একটি পরিবারের গল্প by রুম্মান রশীদ খান

ন্ধুরা তাঁকে ডাকতেন ‘টাইগার’ বলে। কেউ বলতেন ‘প্যাট’। পতৌদি খানদানের নবম এবং শেষ নবাব মনসুর আলী খান পতৌদি পরিবার-পরিজন থেকে বন্ধুবান্ধব—সব মহলেই ছিলেন প্রখর রসবোধসম্পন্ন, বন্ধুবৎসল একজন মানুষ। সবার জীবনকে রাঙিয়ে তোলা এই মানুষটিই যখন মাত্র ২০ বছর বয়সে গাড়ি দুর্ঘটনায় ডান চোখের দৃষ্টি হারিয়ে ফেলেন, তখন তিনি স্বাভাবিকভাবেই জীবনের ছন্দ হারিয়ে ফেলতে পারতেন। কিন্তু পতৌদি জুনিয়রের ধমনিতে যে নবাবি রক্ত বইছিল। জীবনের অন্ধকার অধ্যায়কে স্বগুণেই আলোয় ভরিয়ে তুলেছিলেন তিনি।

ক্রিকেটের ময়দানে তাঁর সাফল্যের ঝলকানি মুহূর্তেই তাঁর হাতে সঁপে দিয়েছিল জাতীয় দলের অধিনায়কত্বের গুরুদায়িত্ব। ৪৯৯ ইনিংসে এই সফল খেলোয়াড় মোট রান করেছিলেন ১৫ হাজার ৪২৫। ১৪ বছরে ৪৬টি টেস্ট ম্যাচের ৪০টিতেই ছিলেন জাতীয় দলের অধিনায়ক। এই তারকা খেলোয়াড়ের ঝুলিতে রাষ্ট্রীয় পদ্মশ্রী পদক যাবে—এটাই স্বাভাবিক। তবে এসব আলোচনাকে ছাপিয়ে মনসুর আলী খান পত্রিকার পাতায় নতুন করে শিরোনাম হন ’৬৯-এ; সে সময়ের তারকা নায়িকা শর্মিলা ঠাকুরকে বিয়ে করে। ঠাকুর পরিবারের মেয়ে শর্মিলা সত্যজিৎ রায়ের বাংলা ছবি অপুর সংসার দিয়ে অভিনয় জীবন শুরু করলেও বলিউডের হাতছানি ফিরিয়ে দিতে পারেননি। যেমনটি মনসুর আলী খান পারেননি শর্মিলার দিক থেকে নজর সরিয়ে নিতে। অবশ্য প্রথম দর্শনে প্রণয়, অতঃপর পরিণয়—এমনটি ঘটেনি শর্মিলা-মনসুর প্রেম উপাখ্যানে। টানা চার বছর শর্মিলাকে নিয়ে ভেবেছেন নবাব সাহেব। অতঃপর প্রস্তাব। তাও রেফ্রিজারেটর পাঠিয়ে। ক্রিকেট সুপারস্টারের এই অভিনব প্রেম প্রস্তাব তারকা নায়িকার মনের কড়া এতটুকু নাড়াতে পারেনি। উপায় না দেখে সনাতনী পথেই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন প্রেমিকপ্রবর। প্রতিদিন ট্রাকে করে গোলাপ পাঠাতে থাকেন প্রেমিকার বাড়িতে। এবার প্রেম পালাবে কোথায়? শর্মিলার মনও ছন্দে-আনন্দে গেয়ে ওঠে, ‘আমার পরান যাহা চায়, তুমি তাই...’! কিন্তু খানদানি মুসলিম পরিবারের নবাব এবং হিন্দু পরিবারের বাঙালি কন্যার বিয়েটা কি সমাজ অত সহজে মেনে নিতে পারে? বাধ্য হয়েই বেগম আয়শা সুলতানা নাম নিয়ে শর্মিলা ধর্মান্তরিত হন মুসলিম ধর্মে। তা-ও নিন্দুকদের কানাঘুষা বন্ধ হয়নি। অনেকেই ধারণা করেছিলেন, বিয়েটা বুঝি খুব বেশি দিন টিকছে না। কিন্তু এসব ভবিষ্যদ্বাণী ধোপে টেকেনি। ৪২ বছরের সফল সংসারে এক ছেলে সাইফ আলী খান, দুই মেয়ে সাবা আলী খান ও সোহা আলী খানের গর্বিত বাবা-মা হয়েছেন তাঁরা। শুধু তা-ই নয়, বিয়ের পর মা হয়ে শর্মিলা নায়িকা হিসেবে তুলনামূলক বেশি প্রশংসা কুড়ান। বিয়ের আগে এন ইভিনিং প্যারিস ছবিতে ভারতীয় নায়িকাদের মধ্যে প্রথম বিকিনি পরে পর্দায় হাজির হন। বিয়ের পরও গ্ল্যামারাস থেকে বিকল্প ধারার ছবিতে সব মহলের হাততালি পান তিনি। আর সব কাজেই স্বামী মনসুরের ছিল অকুণ্ঠ সমর্থন।
নিয়মকানুনের বেড়াজালে সম্পর্ককে কখনো বন্দী করতে চাননি শর্মিলা-মনসুর দম্পতি। সন্তানদের ছোটবেলা থেকেই কোরআন শরিফ পড়া শিখিয়েছেন, বাড়িতে মুসলিম দারোয়ান, বাবুর্চি, গৃহপরিচারিকা রেখেছেন; তবে সন্তানদের স্বাধীনতায় কখনো হস্তক্ষেপ করেননি। ২১ বছর বয়সে সাইফ যখন হুট করেই তাঁর চেয়ে ১২ বছরের বড় অমৃতা সিংকে বিয়ে করেন, তখন বাবা-মা মনোক্ষুণ্ন হয়েছিলেন ঠিক, তবে ছেলের স্ত্রীকে প্রথম দিন থেকেই আপন করে নিয়েছিলেন। অমৃতাও ধর্মান্তরিত হয়ে সাইফকে বিয়ে করেছিলেন। তবে এই বিয়ে এক যুগের বেশি টেকেনি। একটা সময় ইতালিয়ান মডেল রোজার সঙ্গে সাইফের মন দেওয়া-নেওয়া শুরু হয়। এই পর্ব শেষ করে সাইফের মনের ট্রেন ছোটে কারিনা কাপুর জংশনে। মনসুর-শর্মিলা অমৃতার সঙ্গেও যোগাযোগ ছিন্ন করেননি, কারিনাকেও দূরে ঠেলে দেননি। বরং আগামী বছর কারিনার সঙ্গে ছেলেকে বিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনাও করেছিলেন বাবা-মা। কিন্তু হায়! জীবনের চিত্রনাট্য যে এভাবে হুট করে বদলে যাবে, কে জানত! ৭০ বছর বয়সে ২২ সেপ্টেম্বর পৃথিবীকে চিরবিদায় জানান মনসুর আলী খান পতৌদি। শর্মিলা অবশ্য এখনো স্বামীর মৃত্যুকে মেনে নিতে পারেননি। তাঁর ভাষায়, ‘আমাদের সম্পর্ক ছিল আত্মিক। স্রেফ মৃত্যু কখনো আমাদের পথচলাকে বদলে দিতে পারবে না। যত দিন বেঁচে থাকব, স্বামীর দেখানো পথে চলব। স্বামীর রেখে যাওয়া কাজগুলো সম্পূর্ণ করব।’ মৃত্যুর আগে নবাব পতৌদি তাঁর চোখটি দান করে গিয়েছিলেন ভেনু আই ইনস্টিটিউটকে। নিজে ডান চোখে দেখতে পারতেন না বলেই হয়তো দুঃখীদের যন্ত্রণা আরও বেশি অনুভব করতে পেরেছিলেন। নবাব পতৌদির প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় দেড় লাখ দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সুস্থ হয়েছিল, জানায় ভেনু আই ইনস্টিটিউট। তবে সব রকম সামাজিক কর্মকাণ্ড চুপিসারে করতেই ভালোবাসতেন মনসুর আলী। মহান ব্যক্তিত্বরা বুঝি এমনই হয়!
[গার্ডিয়ান, বলিউড লাইফ, ওয়ান ইন্ডিয়া, ধাঙ্গআউট, চাকপাক, ইন্টারফেইথ শাদি, ইউএসএ নিউস পয়েন্ট, ফ্রিপ্রেসজার্নাল, ইন্ডিয়া টুডে অবলম্বনে]

No comments

Powered by Blogger.