আজ শোকাবহ ১৫ আগস্ট-অন্তরে রাখিয়া গেছ দান

'তব অন্তর্ধানপটে হেরি তব রূপ চিরন্তন/অন্তরে অলক্ষ্যলোকে তোমার পরম আগমন/লভিলাম চিরস্পর্শমণি; তোমার শূন্যতা তুমি পরিপূর্ণ করেছ আপনি/জীবন আঁধার হল, সেই ক্ষণে পাইনু সন্ধান/সন্ধ্যার দেউলদীপ অন্তরে রাখিয়া গেছ দান/বিচ্ছেদেরি হোমবহ্নি হতে/পূজামূর্তি ধরে প্রেম, দেখা দেয় দুঃখের আলোতে।'


১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিহত হওয়ার বহু বছর আগে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেন এ বাণী লিখে রেখে গেছেন ঠিক আজকের প্রজন্মের তরেই। আজ বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে যেন এ বাণীই বাজছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট দেশি-বিদেশি চক্রের প্ররোচনায় একদল বিচ্ছিন্ন, বিপথগামী সেনাসদস্য বাংলাদেশের স্বাধীনতার সূতিকাগার বলে পরিচিত ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে অবস্থিত বঙ্গবন্ধুর নিজ বাড়িতে অতর্কিত পৈশাচিক হামলা চালিয়ে সপরিবারে তাঁকে হত্যা করে। এ হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে রচিত হয় বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের কালো অধ্যায়। তারা শুধু জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান, বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করেনি, বাঙালির হাজার বছরের প্রত্যাশিত স্বাধীনতার আদর্শকেও হত্যা করতে চেয়েছিল। সেই ধারাবাহিকতায় খুনিচক্র তাঁকে, তাঁর পরিবার ও রাজনৈতিক অনুসারীদের হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, ইনডেমনিটি বা দায়মুক্তি অধ্যাদেশ জারি করে সে জঘন্য অপরাধের বিচারের পথ বন্ধ করে রাখে। শোকস্তব্ধ জাতি এর পর দীর্ঘকাল বুকের ওপর মেশিনগান তাক করা একনায়কতন্ত্র-গণতন্ত্র খেলা প্রত্যক্ষ করে। কিন্তু এ জাতি বিবেকবর্জিত নয়, বিস্মৃতপরায়ণ নয়। নানা কারণে খানিকটা সময় নিলেও আজ দেশবাসী যেন সন্ধ্যার দেউলিদীপ জ্বালাতে পেরেছে। এ মহান নেতা ও তাঁর নিহত পরিবারকে হৃদয়ের গভীর ক্ষত হিসেবে উপলব্ধি করতে পেরেছে। হত্যাকাণ্ডের ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু তনয়া শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর গণতান্ত্রিক উপায়ে সে কুখ্যাত ইনডেমনিটি বাতিল করা হয় এবং হত্যার বিচারের পথ উন্মুক্ত করা হয়। পরবর্তীকালে জোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করলে সে বিচার প্রক্রিয়ায় সৃষ্টি হয় নানা প্রতিবন্ধকতা। কিন্তু ২০০৯ সালের নির্বাচনে আবার বিপুল ভোটে মহাজোট সরকার গঠন করলে বিচার প্রক্রিয়া সুসম্পন্ন হয়। মাননীয় আদালতের বিচারে দোষী সাব্যস্ত পাঁচ আসামির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয় ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি। এখনো দণ্ডপ্রাপ্ত কয়েকজন আসামি বিভিন্ন দেশে পালিয়ে আছে।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু ২০০১ সালে জোট সরকার ক্ষমতায় এসে একটি অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে জাতীয় শোক দিবস ও ছুটি বাতিল করে দেয়। পরবর্তীকালে এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে তিন আইনজীবী হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করেন। সে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৮ সালের ২৭ জুলাই একটি রায় প্রদান করেন। রায়ে ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস পালন এবং ওই দিন সরকারি ছুটি বাতিলের সিদ্ধান্তকে মাননীয় আদালত বাতিল ঘোষণা করেন। সরকার এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল ডিভিশনের শরণাপন্ন না হয়ে হাইকোর্টের রায় অনুসরণ করে এবং ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন অকুতোভয় এক দেশপ্রেমিক। আজীবন তিনি দেশ ও মানুষের কল্যাণে নিজেকে বিপন্ন করে তুলতে পিছপা হননি। ছাত্রজীবন থেকে মানুষের কল্যাণে তাঁর যে ত্যাগ ও শ্রম, সেটা কিছুটা ফুটে উঠেছে সদ্য প্রকাশিত অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে। স্বাধীনতার পর তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শের সঙ্গে কারো মতের অমিল থাকতে পারে। কিন্তু কারো জন্য বা কোনো রাজনৈতিক দলের জন্য তাঁর নৃশংস হত্যাকাণ্ডকে সমর্থন জানানো শুধু অমানবিকই নয়, প্রতিহিংসা পরায়ণতার চরম পরাকাষ্ঠা। সব মহলের মনে রাখা উচিত, মানুষের মহত্ত্বকে খাটো করার কোনো সুযোগ নেই। আজ ১৫ আগস্ট এ দেশের মানুষের শোক পালনের দিন। এ দিনটিকে অস্বীকার করার ধৃষ্টতা আর যেন আমাদের না হয়। রবীন্দ্রনাথের ভাষাতেই আমাদের বলতে হয়- সেই এক অভিনব/মধুর সৌন্দর্য তব/আজিও অঙ্কিত তাহা রয়েছে মানসে।

No comments

Powered by Blogger.