বঙ্গবন্ধু থেকে বিশ্ববন্ধু হয়েও তিনি বাঙালি পরিচয় ছাড়তে চাননি by আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী

তিনি বঙ্গবন্ধু থেকে বিশ্ববন্ধু হয়েছিলেন। কিন্তু কখনো তাঁর বাঙালিত্ব ত্যাগ করতে চাননি। রবীন্দ্রনাথ যেমন বলেছিলেন, 'মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক, আমি তোমাদেরই লোক'। তেমনি বঙ্গবন্ধু বলতেন, 'আমি জীবনে-মরণে বাঙালি নামেই পরিচিত থাকতে চাই।' বিবিসির জরিপেও তিনি শ্রেষ্ঠ বাঙালির শিরোপাটিই পেয়েছিলেন।


আজ তাঁর ৩৭তম তিরোধান দিবস। এই সেরা বাঙালির সান্নিধ্য আমি পেয়েছিলাম, এটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় গর্ব। এই সান্নিধ্যের টুকরো টুকরো অনেক স্মৃতি এখন মনে ভাসছে।
সত্তরের দশকের গোড়ার কথা। বাংলাদেশ মাত্র স্বাধীন হয়েছে। বঙ্গবন্ধু তখন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটি পুনর্গঠনে ব্যস্ত। বিশ্ব তখন বাই-পোলার। দুই সুপার পাওয়ার যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন। এক কথায়, ধনবাদী বিশ্ব ও সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব। নোবেল প্রাইজ প্রতিনিধিত্ব করে ধনবাদী বিশ্বের। আর জুলিও কুরি শান্তিপদক প্রতিনিধিত্ব করে সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের। বঙ্গবন্ধুকে সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের এই শ্রেষ্ঠ পদকটি দেওয়া হয়।
এই পদকটি বঙ্গবন্ধুকে দেওয়ার জন্য ঢাকায়ই বিশ্বশান্তি পরিষদের অনুষ্ঠান হয়। সেক্রেটারি জেনারেল রমেশ চন্দ্র স্বয়ং চলে আসেন পদকসহ ঢাকায়। তিনি এক অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর গলায় পদক ঝুলিয়ে দিয়ে ঘোষণা করেন, 'আজ থেকে বঙ্গবন্ধুর পরিচয় বিশ্ববন্ধু।'
এই পদক ও খেতাবপ্রাপ্তির পর অনুষ্ঠান শেষে বঙ্গবন্ধু যখন সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছেন, তখন এক সাংবাদিক তাঁকে 'বিশ্ববন্ধু' বলে সম্বোধন করতেই তিনি হেসে বলেছিলেন, 'আমাকে বিশ্ববন্ধু বলতে চাও বলো; কিন্তু আমার বাঙালি পরিচয়টি মুছে দিও না। আমি জীবনে-মরণে বাঙালি। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বকবি খেতাব পেয়েছিলেন। তাই বলে কি বাংলা ভাষা ছেড়ে অন্য ভাষায় কবিতা লিখতে শুরু করেছিলেন? ভাত-মাছ খাওয়া ছেড়েছিলেন? শান্তিনিকেতনকে কি বাংলাদেশের একটি তপোবন হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেননি? আমিও তেমনি বাঙালি থাকতে চাই। বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে চাই বাঙালিদের শ্রেষ্ঠ স্বভূমি হিসেবে। আমি বলছি বটে, বাংলাদেশ হবে প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড, কিন্তু তা হবে সমৃদ্ধি, উন্নয়ন ও শান্তির ক্ষেত্রে। বাস্তবে বাংলাদেশ হবে তার নিজস্ব সভ্যতা ও সংস্কৃতিভিত্তিক দেশ।'
বঙ্গবন্ধুর বিশ্ব শান্তি পুরস্কার পাওয়া উপলক্ষে একটি রঙিন ছায়াছবি নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। যদিও প্রামাণ্য ছবি, তথাপি তাতে কিছু তথ্যভিত্তিক কাহিনী ও গান জুড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা হয়। বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয় এই ছবিটি নির্মাণের দায়িত্ব নেয়। তখন বিখ্যাত চলচ্চিত্র অভিনেতা প্রয়াত আবুল খায়ের তথ্য মন্ত্রণালয়ের ফিল্ম ডিভিশনের কর্মকর্তা। তিনি ছবিটি প্রযোজনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কাহিনীকার আমি। ছবিটি পরিচালনার দায়িত্ব নেন প্রখ্যাত চিত্রপরিচালক প্রয়াত আলমগীর কবির। সংগীত পরিচালক সমর দাশ। কিন্তু তাঁর পরামর্শেই সলিল চৌধুরীকে উপদেষ্টা সংগীত পরিচালক হতে অনুরোধ জানানো হয়।
এক ঘণ্টার ছবি। কাহিনীটির খসড়া তৈরির পর বঙ্গবন্ধুকে শোনানোর ব্যবস্থা হয়। বাহাউদ্দীন চৌধুরী তখন ছিলেন ভারপ্রাপ্ত তথ্যসচিব। তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার, খায়েরের ও আলমগীরের একটি বৈঠকের ব্যবস্থা করে দেন। অবশ্য আবুল খায়েরের জন্য বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ছিল অবারিত দ্বার। বঙ্গবন্ধু তাঁকে স্নেহ করে ডাকতেন 'আভাইগ্যা'- অর্থাৎ অভাগা। আবুল খায়ের কিছুদিন শেখ হাসিনার গৃহশিক্ষকতাও করেছেন।
আমাদের বৈঠকটি অবশ্য হলো গণভবনে। বঙ্গবন্ধু স্ক্রিপ্টটি পছন্দ করলেন। কিন্তু ছবিটিতে 'শোনো একটি মুজিবরের কণ্ঠে লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠ' গানটির সংযোজন পছন্দ করলেন না। আমাকে বললেন, 'তুমি একটা গান লিখে দাও না কেন?' আমি একটু ভেবে বললাম, ছবিটির কাজ দুই-তিন দিনের মধ্যে শেষ করতে হবে। এত তাড়াতাড়ি একটা গান লিখে তাতে সুর দেওয়া হলে ভালো না-ও হতে পারে। তবে সমর দাশের সুর দেওয়া আমার একটি গান আছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হতো। আপনি অনুমতি দিলে সেটি ব্যবহৃত হতে পারে। গানের প্রথম দুটি লাইন হচ্ছে :
'আমার নেতা তোমার নেতা শেখ মুজিব
বাংলাদেশের প্রাণে গানে চিরঞ্জীব,
শেখ মুজিব, শেখ মুজিব।'
গানের দুটি চরণ তাঁকে আবৃত্তি করে শুনিয়ে বললাম, যদি ইচ্ছে করেন, তাহলে গানটি আপনাকে শোনানোরও ব্যবস্থা হতে পারে। বঙ্গবন্ধু বললেন, 'না, আর শোনানোর দরকার নেই। এ গানটিই দাও। আর ভালো কথা, ছবির কী নাম দিয়েছো?' আবুল খায়ের বললেন, 'বঙ্গবন্ধু থেকে বিশ্ববন্ধু।' বঙ্গবন্ধু একটু চুপ থেকে বললেন, 'আমি যে বাঙালি, এ কথাটা মুছে দিও না।'
বঙ্গবন্ধু হত্যার সময় আমি লন্ডনে। তারপর দীর্ঘকাল বাংলাদেশে যেতে পারিনি; কিন্তু আবুল খায়ের ছিলেন আমার বন্ধু। তাঁকে বলেছি, বঙ্গবন্ধুর ওপর তৈরি এই ছবিটি কি উদ্ধার করা যায় না? আবুল খায়ের দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বলেছেন, 'গোপনে অনেক চেষ্টা করেছি। সামরিক পোশাকধারী ঘাতকের দল বঙ্গবন্ধুর সব রকম ছবি, ভাষণ, বিবৃতি- সব কিছু ওই রাতে বিভিন্ন অফিসে, রেকর্ডরুমে ঢুকে ধ্বংস করেছে। হয়তো এই ছবিটাও তারা ধ্বংস করেছে।'
দুই
বাংলাদেশ মাত্র স্বাধীন হয়েছে। সৈয়দ মুজতবা আলী এবং কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকার তৎকালীন নির্বাহী সম্পাদক ও কথাশিল্পী সন্তোষ কুমার ঘোষ এসেছেন মুক্তবাংলা সফরে। উঠেছেন ঢাকার পূর্বাণী হোটেলে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁদের সাক্ষাতের ব্যবস্থা হয়েছে। মুজতবা আলী তাঁর স্বভাবসিদ্ধ রসিকতার ভাষায় আমাকে বললেন, 'আম্মোও (আমিও) যাচ্ছি। তুমি আমাদের সঙ্গে চলো।'
খুশি হয়েই রাজি হলাম। গণভবনেই সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা হয়েছিল। প্রায় ঘণ্টাখানেক দুই সাহিত্যিকের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু কথা বললেন। বিদায় নেওয়ার আগে সৈয়দ মুজতবা আলী বললেন, 'বঙ্গবন্ধু, শুনেছি আপনি রবীন্দ্রনাথের খুব ভক্ত। তাঁর অনেক কবিতা আপনার ঠোঁটস্থ। আপনি তাঁর কোনো একটির দু-চার লাইন আবৃত্তি করে আমাদের শোনাবেন?' বঙ্গবন্ধু দ্বিধামাত্র করেননি, সঙ্গে সঙ্গে আবৃত্তি করলেন :
'নমো নমো নমো সুন্দরী মম জননী বঙ্গভূমি
গঙ্গার তীর স্নিগ্ধ সমীর জীবন জুড়ালে তুমি।'
প্রায় অর্ধাংশের মতো কবিতাটি আবৃত্তি করে বঙ্গবন্ধু থামলেন। সৈয়দ মুজতবা আলী বললেন, 'আমরা আশা করেছিলাম, রবীন্দ্রনাথের কোনো একটি শ্রেষ্ঠ কবিতা আপনি আবৃত্তি করবেন।' বঙ্গবন্ধু বিব্রত হলেন না, মৃদু হেসে বললেন, 'রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ কবিতা আবৃত্তি করবেন আপনারা, যাঁরা শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবী। আমি একজন রবীন্দ্রভক্ত সাধারণ বাঙালি। বাঙালির প্রাণে দোলা দেয় রবীন্দ্রনাথের এমন কবিতাই আমার কাছে প্রিয়।' বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পূর্বাণী হোটেলে ফিরে এসে মুজতবা আলী ও সন্তোষ কুমার ঘোষ দুজনেই আমাকে বলেছিলেন, 'হি ইজ রিয়ালি এ গ্রেটম্যান।'
তিন
কমনওয়েলথ প্রধানমন্ত্রী সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু যোগ দিতে এসেছেন। লন্ডনে না অটোয়ায়, তা আমার এখন মনে নেই। কারণ কাহিনীটা লন্ডনের কমনওয়েলথ সেক্রেটারিয়েটের এক উচ্চপদস্থ অফিসারের কাছে শোনা। তিনি ওই সম্মেলনে প্রটোকল অফিসার হিসেবে হাজির ছিলেন। শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী তখন ছিলেন শ্রীমাভো বন্দর নায়েকে। সম্মেলনের লাঞ্চ ব্রেকে শ্রীমাভো সম্মেলনকক্ষের বাইরে এক স্থানে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে গল্প করছেন। দুজনের নতুন পরিচয়।
শ্রীমাভোর সঙ্গে ছিলেন তাঁর এক মেয়ে। সম্ভবত পরবর্তী সময়ে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট কুমারাতুঙ্গা। তাঁর তখন অল্প বয়স। বঙ্গবন্ধু তাঁকে স্নেহার্দ্র কণ্ঠে বললেন, 'জানো, আমাদের এক পূর্বপুরুষ বিজয়সিংহ বহুকাল আগে তোমাদের দেশ দখল করে তার নাম রেখেছিলেন সিংহল।' শ্রীমাভোকন্যা বলে উঠলেন, 'হিজ একসিলেন্সি, উই হোপ, ইউ হ্যাভ নো ইনটেনশন টু ইনভেড অ্যাগেইন আওয়ার কান্ট্রি (আমাদের আশা, আমাদের দেশটি আবার দখল করার ইচ্ছা আপনার নেই=।)' এই জবাবে বঙ্গবন্ধু মোটেই অপ্রতিভ হননি। সঙ্গে সঙ্গে বলেছেন, 'নো মাই ডিয়ার, উই হ্যাভ নো ইনটেনশন টু ইনভেড ইওর কান্ট্রি; বাট উই হ্যাভ স্ট্রং ইনটেনশন টু ইনভেড ইওর হার্ট (না, না, তোমাদের দেশ দখল করার কোনো ইচ্ছা আমাদের নেই। কিন্তু তোমাদের হৃদয় দখল করার প্রবল ইচ্ছা আমাদের আছে)।'
চার
তাঁর সঙ্গে আমার শেষ দেখা ১৯৭৫ সালের জুলাই মাসের শেষদিকের এক সন্ধ্যায়। লন্ডনে ফিরে আসব, তাই দেখা করতে গিয়েছিলাম। নবনিযুক্ত জেলা গভর্নরদের অনেকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। আমি বিদায় সাক্ষাৎ করতে এসেছি জেনে বললেন, 'তাড়াতাড়ি ফিরে এসো। মুক্তিযুদ্ধের চেয়েও বড় যুদ্ধে এবার হাত দিয়েছি। এটা শোষণমুক্ত বাংলা গড়ার যুদ্ধ। ওরা হায়েনার মতো হিংস্র হয়ে উঠেছে। কখন আঘাত করে ঠিক নেই।'
বঙ্গবন্ধুর কাছে দোয়া চেয়ে লন্ডনে ফিরে এসেছি। ১৫ আগস্ট খুব সকালে (লন্ডন সময়, বাংলাদেশে তখন দুপুর) ঘুম ভাঙল মহীউদ্দীন চৌধুরীর (বাংলাদেশ দূতাবাসে তখন প্রেসসচিব) স্ত্রীর আর্তচিৎকারে, 'বঙ্গবন্ধু আর নেই। তাঁকে মেরে ফেলা হয়েছে।'
আমি মনে মনে ইন্না লিল্লাহি...রাজিউন পাঠ করে মনে মনেই বলেছি, বাংলার স্বাধীনতার সূর্য আবার অস্তমিত হলো।
লন্ডন, ১৩ আগস্ট, সোমবার, ২০১২

No comments

Powered by Blogger.