প্রতিক্রিয়া- ‘বাস্তবতা ও নাগরিক ঐক্য’ by মাহমুদুর রহমান মান্না

গত ২২ মে ‘নাগরিক ঐক্য’ কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকের পর থেকে একটা আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। ওই দিন কেন্দ্রীয় কমিটির সভা ছিল মধ্যাহ্নভোজের বিরতির পর, আর সকালে ছিল আলোচনা সভা। সেখানে অতিথি বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন হাফিজউদ্দিন খান, আসিফ নজরুল প্রমুখ।


পাঠক, উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি যে এই দুজন নাগরিক ঐক্যের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য না হলেও ঐক্যের সঙ্গে তাঁদের চিন্তার অনেক মিল আছে। নাগরিক ঐক্য সিভিল সোসাইটি বা নাগরিক আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের সহযোগী মনে করে।
আলোচনা করতে গিয়ে আসিফ নজরুল আমাকে উদ্দেশ করে বলেন, আপনি বরং একটা পার্টি করেন, ৩০০ আসনে প্রার্থী দিন। মানুষ আওয়ামী লীগ, বিএনপির কোনোটাকেই পছন্দ করে না।...
এরপর আলোচনা এই লাইনেই অগ্রসর হয়। প্রধান অতিথির ভাষণে হাফিজউদ্দিন খান একই রকম কথার প্রতিধ্বনি করেন। সেই দিনই টিভিতে এবং পরদিন পত্রপত্রিকায় ফলাও করে প্রকাশিত হয় যে নাগরিক ঐক্য তৃতীয় (বিকল্প) শক্তি গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছে এবং আগামী সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনে প্রার্থী দেবে বলেছে।
তৃতীয় শক্তি বলতে যদি আওয়ামী লীগ, বিএনপির বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি বোঝানো হয়, তবে এক অর্থে আমরা তা-ই বটে। দেশে যতগুলো নাগরিক অধিকার আন্দোলন আছে তাদের সবাই ইস্যু ভিত্তিতে অথবা সাধারণভাবে নীতিগত লড়াই করে। এ লড়াই আওয়ামী লীগ বা বিএনপিপন্থী হতে পারে না। উদাহরণ হিসেবে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানদের আন্দোলনের কথা বলা যায়। এই আন্দোলন কি সরকারপন্থী হতে পারে? তারা তো পরিষদকে কোনো ক্ষমতাই দিচ্ছে না। বিএনপিপন্থী? তারা তো উপজেলা পরিষদই বাতিল করে দিয়েছিল। কেউ কি ভাবছেন, আমি উপজেলা চেয়ারম্যানদের কথা বলছি কেন? হ্যাঁ, আমি এ আন্দোলনকে অবশ্যই নাগরিক আন্দোলন বলছি। পেশাভিত্তিক আন্দোলনগুলো অবশ্যই নাগরিক আন্দোলন। যেমন, ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ারদের আন্দোলনও নাগরিক আন্দোলন বটে।
লিখতে লিখতে কয়েকটা চমৎকার উদাহরণ মাথায় এসে গেল। আচ্ছা, এই যে একটি সংগঠন আছে, আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ, এটা কেমন নাম? আওয়ামী আইন বলে কিছু আছে কি? আওয়ামী বিচার কিংবা আওয়ামী চিকিৎসা? বিপরীতক্রমে বলা যেতে পারে, জাতীয়তাবাদী আইন, জাতীয়তাবাদী বিচার কিংবা জাতীয়তাবাদী চিকিৎসা বলে কিছু আছে? থাকতে পারে? আইনজীবী কিংবা ডাক্তারদের কেউ-ই নিশ্চয় এ ধরনের ব্যবস্থা প্রবর্তনের আন্দোলন করবেন না।
নাগরিক সংগঠনগুলোর কেউ কেউ সুনির্দিষ্ট অ্যাজেন্ডা নিয়ে আন্দোলন করেন। যেমন, পরিবেশ বা ভোক্তা অধিকার। কিন্তু অনেকেই আছেন, যাঁরা নাগরিকদের গণতান্ত্রিক ও মৌলিক অধিকার, সুশাসন ইত্যাদি নিয়ে আন্দোলন করেন। এমন কেউ কি আছেন, যাঁরা গুম, খুন সমর্থন করবেন? বাংলাদেশের ৪২ বছরের অধিকাংশ সময় যেহেতু বড় দুটি দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল, সেহেতু তাদের কাছেই এই প্রশ্ন উত্থিত হবে এবং সেটা হবে একটি নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে। সব সময় এটা তৃতীয় মত, অবস্থান বা শক্তি হবে, এমন কথা নেই। যেমন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। এ প্রশ্নে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে কোনো ভিন্নতা দেখা যায় না। যদি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে শক্তিশালী কোনো আন্দোলন গড়ে ওঠে, তাকে কি তৃতীয় শক্তি বলা হবে? আরব বসন্তের কথা যদি আমরা বলি, আমার বিবেচনায় এত বড় গণ-অভ্যুত্থান আমরা আর দেখিনি। মিসরে সে আন্দোলন হোসনি মোবারককে পদচ্যুত করল। কিন্তু আন্দোলনকারীদের কি বিজয় হলো? কেন? কারণ, মুসলিম ব্রাদারহুড ও হোসনি মোবারকের দলের বাইরে আর উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক শক্তি ছিল না।
আমি আমার আলোচনার গোড়াতে ফিরে আসি। নাগরিক ঐক্য নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। সর্বশেষ কথা বললেন মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর, ২১ জুলাই, প্রথম আলোয়। একটা ইতিবাচক জায়গা থেকে নিরপেক্ষ, আবেগহীন ও গঠনমূলক আলোচনা করেছেন তিনি। আমার আজকের লেখার প্রণোদনা তিনিই।
আমাদের দেশের নাগরিক আন্দোলনের অধিকাংশ নেতাই এ কথা বলেন যে তাঁরা কোনো দলাদলিতে নেই। তাঁরা কেবল নাগরিকদের অধিকার নিয়ে কথা বলবেন (মাঝেমধ্যে টুকটাক মানববন্ধনও করবেন), কিন্তু কোনো দলের পক্ষে-বিপক্ষে কাজ করবেন না। এটা কেমন কথা? বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে যখন আন্দোলন করছেন, তখন তো দুটি দলেরই বিরোধিতা করছেন। এই দুটি দল যদি তাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন না করে কেবল ক্ষমতার অদল-বদল করে, তাতে কি কোনো লাভ হবে? তাহরির স্কয়ারের আন্দোলনের কথা ভাবেন।
নাগরিক ঐক্য মনে করে, নিটোল গণতন্ত্রের জন্য আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মতো দলকে সুডৌল, সুঠাম হতে হবে। দলের অভ্যন্তরে অবশ্যই জ্ঞান ও গণতন্ত্রের চর্চা থাকতে হবে। দল দুটি আমাদের বলবে, এসব কথা তোমরা বলার কে? আমাদের ঘরে আমরা যা খুশি তা-ই করব। তা চলবে না, জনগণের দল হতে গেলে জনগণের কষ্টের কারণ হতে পারবে না। তাহলে জনগণ তাদের সিদ্ধান্ত নেবে। তারা নতুন কিছুর আশায় বুক বাঁধতেই পারে।
জাহাঙ্গীর বলতে চাইছেন, রাজনৈতিক দল যদি করতে হয়, তবে এখনই করেন। জাহাঙ্গীরের ভেতরে এই তাগিদ কেন? আওয়ামী লীগ-বিএনপির বাইরেও তো আরও দল আছে। জাতীয় পার্টি, গণফোরাম, জাসদ, জেএসডি, বিকল্পধারা আছে তো। জাহাঙ্গীর হয়তো ভাবছেন, এদের দিয়ে হবে না। মান্নাকে দিয়েই যে হবে, তা তিনি বিশ্বাসের সঙ্গে বলছেন না, তবে খানিকটা আশা ধরে রাখছেন। কিন্তু জাহাঙ্গীরই আবার বলছেন, মনে রাখতে হবে, এই দল দুটির (আওয়ামী লীগ ও বিএনপি) ওপর অনেক মানুষ বীতশ্রদ্ধ হলেও নির্বাচনে তাদেরই ভোট দেয়। এই প্রবণতা থেকে সাধারণ মানুষকে সরিয়ে আনা খুব কঠিন। এ জন্য সময় লাগবে।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর যাকে সময় বলছেন, আমি তাকে মানুষের উপলব্ধি বলছি। তাঁর কথার সঙ্গে আমি প্রায় সম্পূর্ণ একমত। আমি শুধু যোগ করতে চাই, এখানে একটা নতুন চিত্র দেখা দিয়েছে, নারায়ণগঞ্জ চিত্র। আমি ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দাঁড়াব বলে মাঠে নেমেছিলাম। ঢাকার মাঠও আমাকে নারায়ণগঞ্জের বার্তাই দিয়েছে। মানুষ বলেছে, আমরা দলবাজি চাই না। আমরা সত্যিকার দল চাই। সৎ ও যোগ্য প্রার্থী চাই।
নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকার এই নির্বাচন সিটি করপোরেশন নির্বাচন হলেও এটা একেবারে স্থানীয় নির্বাচন নয়। বলা যেতে পারে, দেশের সবচেয়ে সচেতন অংশের মানুষের নির্বাচন এটি।
এই নির্বাচনের প্রতিফলন আমরা ভবিষ্যতেও জাতীয় নির্বাচনে কি দেখতে পাব? সে কথার জবাব এখনই দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু চিরজীবনই তো নিশ্চয়ই এক রকম যাবে না। যে অনাচার দেশে শুরু হয়েছে, যে দুর্বৃত্তায়ন রাজনীতিকে গ্রাস করেছে, তার বিরুদ্ধে মানুষ দাঁড়াবে, এটা তো ইতিহাসের শিক্ষা। পরিবর্তন হবেই। কত দ্রুত বা কত ধীরে, তা নির্ধারণ করবে জনগণ।
এই লেখার শুরুতেই আমি বলেছি, ৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার কথা কীভাবে এসেছে। এটা নাগরিক ঐক্যের কোনো আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত নয়। কিন্তু নাগরিক ঐক্যের আলোচনা সভায় এ রকম কথা এসেছে, এবং সংবাদমাধ্যমে তা জনগণের কাছে পৌঁছেছে। আমি বলছি, আমি এ রকম কোনো সিদ্ধান্ত ঘোষণা করিনি। কিন্তু এটা প্রতিবাদ করাও সমীচীন মনে করিনি (আমার কাছে আমার বক্তৃতার সিডি আছে)। কারণ, আমি দেখছি, মানুষ এটা অপছন্দ করেনি। এটা সত্যি, ৩০০টি আসনে প্রার্থী দেওয়া কোনো ছেলেখেলা নয়। কিন্তু মানুষের কোনো নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দেখিনি আমি। ওই সভার সমাপনীতে আমি বলেছিলাম, স্বপ্ন দেখা ভালো, কল্পনাবিলাস ভালো নয়। মানুষ যদি ৩০০ আসনে নতুন রাজনীতির প্রতিনিধি দেখতে চায়, তাহলে তারাই তা খুঁজে বের করবে। আমি আজ এই লেখায় বলছি, ব্যক্তি ইতিহাস তৈরি করে না, ইতিহাস তৈরি করে জনগণ। জনগণের আকাঙ্ক্ষা যদি এ রকমই হয় যে তারা আগামী নির্বাচনে ৩০০ আসনে বিকল্প দেখতে চায়, তবে তা হবে; না হলে মাত্র দুই মাসের একটি নাগরিক সংগঠন এ অসাধ্য সাধন করবে কীভাবে?
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীরের লেখার বিষয়বস্তু যা-ই থাক না কেন, তার মর্মবস্তু হয়েছে তুলির কার্টুন, যেখানে দুই নৌকার ওপরে দাঁড়িয়ে আছি আমি। জাহাঙ্গীরও লিখেছেন, আনুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ না করে তাঁর নতুন একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম গঠনের উদ্যোগ নেওয়াটি ঠিক হয়নি। দুই নৌকায় পা রাখাকে কেউ ভালোভাবে দেখে না।
জাহাঙ্গীরের কথার জবাবে আমি প্রথমে বলব, নাগরিক ঐক্য কোনো রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম নয়। আমি আগেই বলেছি, এটি একটি নাগরিক সংগঠন, যা জনগণের রাজনৈতিক অধিকারের জন্য লড়াই করে। আজ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় বলে তার সঙ্গে ঐক্যের বিরোধ দেখা দিয়েছে। কাল বিএনপি ক্ষমতায় গেলে তার সঙ্গেও ঐক্যের বিরোধ দেখা দেবে। দল দুটির ঘোষণায় বা ইশতেহারের বিরুদ্ধে আমি কিছু করছি না। ভুল করছে সরকার। আমরা তা ধরিয়ে দিতে চাইছি। দলের মধ্যে অনেক মানুষ আছেন, যাঁরা আমার কথা ও কাজকে সমর্থন করেন। আন্তরিক অনেক নেতা-কর্মী আছেন, যাঁরা চান, আমি যেন এই লড়াই চালিয়ে যাই। দল ছেড়ে না যাই। আমি লড়াই ছাড়ছি না, দলকেও ছাড়ছি না।
দু-একজন নিন্দুক আছে, যারা বলতে চায়, মাহমুদুর রহমান মান্না দলে কিংবা সরকারে ভালো কোনো পদ পায়নি, তাই এসব করছে। তারা ভুলে যায়, আজ থেকে ৩০ বছর আগেও আমি এ রকম সুযোগ পেয়েছিলাম। নিজের বুদ্ধি ও বিবেচনার বাইরে আমি কিছু করতে পারি না।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর এও বলেছেন, জনাব মান্না ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সহকর্মীরা যদি আগামী সরকারেই মন্ত্রী বা এমপি হতে চান, তাহলে বিএনপি বা জাতীয় পার্টিতে যোগ দিতে পারেন, সেখানে সম্ভাবনা বেশি।
জবাবে বলতে হয়, মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর বন্ধু হয়েও আমাকে চিনতে পারেননি।
মাহমুদুর রহমান মান্না: রাজনীতিবিদ ও কলাম লেখক।

No comments

Powered by Blogger.