ভুলে ভরা অর্পিত সম্পত্তির গেজেট-দেশজুড়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা by আশরাফুল হক রাজীব

অর্পিত সম্পত্তির প্রকাশিত গেজেটগুলো ভুলে ভরা। একজনের সম্পত্তি অন্যজনের নামে দেখানো হয়েছে। দাগ নম্বর ঠিক নেই। ব্যক্তির দখলে থাকা সম্পত্তি সরকারের দখলভুক্ত দেখানো হয়েছে। অর্পিত সম্পত্তির তালিকা চূড়ান্ত করতে গিয়ে নতুন করে এসব ভুল করা হয়েছে।


ফলে আগে থেকে যারা অর্পিত সম্পত্তির ভুক্তভোগী, তাদের মিছিলে যোগ হয়েছে নতুন ভুক্তভোগীর নাম।
ভুলে ভরা অর্পিত সম্পত্তির গেজেট জেলায় জেলায় যাওয়ার পর দেশজুড়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হয়েছে। অর্পিত সম্পত্তি ফিরে পাওয়ার আবেদনে জমির মালিকানা সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র জমা দিতে হয়। ভূমি অফিস থেকে এসব কাগজপত্র পেতে সাধারণ মানুষকে হয়রানি পোহাতে হচ্ছে। ভূমি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।
লালমনিরহাট জেলার অর্পিত সম্পত্তির 'ক' তফসিলের তালিকা প্রকাশ হয় গত ১৭ মে। এ তালিকা জেলায় যাওয়ার পর বিভিন্ন ধরনের ভুল বের হয়ে আসে। এক দাগের জমি অন্য দাগে দেখানো হয়েছে। জমির মালিকের নাম ভুল করা হয়েছে। এমনকি দীর্ঘদিন ধরে অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকার পরও তা তালিকায় দেখানো হয়নি। লালমনিরহাট জেলার অর্পিত সম্পত্তির গেজেট সংশোধন করার জন্য ভূমি মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আবু তাহের মো. মাসুদ রানা। জেলা থেকে পাঠানো গেজেটের ভুলের বিবরণী থেকে জানা যায়, সদর উপজেলার খতিয়ান নম্বর ৩৮৩, এসএ দাগ নম্বর ৯৪০-এর ০.৫৩ একর জমি অর্পিত তালিকাভুক্ত হলেও রহস্যজনক কারণে তা গেজেটে প্রকাশ করা হয়নি। জেলা থেকে কালীদাস মৈত্রের এ জমি অর্পিত সম্পত্তির তালিকায় উল্লেখ করে গেজেটের সংশোধনী প্রকাশ করার অনুরোধ করা হয়েছে। এ ছাড়া জেলার অর্পিত সম্পত্তির 'ক' তালিকায় কয়েকটি দাগ নম্বর ভুল করা হয়েছে। দাগ নম্বর ৬৩৬-এর স্থলে ৬৩৮ হবে। দাগ নম্বর ৫৪৩-এর স্থলে ৫৯৩ এবং দাগ নম্বর ৫৭৬-এর স্থলে ৫২৬ হবে। এ ছাড়া কুসুম কুমারীর জমি কস্তুরী কুমারীর নামে দেখনো হয়েছে। গেজেটে নির্মালা সুন্দরীর জমি নিষ্ফলা সুন্দরীর নামে উঠেছে। তাঁর স্বামীর নামও ভুল করা হয়েছে।
'অর্পিত সম্পত্তি আইন প্রতিরোধ আন্দোলন'-এর সাধারণ সম্পাদক সুব্রত চৌধুরী বলেন, এ ভুল শুধু লালমনিরহাটে নয়, সারা বাংলাদেশে করা হয়েছে। এসব ভুলের একটা বড় অংশ ইচ্ছাকৃত। মানুষকে হয়রানি করার জন্য এটা করা হচ্ছে। আমরা সারা দেশে অর্পিত সম্পত্তির বিষয়ে সেমিনার করে সংশ্লিষ্টদের সচেতন করছি। এরই মধ্যে বিভিন্ন বিভাগীয় শহর ছাড়াও কয়েকটি জেলা শহরে সেমিনার হয়েছে। সেসব সেমিনারে যোগ দিয়ে জেনেছি, কিভাবে তাদের হয়রানি করা হচ্ছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় একজনের সম্পত্তি অর্পিত সম্পত্তির তালিকায় দেখানো হয়েছে। অথচ ১৯৭৩ সালে উচ্চ আদালত রায় দিয়েছে ওই জমি অর্পিত সম্পত্তি নয়। এই মামলার পরিপ্রেক্ষিতেই আদালত বলেছিল, ১৯৭৩ সালের পর আর কোনো জমিকে নতুন করে অর্পিত সম্পত্তির তালিকায় আন্তর্ভুক্ত করা যাবে না। ঐতিহাসিকভাবে যে জমি বিখ্যাত সেই জমিকেই পুনরায় অর্পিতের তালিকায় দেখানো হয়েছে। কক্সবাজার, ফরিদপুর, সিলেটসহ সব জেলায় একই অবস্থা।
এ ধরনের ভুল থাকার কথা স্বীকার করে ভূমি প্রতিমন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'অর্পিত সম্পত্তির গেজেটে নানা ধরনের ভুল হয়েছে। এটা অস্বীকার করার কোনো কারণ নেই। এমনকি আমার নির্বাচনী এলাকা দিনাজপুরের ফুলবাড়িতে যে জমি কখনো অর্পিত হিসেবে সরকারের নিয়ন্ত্রণে ছিল না, সেই জমিকে অর্পিত হিসেবে দেখানো হয়েছে। অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন অনুযায়ী অর্পিত সম্পত্তিকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। 'ক' অংশ হচ্ছে যেসব অর্পিত সম্পত্তি সরকারের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে সেগুলো। আর 'খ' অংশ হচ্ছে যে অর্পিত সম্পত্তি সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই। ফুলবাড়ির সেই জমিটি 'ক' তালিকায় দেখানো হয়েছে।' তিনি বলেন, যাই হোক, এই অবস্থা থেকে বের হয়ে আসার জন্য সরকার নতুন করে গেজেট সংশোধন করছে। তাতে একটু সময় লাগলেও কাজটি যেন নিখুঁত হয় সেই চেষ্টা হচ্ছে। অর্পিত সম্পত্তি অবমুক্ত করার জন্য আবেদনের সময়সীমা বাড়ছে। পরবর্তীতে সময় বাড়ানোর জটিলতা দেখা দিলে ফের যেন সংসদে যেতে না হয়, সে কারণে সরকারকে নির্বাহী অধিকার দেওয়া হচ্ছে। সংশোধনীটি এরই মধ্যে মন্ত্রিসভায় অনুমোদন হয়েছে। শিগগিরই অর্ডিন্যান্স জারি হবে।
ভূমি মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, অর্পিত সম্পত্তির 'ক' তালিকা সারা দেশে পাঠানো হয়েছে। সব জেলা থেকে এ তালিকা সম্পর্কে আপত্তি এসেছে। তারা এরই মধ্যে সংশোধনী পাঠিয়েছেন। তাঁদের পাঠানো সংশোধনী ধরে অর্পিত সম্পত্তির গেজেট ঠিক করা হচ্ছে। 'খ' তালিকায় ভুলের পরিমাণ বেশি। এসব ভুল ইচ্ছাকৃত বলা হলেও আসলে ইচ্ছাকৃত নয় বলে তিনি দাবি করেন। অর্পিত সম্পত্তির তালিকা কয়েক কোটি পৃষ্ঠা। এ বিশাল তালিকা তৈরি, বাছাই, কম্পোজ, মুদ্রণের কোনো একপর্যায়ে ভুল হতেই পারে। তবে নতুন করে অর্পিত সম্পত্তির তালিকায় যেসব সম্পত্তি অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে, তা নিয়ে সন্দেহ করার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। তিনি আরো বলেন, এখন মূল সমস্যা হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের একটি বড় অংশ আইনটি সম্পর্কে জানে না। আইনটিতে বলা হয়েছে, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অর্পিত সম্পত্তি অবমুক্তির আবেদন না করলে তা খাস জমি হয়ে যাবে। না জানার কারণে তারা আবেদন করতে পারছে না। আবার গেজেট, দলিলপত্র, নকশা, পরচাসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ করে আবেদন করার আগেই নির্ধারিত সময়সীমা পার হয়ে যাচ্ছে। যা গভীর উদ্বেগের বিষয়।
বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাণা দাশগুপ্ত কালের কণ্ঠকে বলেন, 'জেলা ও মাঠপর্যায় থেকে আমাদের কাছে যে খবর আসছে, তাতে এটা স্পষ্ট যে আইনে নির্ধারণ করে দেওয়া সময়ের মধ্যে সরকার অনেক কাজ শেষ করতে পারেনি। গেজেট প্রকাশ করা হলেও ভুক্তভোগী, আইনজীবী ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা জেলা প্রশাসক অফিস, বিজি প্রেসের বিক্রয় কেন্দ্রসহ যেখানে গেজেট থাকার কথা সেখানে গেজেট পাননি। এর ফলে বিচারপ্রার্থীরা আইনে বর্ণিত নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ট্রাইব্যুনাল বা কমিটির কাছে আবেদন জমা দিতে পারেনি। এর নেপথ্যে রয়েছে কর্মকর্তাদের অদক্ষতা ও অসততা। ক্ষতিগ্রস্ত অসহায় পরিবার যেন তাদের ন্যায্য পাওনা-সম্পত্তি ফেরত না পায়, সেজন্য একটি দুষ্টচক্র এখনো সক্রিয়।
অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন বাস্তবায়নে জাতীয় নাগরিক সমন্বয় সেলভুক্ত সংগঠন 'নিজেরা করি'র গৌরঙ্গ চন্দ্র ঘোষ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমাদের কাছে প্রতিদিনই ক্ষতিগ্রস্তরা আসছে। মূল যে সমস্যা তাহলো এখনো গেজেট পাওয়া যাচ্ছে না। আর গেজেট পাওয়া না গেলে আবেদন করতে হবে কি না, তা জানা যাচ্ছে না। আবার গেজেট পাওয়া গেলেও আবেদন করার জন্য সিএস, আরএস, এসএ, বিএস খতিয়ান এবং অন্যান্য প্রমাণ সংগ্রহ করতে হচ্ছে। এসব সংগ্রহের ক্ষেত্রে মানুষকে ভূমি অফিসগুলোতে হয়রানি করা হচ্ছে। অনেক স্থানে এসব খতিয়ান, সনদ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পেতে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের কাছ থেকে ঘুষ নেওয়া হচ্ছে। কোথাও কোথাও তা পাঁচ থেকে ১০ হাজারে পৌঁছে গেছে।
সময় কত বাড়ল?
সর্বশেষ গত ৬ আগস্ট মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত প্রস্তাবিত সংশোধনী অনুযায়ী, 'ক' এবং 'খ' উভয় তফসিলভুক্ত সম্পত্তির জন্য গেজেট প্রকাশের ৩০০ দিনের মধ্যে আবেদন করা যাবে। আর নিষ্পত্তির জন্য জেলা কমিটি ও ট্রাইব্যুনাল উভয়ই সময় পাবে ৩০০ দিন। এর আগে গত জুন মাসে এ আইন সংশোধন করে আবেদনের সময় ৯০ দিন থেকে বাড়িয়ে ১২০ দিন করা হয়েছিল। তখন 'খ' তফসিলের গেজেট প্রকাশের সময়ও ১৫০ দিন থেকে বাড়িয়ে ৩০০ দিন করা হয়েছিল।
এ সরকারের আমলে পুরোপুরি নিষ্পত্তি হচ্ছে না!
কয়েকবার সময় বাড়ানোর ফলে কার্যত আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে অর্পিত সম্পত্তি জটিলতার পুরোপুরি নিষ্পত্তি হচ্ছে না। কারণ অর্পিত সম্পত্তি অবমুক্ত ও নিষ্পত্তি করার জন্য সময় বাড়ানোয় সব মিলিয়ে কম-বেশি ৬০০ দিন সময় প্রয়োজন। অনেক জেলায় গেজেট এখনো প্রকাশ হয়নি। অথচ বর্তমান সরকারের হাতে সময় আছে ৪৮৫ দিন। এ বিষয়ে ভূমি প্রতিমন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বিষয়টি বর্তমান সরকারের আমলেই শেষ করতে হবে- এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। পরের সরকার এ বিষয়ে কাজ করবে। আর বিষয়গুলো নিষ্পত্তির জন্য যখন ট্রাইব্যুনালে যাবে, তখন সরকার ইচ্ছা করলেই কিছু করতে পারবে না। তখন নিয়মের বাইরে যাওয়া যায় না।
মোস্তাফিজুর রহমান আরো বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার আসামিরা জেলে বন্দি ছিল বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের সময়। বিএনপি সরকার কি পেরেছিল তাঁদেরকে জেল থেকে ছেড়ে দিতে? পারেনি। আদালতে চলে গেলে আইনের নিয়মেই চলতে হয়। সরকারিভাবে গেজেট প্রকাশ ও স্থানীয় পর্যায়ে গেজেট পৌঁছাতে বিলম্ব এবং আবেদনের জন্য নথিপত্র সংগ্রহে বাড়তি সময় লাগার কারণেই আবেদনের সময় বাড়ানোর এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন ভূমি প্রতিমন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান।
ভূমি সচিব মোখলেসুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, আবেদনের সময় ৩০০ দিন করা হলেও এর মধ্যে ১৫০ দিন পার হয়ে গেছে (কোনো কোনো জেলায়)। অর্পিত সম্পত্তির সব বিষয় নিষ্পত্তি করা না গেলেও বেশির ভাগ নিষ্পত্তি বর্তমান সরকারের সময়েই হবে।
ভূমি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, নিষ্পত্তির সময় বাড়ানোর প্রয়োজন হলে আর আইন পরিবর্তন করতে হবে না। যে অধ্যাদেশ জারি হচ্ছে, সেখানে সময় বাড়ানোর ক্ষমতা মন্ত্রণালয়ের হাতে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত রয়েছে। আইন মন্ত্রণালয় থেকে রাষ্ট্রপতির কাছে অনুমোদনের জন্য পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে। সংসদ না থাকায় অধ্যাদেশ জারি হচ্ছে।
১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের পর 'ডিফেন্স অব পাকিস্তান রুলস, ১৯৬৫' অনুসারে ওই বছরের ৯ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৬৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত যেসব নাগরিক পাকিস্তান ত্যাগ করে ভারতে চলে যায়, তাদের রেখে যাওয়া সম্পত্তি 'শত্রু সম্পত্তি' হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়। স্বাধীন বাংলাদেশে শত্রু সম্পত্তির নাম 'অর্পিত সম্পত্তি' রাখা হয়। সেসব সম্পত্তি বৈধ উত্তরাধিকারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য ২০০১ সালে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন করা হয়। পরে ক্ষমতায় এসে তা অকার্যকর করে দেয় বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার। মহাজোট সরকার নতুন করে আইনটি কার্যকর করার উদ্যোগ নেয়।

No comments

Powered by Blogger.