ঈদ মানেই মজার মজার ঘটনা। মায়ের হাতে পায়েস, বন্ধুদের কাছে ফেরার আকুতি, গ্রামে ফেরার তাড়া কিংবা দেশের বাইরের ঈদ। কেমন সে সব অভিজ্ঞতা—জানাচ্ছেন সফল ৬ তরুণ-মজার ঈদ

শৈশবে ঈদের দিনগুলো ঈদ ফিরে এলেই কেন যেন শৈশবের কথা খুব মনে পড়ে। আহ্, কি মায়াময় সেই দিনগুলো! আমি বেড়ে উঠেছি ঢাকার মোহাম্মদপুরে। সারা বছর গ্রামের বাড়ি খুব একটা যাওয়া হতো না। তবে ঈদ উপলক্ষে গ্রামের বাড়ি বরিশালের দেহেরগতিতে যেতাম মা-বাবাসহ ছোট্ট আমি। সে কী উদ্দীপনা সবার মধ্যে।


আমার মায়ের পানিভীতি আছে বলে লঞ্চে যাওয়া হতো না। বাসই ছিল ভরসা। গ্রামে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অভূতপূর্ব এক দৃশ্য দেখতাম—আমাদের নেওয়ার জন্য ভ্যানগাড়ির লম্বা লাইন পড়ে যেত। আমি সর্দার বংশের মেয়ে। তাই কেউ বলতেন সর্দারের মেয়ে এসেছে, আবার কেউ বা বলতেন মেম্বারের মেয়ে এসেছে। ঈদের ছুটিতে পড়ালেখার বালাই নেই। গ্রামের বাড়ির জামরুল বাগানে তাই আমি, মুনমুন, গালীব, হূদয়, জেরিন, জীয়ন, সোহেল—সব চাচাতো-ফুপাতো ভাইবোন মিলে উৎসবের আমেজে হুটোপুটি, আমাদের সে সময় পায় কে।
একটু বড় হওয়ার পর যখন ঢাকায় ঈদ করতে শুরু করলাম, তখন খালাতো ভাইবোন ও বন্ধুবান্ধবই ছিল আমার সারা দিনের সঙ্গী। এখনো চোখে ভাসে, মোহাম্মদপুর কিশলয় গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজে আমার প্রিয় বন্ধু ফারিয়ার সঙ্গে সারা দিন ঘুরছি টো টো কোম্পানির মতো।
 নাজিয়া হক অর্ষা, অভিনেত্রী
শিক্ষার্থী, খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ঈদ মানেই মায়ের হাতের পায়েস
যখন দেশের বাইরে খেলতে যাই, তখন ঈদ এলে একটু অন্য রকমই লাগে। যদিও খেলার টেনশনে ডুবে থাকি বলে ব্যাপারটা তত টের পাই না। অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ বেশ কয়েকটি দেশে খেলার সময় ঈদ কাটিয়েছি। তো সেই সময় এত বেশি খেলা নিয়ে টেনশন করতাম যে, ঈদের দিন কীভাবে কেটে যেত তা টেরই পেতাম না। তবে ঈদের দিন আমরা মানে দলের অন্য খেলোয়াড়েরা মিলে একটু আনন্দ-আড্ডা দিতাম এই আর কি! ও হ্যাঁ, বলাই হয়নি—ঈদের দিন ভোরে উঠেই দেশে মায়ের সঙ্গে একবার টেলিফোনে কথা বলে নিতাম। অন্য আত্মীয়স্বজনের খোঁজখবর নিতাম। মায়ের জন্য একটু বেশি খারাপ লাগত। কিন্তু কী আর করা, ক্রিকেটারের জীবন যখন বেছে নিয়েছি, তখন এসব স্যাক্রিফাইস তো করতেই হবে। আমি আসলে মায়ের হাতের রান্না করা পায়েস খাওয়ার জন্য সব সময় মুখিয়ে থাকতাম। তাই ঈদের দিন বিদেশে থাকলে এই একটা জিনিসই আমি বেশি মিস করতাম।
এবারের ঈদে কী করব সেটা নিয়ে এখনো কিছু ভাবিনি। তবে এটা আমাদের নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, বাবার সঙ্গে ঈদের মাঠে দুই ভাই একই সঙ্গে যাব। আশা করি এবারও এর ব্যতিক্রম হবে না। আগামী সেপ্টেম্বরে শ্রীলঙ্কায় হবে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। এ জন্য এখন আমাদের অনুশীলন ক্যাম্প চলছে। তবে মনটা পড়ে আছে নড়াইলেই। ঈদের ছুটি পেলেই নড়াইল দে ছুট। ঈদে পরিবার-পরিজন নিয়ে আনন্দ করার মজাটাই আলাদা।
 মাশরাফি বিন মুর্তজা, ক্রিকেটার
দর্শনে স্নাতক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

কদিন পরেই ছুটি
‘আর কটা দিন পরেই ছুটি, সেই ছুটিতে যাব বাড়ি, সেই চেনা পথ...’—বাপ্পা মজুমদারের এই গানটা খুব মনে পড়ছে। এই প্রথম আমি দূর থেকে গিয়ে বাবা-মায়ের সঙ্গে ঈদ করব। সেই সঙ্গে চাচাতো ভাই-বোনদের সঙ্গেও দেখা হবে দীর্ঘদিন পর। ভাবতেই কেমন একটা রোমাঞ্চ অনুভব করছি। আগে যেটা হতো, পড়াশোনার জন্য আমার যেসব কাজিন ঢাকায় থাকত, তাদের সঙ্গে এই ঈদের সময়ই দেখা-সাক্ষাৎ হতো। এবার পড়াশোনার কারণে আমিও গোপালগঞ্জের বাইরে, তাই ঈদে বাড়ি যাওয়ার অভিজ্ঞতা আমারও এই প্রথম। বলে রাখা ভালো, মেডিকেলে ভর্তি প্রস্তুতির জন্য আমি এখন ঢাকার বাসিন্দা।
এখন মনে হয়, ঈদের আগের রাতটা ছোটবেলায়ই বেশি ভালো কাটত। বাসার কাছেই আমাদের মাঠ ছিল। সেখানে পাড়ার ছেলেমেয়ে আর আমরা ভাইবোনেরা অনেক মজা করতাম। তবে এখনকার মজাটাও একেবারে কম নয়। ঈদের আগের রাত প্রায় বন্ধুদের সঙ্গেই কেটে যায়। তবে ঈদের দিনের শুরুটা প্রতিবারের মতোই এক রকম।
ঈদ মানেই সালামি। তাই সালামির কথা না বললেই নয়। একবার আমার এক দূরসম্পর্কের ছোট ভাই আমাদের সঙ্গেই ঈদ করেছিল। ওকে আমরা বলেছিলাম, সে যেন সবাইকে সালাম করে। ও তো খুব মজা পেয়ে রাস্তাঘাটের সবাইকেই সালাম করা শুরু করে দিয়েছিল! ওর কল্যাণে সেবার পকেট ভরে গিয়েছিল আমাদের!
 চৌধুরী সাদিদ আলম
গ্রামীণ ফোন-প্রথম আলো আই জিনিয়াস ২০১১
শিক্ষার্থী, সরকারি বঙ্গবন্ধু কলেজ, গোপালগঞ্জ

ঈদ কাটে ছোটদের সঙ্গে
আমার ঈদ কাটে ছোটদের সঙ্গে। সকালে ঘুম ভাঙে আশপাশের ফ্ল্যাটের পিচ্চিপাচ্চাদের হাঁকডাকে। ওদের সবার একটাই আবদার—আপু আমাদের সাজিয়ে দাও। তো কী আর করা! অগত্যা সবাইকে সাজিয়ে দিয়ে ফের নিজে তৈরি হওয়ার পালা। তার আগে অবশ্য আত্মীয়স্বজন আর ভক্তদের খুদেবার্তার জবাব দিই। এর মধ্যেই মা সমস্ত রান্নাবান্না শেষ করে ফেলেছেন। তারপর বাবা আর ছোট ভাই ঈদগাহ থেকে ফিরে এলে একসঙ্গে বসে যাই দুপুরের খাওয়াদাওয়া সারতে।
বিকেল কাটে কাজিনদের সঙ্গে। আমার কাজিনরা থাকে উত্তরায়। তো সাজুগুজু করেই রওনা হই উত্তরার পথে। তারপর হইহুল্লোড়, আড্ডা এবং যথারীতি পেটপুজো।
উহ! কী যে মজা হবে ঈদের বিকেলটায়! তবে একটা বিষয় মনে হলেই মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। এবার ঈদের পরপরই সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা। দুঃখ আছে আরও একটা। এবার টেলিভিশনে আমার যে প্রোগ্রামগুলো দেখানো হবে, সেগুলো হয়তো নিজেরই দেখার সুযোগ মিলবে না। সারা দিন তো হইহুল্লোড় করতেই কেটে যাবে। টেলিভিশন দেখার সময় কই!
 সানিয়া সুলতানা লিজা, ক্লোজআপ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন ২০০৮
শিক্ষার্থী, বিবিএ, ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটি

হার্ভার্ডে ঈদ
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাওয়ার কারণে গত বছরের দুটি ঈদই করেছি পরিবার ছাড়া। একটু অবাকই হয়েছি, যখন দেখি হার্ভার্ডে পাঠ্যসূচিতে ঈদের ছুটি নেই! ঈদ হবে আর ক্যাম্পাস বন্ধ থাকবে না, তা কি হয়? অথচ শেষমেশ তাই হলো! রোজার পরে ঈদের দিনটিও থাকে ক্লাসে ঠাসা। সকাল সকাল উঠে গোসলের পর মুসলিম শিক্ষার্থীরা মিলে নামাজ পড়তে যাওয়া। তারপর আবার ক্লাসে দৌড়। সারা দিনটা এভাবেই কাটে। রাতটা বাঙালি ও মুসলিম ছাত্র সংগঠনের নৈশভোজে বেশ মজার মধ্য দিয়েই কাটে। তবে ঈদের পর মজা হয় ঈদ পরবর্তী ছুটির দিনের পনর্মিলনীতে। সব বাঙালি শিক্ষার্থী একসঙ্গে সেদিন ঈদের মতো করেই কাটাই। তার পরও খুব মনে পড়ে দেশের কথা। মায়ের চাকরির সুবাদে কুষ্টিয়ায় থেকেছি অনেক দিন। সেখানের বন্ধুদের সঙ্গে নেটিশ ছাড়া আড্ডা, এবাড়ি-ওবাড়ি নাক ডুবিয়ে খাওয়া—সবই মনে পড়ত ঈদের দিন, যা মনে করে করে দুধের স্বাদ অনেকটা ঘোলে মেটাতে মেটাতে ঘুমিয়ে ঈদ পার। এবারের গ্রীষ্মকালীন তিন মাসের ছুটিতে দেশে আছি। ঈদটা নিয়ে তাই অনেক পরিকল্পনা ফেঁদেছি। গত দুই ঈদের মজাটা কড়ায়-গণ্ডায় উসুল করে নেব এবার। এবারের ঈদ করতে আমরা মামাবাড়িতে যাব। সেখানে একসঙ্গে অনেক মানুষের রান্না হয়। সারাক্ষণ উৎসব উৎসব লাগে। নিজের দেশের এই মজা কি আর হার্ভার্ডে পাওয়া যায়?
 তারিক আদনান, আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াড ২০১০-এ ব্রোঞ্জপদক বিজয়ী
শিক্ষার্থী, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়

বাবার সঙ্গে গান করব
প্রতিবারের মতো এবারও নাড়ির টানে গ্রামের বাড়ি দিনাজপুরে ফিরব। ঈদের দিনে সকালে বাবা-মা ও নানিকে সালাম করি। তারপর বাবার সঙ্গে চলে যাই ঈদগাহে। নামাজ শেষে বাড়ি ফিরেই ভোজনের পালা। মায়ের হাতের সেমাই দিয়েই দিনটা শুরু।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলেই চলে যাই বন্ধুদের আড্ডায়। ঈদের আড্ডায় এলাকার বন্ধুদের পেয়ে পুরোনো স্মৃতিগুলো ফিরে আসে বারবার। মনে পড়ে, আমি যখন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়তাম, তখন সাইকেল চালানোর নেশা ছিল প্রচুর। সারা দিন সাইকেলে করে শহরের এ-মাথা ও-মাথা চষে বেড়াতাম। এমনকি ঈদের দিনও এই দুরন্তপনা থেকে বাদ পড়ত না। এখনো ইচ্ছে করে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ি! বড্ডো মিস করি সেই সময়গুলো।
সন্ধ্যা নেমে এলে বাড়ি ফিরে বাবার সঙ্গে বসে পড়ি হারমোনিয়াম নিয়ে। বাবাও গান করতেন শখের বসে। মূলত তাঁর কাছেই আমার গান শেখার হাতেখড়ি। প্রতি ঈদে সন্ধ্যায় বাবার সঙ্গে গানের আড্ডা জমে ওঠে। বাবা আমার গান শোননে, গানের ভুল ধরেন এমনকি নিজেও গান শোনান।
 তৌসিফ, গায়ক ও সংগীত পরিচালক
শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ।

No comments

Powered by Blogger.