচালক (বার্তা ও আন্তর্জাতিক) হিসেবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বাহার উদ্দিনকে। তিনি বিটিভির বাইরের লোক। লন্ডনে একটি বাংলা টিভি চ্যানেলে চাকরি করতেন। তিনি আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও স্পিকার আবদুল মালেক উকিলের ছেলে।
বাহার উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁকে লন্ডন থেকে ডেকে এনে বিটিভিতে নিয়োগ দিয়েছেন। তাঁর দুই বছরের চুক্তির এক বছর অবশিষ্ট আছে। লন্ডন ও ভারতের পুনেতে তিনি গণমাধ্যম ও চলচ্চিত্রের ওপর পড়াশোনা করেছেন বলে জানান।
পরিচালক প্রশাসন, বিপণন বা সেলস ও অর্থ—এই তিন পদে মন্ত্রণালয় থেকে তিনজনকে প্রেষণে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এঁরা হলেন যথাক্রমে আনিস আহমেদ, মো. জাকির হোসাইন ও আহসান হাবিব।
এরপরের পদগুলোও প্রেষণে আসা কর্মকর্তা দিয়ে পূরণ করা হয়েছে। অনুষ্ঠানসহ অন্যান্য বিভাগের চিত্রও অনেকটা এ রকম বলে সূত্রগুলো জানিয়েছে।
সরল স্বীকারোক্তি: বিটিভিকে একসময় ডাকা হতো ‘সাহেব বিবি গোলামের বাক্স’। এরশাদের ক্ষমতাচ্যুতির পর বিটিভি তার দর্শকদের কাছে ‘বিবি গোলামের বাক্স’ হিসেবে পরিচিতি পায়। দেশে অনেক কিছুতেই বিভিন্ন ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু শত সমালোচনাও বিটিভিতে বদলাতে পারেনি। খবর ও অনুষ্ঠানের মান বাড়ানোর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। তবে সমপ্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে কিছু কারিগরি পদক্ষেপ নেওয়ায় বিটিভির ছবি অনেকটা স্পষ্ট হয়েছে। একাধিক নতুন স্টুডিও নির্মাণ সত্ত্বেও প্রকৌশলীদের ‘অদক্ষতার’ কারণে সেগুলো পুরোপুরি ব্যবহার করা যাচ্ছে না বলেও সূত্র দাবি করেছে।
দেশে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলো যখন ভালো খবর ও অনুষ্ঠান নির্মাণের চেষ্টা করছে, তখন সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা থাকার পরেও পিছিয়ে পড়ছে বিটিভি। খবরের ক্ষেত্রে চিরাচরিত ধারা থেকে বের হওয়ার কোনো চেষ্টা একেবারেই দৃশ্যমান নয়।
পরিচালক (বার্তা ও অনুষ্ঠান) বাহার উদ্দিন নিজেই স্বীকার করলেন, ‘সবাই নয়টা-পাঁচটা চাকরি করে। অনুষ্ঠানের গুণগত মান নিয়ে কেউ চিন্তিত নয়। সবাই ব্যস্ত প্রোগ্রামে কী যন্ত্র ব্যবহূত হবে, কীভাবে প্রোগ্রামটা ডিজিটাল হবে, তা নিয়ে।’ বিটিভিকে লুটপাটের আখড়া আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, একই অনুষ্ঠান বারবার দেখিয়ে টাকা লুটপাট করা হচ্ছে।
৬ নভেম্বর থেকে বিটিভি ২৪ ঘণ্টা অনুষ্ঠান সমপ্রচার করছে, এ তথ্য জানিয়ে এম মনোয়ারুল ইসলাম বললেন, ‘অনুষ্ঠানের মান বাড়াতে সবদিকে চেষ্টা চলছে।’
আর মহাপরিচালক ম. হামিদ বললেন, ‘আমি সব সময় একটা লক্ষ্য নিয়ে কাজ করি। এখনো সেই লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি।’
পদায়ন নিয়ে ক্ষোভ: বিটিভির দায়িত্বশীল সূত্রগুলো জানায়, পদায়ন না হওয়ায় অনেক কর্মকর্তাই ১৭/১৮ বছর ধরে একই পদে আছেন। রাজনৈতিক বিবেচনায় অনেকের পদায়ন আটকে রাখা হয়েছে, এমন অভিযোগও রয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন নির্বাহী প্রযোজক বলেন, অন্যায়ভাবে তাঁর পদায়ন আটকে রাখা হয়েছে। এখন মনে হতাশা ভর করেছে।
অভিযোগের জবাবে ম. হামিদ বলেন, ‘আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠকের পর পদায়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেই সিদ্ধান্ত অনুসারে আমরা কিছু পদায়ন করেছি। কিছু প্রক্রিয়া চলছে।’ তিনি বলেন, অনেকের অনেক ধরনের সমস্যা থাকে। সেগুলোর সব বলা যায় না। রাজনৈতিক বিবেচনাই কারও কারও পদায়ন আটকে থাকার একমাত্র কারণ নয়।
১৬৪ পদ নিয়ে জটিলতা: বিটিভিতে ১৯৯০ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত নিয়োগপ্রাপ্ত ১৬৪টি প্রথম শ্রেণীর পদ (নন-ক্যাডার) নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে। এই পদগুলোকে স্থায়ী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হলেও অর্থ ও সংস্থাপন মন্ত্রণালয় এগুলোকে অস্থায়ী পদ হিসেবে আখ্যা দেয়। সেই থেকে এই কর্মকর্তাদের পদায়ন আটকে আছে। এই কর্মকর্তারা তাঁদের পদগুলোকে স্থায়ী করে পদোন্নতির দাবি জানিয়ে আসছেন।
এ ব্যাপারে ম. হামিদ বলেন, ‘আমরা এটা নিয়ে কাজ করছি। এই কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিয়ে নিচের পদগুলো খালি করে তাতে নতুন লোক নিয়োগ দেওয়ার চেষ্টা করছি।’
বিশেষজ্ঞ মতামত: যোগাযোগ করা হলে বিটিভির উপমহাপরিচালক (বার্তা) হিসেবে অবসর নেওয়া গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞ ফারুক আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় প্রায়ই এসব কর্মকর্তাকে অপেশাদার মনে হয়েছে। প্রতিষ্ঠানের প্রতি তাঁদের দায়বদ্ধতা থাকে না বললেই চলে।
বিটিভি পরিচালনার জন্য সাংসদ ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি নীতিমালা তৈরি করা জরুরি বলে মনে করেন ফারুক আলমগীর। নীতিমালার আলোকে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালিত হলে এর অনুষ্ঠানের মানের উন্নতি হতে পারে বলে মত দেন তিনি।
প্রসঙ্গত, ২০০৭ সালের আগস্টে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ‘বাংলাদেশ টেলিভিশন অথরিটি অ্যাক্ট, ২০০১’-এর প্রয়োজনীয় সংশোধনী ও নতুন প্রবিধান যোগ করার উদ্যোগ নিয়েছিল। টেলিভিশনকে একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালিত করতে তথ্য মন্ত্রণালয়কে আইনটি পর্যালোচনা করার নির্দেশও দেওয়া হয়েছিল। পরে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর এ উদ্যোগকে আর কার্যকরভাবে এগিয়ে নেওয়া হয়নি।

No comments

Powered by Blogger.