সাঈদীর পক্ষে আইনি যুক্তি উপস্থাপন শেষ, তথ্যগত যুক্তি উপস্থাপন অব্যাহত

মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর পক্ষে একাদশতম দিনের মতো যুক্তিতর্ক (আর্গুমেন্ট) উপস্থাপন করেছেন তার আইনজীবীরা।
সোমবার সাঈদীর প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক আইনি যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ করেন। এরপর সাঈদীর পক্ষে তার অপর আইনজীবী অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম মামলার তথ্যগত যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন। এর আগেও তিনি সাত কার্যদিবস তথ্যগত যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন।

সাঈদীর বিরুদ্ধে ১৯টি অভিযোগের মধ্যে আসামিপক্ষ এ পর্যন্ত সাতটি ঘটনার তথ্যগত যুক্তিতর্ক উপস্থাপন সম্পন্ন করেছেন। মঙ্গলবারও তথ্যগত যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের দিন ধার্য রেখেছেন চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল।

আইনি যুক্তি উপস্থাপন শেষে ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘সাঈদীর পক্ষে আইনগত বিষয়ে আইনগত যুক্তি উপস্থাপন করেছি। ট্রাইব্যুনালের কাছে যুক্তি উপস্থাপন করে তার বিরুদ্ধে আনা ১৯টি অভিযোগ থেকে অব্যাহতি চেয়েছি।’’

তিনি বলেন, ‘‘শহীদ ফয়জুর রহমানের স্ত্রী আয়েশা ফয়েজ কোথায়?  তার ছেলে-মেয়েরা কোথায়?  তার ছেলে-মেয়েরা কেন তার বাবার হত্যার বিষয়ে সাঈদী সাহেবের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে এলেন না?’’

তিনি বলেন, ‘‘শহীদ ফয়জুর রহমানের স্ত্রী আয়েশা ফয়েজ জীবিত রয়েছেন। তিনি স্বামী হত্যার বিষয়ে বই লিখেছেন। তিনি এ মামলায় সবচেয়ে ভালো সাক্ষী হতে পারতেন। কিন্তু তিনি কেন এলেন না? তার ছেলে-মেয়েরা, মেয়ের জামাই যারা জীবিত রয়েছেন, তারাও কেন সাক্ষী দিতে এলেন না?’

ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘‘তার (ফয়জুর রহমানের) জীবিত ছেলে-মেয়েদের মধ্যে একজন হলেন ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল। তার তো ছুটে আসার কথা ছিল। আয়েশা ফয়েজের মেয়ের জামাই অ্যাডভোকেট আলী হায়দার খান এ ট্রাইব্যুনাল থেকে মাত্র দুশ’ গজ দূরে হাইকোর্টে প্রাকটিস করেন। তিনিও আসেননি তার  শ্বশুরের হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে সাক্ষ্য দিতে।’’

ব্যারিস্টার রাজ্জাক বলেন, ‘‘বসনিয়াসহ পৃথিবীর যেখানেই এ ধরনের যুদ্ধাপরাধের বিচার হয়েছে, সেখানেই আমরা জানি ভুক্তভোগীর পরিবারের সদস্যরা, আত্মীয়-স্বজনরা আদালতের সামনে লাইন দিয়ে ভিড় করেছেন সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য। কিন্তু আমরা শহীদ ফয়জুর রহমানের স্ত্রী, ছেলে-মেয়েদের কাউকে এখানে সাক্ষী হিসেবে দেখলাম না। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, সাঈদীর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তা মিথ্যা, সাজানো ও ষড়যন্ত্রমূলক।’’

তিনি বলেন, ‘‘সাঈদী সাহেবের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আনীত ১৯টি অভিযোগের সবগুলোই বাতিল হওয়া উচিত, সবগুলো অভিযোগেই তাকে নির্দোষ ঘোষণা দেওয়া উচিত। তিনি যে নির্দোষ, সে মর্মে আমরা প্রমাণ দিতে পেরেছি।’’

ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘‘ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয়। পৃথিবীর প্রথম রাজনৈতিক হত্যার শিকার হয়েছেন জুলিয়াস সিজার। খৃস্টপূর্ব ৪৪ সালে সেটি হয়েছে। তার ১৬০০ বছর পর এ নিয়ে নাটক লিখেছেন শেক্সপিয়ার। আজ এখানে যা হচ্ছে তা নিয়েও একদিন হয়তো কেউ নাটক লিখবেন। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হবে।’’

রাজ্জাক আরো বলেন, ‘‘রাষ্ট্রপক্ষ যেসব অভিযোগ এনেছে, তাতে সাঈদী সাহেবের কোনো শাস্তি হতে পারে না। আমরা আশা করছি, তিনি এ মামলা থেকে নির্দোষ হিসেবে মুক্তি পাবেন।’’

এর আগে ট্রাইব্যুনালে যুক্তি উপস্থাপনের শেষ পর্যায়ে ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘‘সাঈদীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আনীত ষড়যন্ত্র এমনই এক ষড়যন্ত্র যে, পাহাড় টলে যাবার মতো। তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তার একটির সঙ্গে সাঈদীর কোনো সম্পর্ক নেই।’’

‘‘সাঈদীর বিরুদ্ধে একমাত্র অভিযোগ, তিনি একজন জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ, তিনি কোরআনের তফসির করেন। তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তার একটিতেও তার একদিনও শাস্তি হওয়া উচিত নয়।’’

অন্যদিকে ব্যারিস্টার রাজ্জাকের এসব কথার জবাবে প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী বলেন, ‘‘তিনি যে নাটকের কথা বলেছেন, তা বলা মোটেও ঠিক হয়নি। এখানে কোনো নাটক হয়নি। আমরা কোনো নাটক করিনি।’’

তিনি বলেন, ‘‘আসামিপক্ষের সাক্ষীদের দেওয়া সাক্ষ্যের বৈপরীত্য ও গ্রহণযোগ্যতার বিষয়ে আমরা এর আগে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেছি। ১৯টি অভিযোগের বিষয়ে আমরা আমাদের দালিলিক প্রমাণ উপস্থাপন করেছি। আসামিপক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষে আবার আমাদের যুক্তি উপস্থাপন করবো। তারপর ট্রাইব্যুনাল এ মামলার রায় দেবেন।’’

তিনি বলেন, ‘‘সাঈদীর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত, সাক্ষ্যপ্রমাণ ও আইনি উপাদান পেশ করা হয়েছে। আমরা যে ডকুমেন্ট উপস্থাপন করেছি, তাতে নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।’’

তিনি বলেন, ‘‘১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা, চার লাখ মা-বোনকে নির্যাতন করাসহ অসংখ্য বাড়ি-ঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। প্রায় এক কোটি মানুষকে দেশ ত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। সারা বাংলাদেশের মতো এসব ঘটনা পিরোজপুরেও ঘটেছে।’’

সৈয়দ হায়দার আলী বলেন, ‘‘একাত্তর সালে পিরোজপুরে সংঘটিত এ সব ঘটনার সঙ্গে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর সম্পৃক্ততা আছে। এর স্বপক্ষে পর্যাপ্ত পরিমাণ সাক্ষ্য ও দালিলিক প্রমাণ দাখিল করা হয়েছে এবং এর পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে তার সর্বোচ্চ শাস্তি কামনা করেছি ট্রাইব্যুনালের কাছে।’’

গত ১৮ নভেম্বর থেকে সাঈদীর পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করছেন তার আইনজীবীরা। এর আগে সাঈদীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষে প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী গত ১৫ নভেম্বর যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ করেন। তিনি গত ৫ নভেম্বর থেকে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরু করে ৯ কার্যদিবসে শেষ করেন।

প্রসঙ্গত, মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় অভিযুক্ত ও আটককৃতদের মধ্যে একমাত্র দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের সাক্ষী ও তদন্ত কর্মকর্তাসহ সবার সাক্ষ্যগ্রহণ এবং জেরা শেষ হয়েছে। মামলাটির চূড়ান্ত নিষ্পত্তির জন্য যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ হলে মামলাটির রায়ের দিন ধার্য হবে।

ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে একটি মামলায় সাঈদীকে ২০১০ সালের ২৯ জুন গ্রেফতার করা হয়। ওই বছরের ২ আগস্ট তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। গত বছরের ১১ জুলাই সাঈদীর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করেন রাষ্ট্রপক্ষ। ১৪ জুলাই তার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল। অভিযোগের বিষয়ে শুনানি শেষে ৩ অক্টোবর সাঈদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে এই মামলার আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়।

সাঈদীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধকালে সময়ে পিরোজপুর জেলায় হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ এবং এ ধরনের অপরাধে সাহায্য করা ও জড়িত থাকার ঘটনায় ২০টি অভিযোগ আনা হয়।

এ মামলায় সাঈদীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয় গত বছরের ৭ ডিসেম্বর। মূল সাক্ষী ১৮ জন, সিজারলিস্টের ৯ জন ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) হেলাল উদ্দিনসহ মোট ২৮ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন। তাদের মধ্যে ২০ জন ঘটনার এবং সাতজন জব্দ তালিকার সাক্ষী। এছাড়াও প্রসিকিউশনের আবেদনের প্রেক্ষিতে তদন্ত কর্মকর্তার কাছে দেওয়া ১৫ সাক্ষীর জবানবন্দি ট্রাইব্যুনালের আদেশে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়।

২ সেপ্টেম্বর থেকে সাঈদীর পক্ষের সাক্ষীদের সাফাই সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। আসামিপক্ষে ১৭ জনের সাফাই সাক্ষ্যগ্রহণ ২৩ অক্টোবর শেষ হয়।

No comments

Powered by Blogger.