যুগ-যুগান্তরে চ্যানেল আই by শাইখ সিরাজ

কুটির শিল্প থেকে মহাসমুদ্রবন্দর!! একেবারে শুরু থেকেই যদি বলতে হয়, তাহলে ১৯৯৬ সাল হচ্ছে একটা অধ্যায়। ১৯৯৬ সাল প্রাতিষ্ঠানিক রূপরেখা নেওয়ার জন্য একটি গুরুত্ববহ বছর। তবে পরোক্ষভাবে এর প্রক্রিয়া শুরু কিন্তু এরও অনেক আগে থেকে। কী রকম সেটি? সেটি হলো_ইমপ্রেস টেলিফিল্ম নামের একটি প্রাইভেট সেক্টরে প্রোডাকশন হাউসের জন্মের কাহিনী। পরবর্তী সময়ে তারই সুস্পষ্ট রূপান্তর, ১৯৯৯ সালে চ্যানেল আই।

১৯৯৬ সালে প্রাইভেট সেক্টরে প্রোডাকশন হাউস নির্মিত নাটক কিনে প্যাকেজের আওতায় দেখাতে শুরু করল বাংলাদেশ টেলিভিশন। কারণ, টেলিভিশনের প্রোগ্রামের মান তখন ক্রমেই দুর্বল হয়ে যাচ্ছিল। তাই টিভি কর্তৃপক্ষ প্রথম ধাপে প্রাইভেট সেক্টর থেকে প্যাকেজ প্রোগ্রাম কিনে প্রচার শুরু করল। এরপর চাংক বিক্রয়ের মাধ্যমে। সে সময় প্রথম, আমার মনে আছে, অভিনেতা আফজাল হোসেন, চিত্রগ্রাহক আহসান নেওয়াজ বাবু, আনোয়ার হোসেন বুলুদের ইনফ্রেম একটা বড়সড় টেকনিক্যাল হাউস হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। আর ছিল ম. হামিদ ও ফাল্গুনী হামিদের টেলিরিয়েল। হাতেগোনা কিছু হাউস বাংলাদেশ টেলিভিশনকে প্যাকেজে নানা ধরনের অনুষ্ঠান দিত। এর পরপর তৈরি হলো ইমপ্রেস টেলিফিল্ম। আমরা ইমপ্রেস আনলাম আরো বড় পরিসরে, আরো সফলভাবে। এটা হলো একটা চ্যানেল শুরু হওয়ার জন্য ফুলগাছের বীজ। এরপর ধীরে ধীরে প্রাইভেট সেক্টরে স্টুডিও করতে হয়েছে, টেলিভিশনের মতো ক্যামেরা আনতে হয়েছে, নিজেদের লোকবল তৈরি করতে হয়েছে, প্রফেশনাল প্রোডাকশন তৈরি করতে হয়েছে এবং বাংলাদেশ টেলিভিশনটিকে সেই মানের প্রোগ্রাম দিতে হয়েছে।

অতঃপর ১৯৯৯ সাল
১৯৯৬ সালে যখন রূপরেখাটা তৈরি হলো তখন চ্যানেল আই করার স্বপ্নটা আমাদের মাথায় প্রথম থেকেই একেবারে শতভাগ ছিল, এটা বলা যাবে না। স্বপ্নটা অলক্ষে বিন্দু থেকে সিন্ধুর চেহারা নিয়েছে। এই যে ১৯৯৬-এর ইমপ্রেস টেলিফিল্ম এবং ১৯৯৯-এর চ্যানেল আই, এর আগের প্রেক্ষাপটটা ছিল অপ্রাতিষ্ঠানিক। কিন্তু ওটাও অবচেতনে একটা চ্যানেল তৈরির জোগানদার। একটা প্রোডাকশন হাউসের স্বপ্নপূরণের বাই প্রোডাক্ট।
আশির দশকের মাঝামাঝি বাংলাদেশে প্রথম ভিডিও ক্যামেরা আসে। বিয়ের ভিডিও, বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ভিডিও, যেগুলো করা হতো ওই ভিএইচএস ভিডিও ক্যামেরা দিয়ে। এর আগে এ দেশের সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে স্টিল ছবি তোলা হতো। সেই স্টিল ফটোগ্রাফি শুরুতে ছিল ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট। এই যে প্রযুক্তির অগ্রযাত্রা, এটা লক্ষযোগ্য। প্রথমে সাদাকালো ছবি, এরপর কালার হয়ে গেল, সেই কালার ছবির জায়গায় এল চলমান ছবি ধরে রাখার ভিডিও ক্যামেরা। যত দূর মনে পড়ে, তখন বাংলাদেশে ওল্ড টাউনে, কোনো একজন ব্যক্তির কাছে, একটি ভিডিও ক্যামেরা ছিল। সেই ক্যামেরাটা প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রী ভবন পর্যন্ত ট্রাভেল করত। খুব প্রয়োজনীয় ছিল তখন সেই ক্যামেরাটা। কারণ, বিটিভির বাইরে তখন ব্যক্তি মালিকানায় আর কোনো ভিডিও ক্যামেরা নেই। হ্যাঁ, তবে আরো একটি ছিল। বিটিভিরই একজন সিনিয়র ক্যামেরাম্যান গোলাম মোস্তফা। তাঁর কাছে একটা ছিল। তিনি এখন নেই। প্রয়াত হয়েছেন বেশ আগে। আমাদেরই এই কম্পানির একজন বিশিষ্ট পার্টনার মুকিত মজুমদার বাবু, তখন আমেরিকায় থাকেন, সফল মানুষ সেখানে। আমেরিকায় তিনি তখন পড়াশোনা করেন, ব্যবসাবাণিজ্য করেন। তিনি যখন দেশে ফিরে আসবেন বলে সব ঠিকঠাক, তখন সাগর আর আমি ওনাকে রিকোয়েস্ট করলাম, পারলে তিনি যেন সঙ্গে করে একটি ভিডিও ক্যামেরা নিয়ে আসেন। ওই সময়টায় সাগর আর আমি মিলে 'খাবারদাবার' নামে একটা হোটেল চালাই।
মুকিত মজুমদার বাবু আমাদের অনুরোধ রাখলেন। ফেরার সময় একটি ভিডিও ক্যামেরা নিয়ে এলেন। শুরু হলো আমাদের নতুন জগতের নতুন যাত্রা। এটা নব্বইয়ের কাছাকাছি সময়ে। এরও আগে দেখেছিলাম একটি ভিসিআর। ১০ কেজির কাছাকাছি তার ওজন। সেটি দেখেছি আমাদের পার্টনার জহিরউদ্দিন মাহমুদ মামুনের বাড়িতে।

ছিয়ানব্বইয়ের আগে...
ছিয়ানব্বইয়ের অনেক আগে, আশির দশকের শেষের দিকে সেই নতুন পৃথিবীর গল্পের পটভূমি। ওই ক্যামেরাটা নিয়েই তৈরি হলো ইমপ্রেস ভিডিও। ইমপ্রেস ভিডিও মানে হলো বিয়েশাদির অনুষ্ঠানের ভিডিও করা। দ্রুত এই ক্যামেরার চাহিদা বেড়ে হয়ে গেল। ডিমান্ডটা ক্রমেই এমন পর্যায়ে গেল যে আমাদের ক্যামেরার শিডিউলের ওপর বিয়ের দিন-তারিখ ঠিক হতো।
যখন বিটিভি থেকে আমাকে বের করে দেওয়া হলো, তখন বন্ধুমহলে চরম তাগিদ অনুভূত হলো, আমাকে কাজ দিয়ে চালু রাখার। তখনই সাগরসহ সবার তাগিদে ও আগ্রহে প্রতিষ্ঠিত হলো ইমপ্রেস টেলিফিল্ম লিমিটেড।
১৯৯৯ সালে চ্যানেল আই তৈরি হওয়ার আগে এটিএন বাংলা শুরু হয়ে গেছে। আজ প্রায় ২৫টি স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল। প্রতিটি চ্যানেলে লক্ষ করলে দেখা যাবে, ক্যামেরার পেছনে যে লোকগুলো কাজ করছেন, লাইটের পেছনে যে লোকগুলো কাজ করছেন, যাঁরা নেপথ্যের টেকনিক্যাল অন্যান্য কাজ করছেন, তাঁদের বেশির ভাগই ইমপ্রেস ভিডিও বা সানমুন ভিডিও বা ইমপ্রেস টেলিফিল্ম বা চ্যানেল আইয়ের লোকজন। তাঁরা বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে আছেন। কাজ করছেন। গোড়ায় প্রায় সবাই কিন্তু এখান থেকেই তৈরি হয়েছিলেন।
এ দেশে চ্যানেলগুলো গড়ে উঠেছে যেভাবে, যেভাবে ইন্ডাস্ট্রির অবয়ব ধারণ করেছে, সেটা বিদেশিদের জন্য নিঃসন্দেহে গবেষণা করার মতো বিষয়। এ এক আশ্চর্য বিপ্লব। বিপ্লবটা ঘটেছে ধীরে ধীরে, নীরবে।
সত্যিকার অর্থে কিছু একনিষ্ঠ, মেধাবী, পরিশ্রমী ছেলে নিজের চেষ্টায় গড়ে উঠেছেন, কাজ করছেন বিভিন্ন চ্যানেলে। তাঁরা এইট্টি পার্সেন্ট। পাশাপাশি আজকাল দেশে-বিদেশে একাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ড নেওয়া কিছু ছেলেও তৈরি হয়েছেন, যাঁরা এডিট করছেন, অ্যানিমেশন করছেন, সিনেমাটোগ্রাফি করছেন। এই নতুন প্রজন্মটাই আমাদের মিডিয়ার ফিউচার। যাঁরা সত্যিকার অর্থে তত্ত্বীয়ভাবে কাজটা বোঝেন।

দ্রুত প্রযুক্তির উন্নয়নের কারণে
১৯৯৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এটিএন বাংলা। আমরা অনেকে বলি, এটিএন বাংলা বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইট চ্যানেল। তথ্যটা ভুল নয়। তবে এর আগে তিন মাসের জন্য আরেকটা বাংলা চ্যানেল এ দেশেই অন এয়ারে ছিল। সেটা ছিল আজিজ মোহাম্মদ ভাইের 'এটিভি' টেলিভিশন। যেটি সিঙ্গাপুর থেকে সম্প্রচার হতো।
এরপর এটিএন বাংলা শুরু হলো। এটিএন বাংলার কর্ণধার ডক্টর মাহফুজুর রহমান অসম্ভব সাহসী একজন মানুষ। তিনি ছিলেন মূলত একজন পোশাকশিল্পের ব্যবসায়ী। তাঁর প্রধান বিজনেসটা ছিল গার্মেন্টের। তিনি এমন একজন মানুষ, যিনি তখনো মিডিয়া সম্পর্কে স্পষ্ট করে তেমন কিছু জানেন না। মুম্বাইয়ে গিয়ে এটিএন বাংলার সম্প্রচারের অনুমতি নিয়ে এলেন। ভারতে তখন এটিএন নামে একটা চ্যানেল চলত। জিটিভির পাশাপাশি আমরা দেখতাম। এন্টারটেইনমেন্ট টেলিভিশন চ্যানেল। ওটারই একটা পার্ট, বাংলাদেশ পার্ট আনা হলো। নাম দেওয়া হলো এটিএন বাংলা। ওই সময়টায় আমাদের ইমপ্রেস টেলিফিল্মের অনুষ্ঠান নির্মাণ শুরু হয়ে গেছে জোরেশোরে। তখনকার বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্রোগ্রাম ম্যানেজার প্রয়াস জিয়া আনসারীর মাধ্যমে মাহফুজুর রহমান সাহেব একদিন ঘটা করে আমাদের অফিসে এলেন। সাগর আর আমার সঙ্গে মিটিংয়ে বসলেন। বললেন, 'আমি তো এ রকম একটা জিনিসের লাইসেন্স নিয়ে এসেছি, কিন্তু আমার অনুষ্ঠান নির্মাণ সম্পর্কে বিশেষ কোনো ধারণা নেই। আপনারা বিটিভি থেকে সারা জীবন এগুলো করে এসেছেন। কাজেই চলেন, আমরা যৌথভাবে কাজটা শুরু করি।' সেই মিটিংয়ের পাশেই ছিলেন হুমায়ূন আমহেদ। নাটকের এডিটিংয়ের ফাঁকে তিনি কথাগুলো শুনছিলেন। নতুন একটি টেলিভিশন চ্যানেল আসছে, কাজের ক্ষেত্র তৈরি হবে, বিটিভির একঘেয়ে আধিপত্য থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে বুঝে তিনি খুবই আশাবাদী হলেন।
আমরা বিনয়ের সঙ্গে মাহফুজ সাহেবকে জানালাম, আমরা এখনই প্রোগ্রাম অন এয়ার বিজনেসের সঙ্গে সরাসরি জড়াব না, আপনিই করেন। আমরা পেছনে থাকব। আমাদের দিক থেকে সব ধরনের সহযোগিতা থাকবে। তিনি ওকে করে চলে গেলেন। আমরা বিটিভির পাশাপাশি তাঁর চ্যানেলের জন্যও অনুষ্ঠান বানাতে লাগলাম।
কিন্তু যে মানুষটি এই চ্যানেল চালানো সম্পর্কে তখনো সেভাবে কিছুই জানেন না, আজ সেই তিনি দুটো চ্যানেল সাফল্যের সঙ্গে চালাচ্ছেন। তাঁর আরো একটি চ্যানেল আসছে। 'বিজয়' চ্যানেলটাকে তিনি বিশেষ অনুষ্ঠানের চ্যানেল হিসেবে চালাবেন। এই যে একজন অন্য বিজনেসের লোক, সাহস করে এগিয়ে এসেছিলেন, একটা টেলিভিশন চ্যানেল তৈরি করেছিলেন, এত লোকের কর্মসংস্থান করেছেন, এটা নিঃসন্দেহে একটা বিশাল ঘটনা।
শুরুতে এই মাহফুজ সাহেবের এটিএন বাংলার পুরো কাজই কিন্তু হতো ইমপ্রেস টেলিফিল্মে, আমাদের প্রোডাকশন হাউস থেকে। তখন এটিএন বাংলা রান করত ব্যাংককের থাইকম স্যাটেলাইট থেকে। এক ঘণ্টা বিশ মিনিট ডিউরেশনের চারটা টেপ কম্পাইল হয়ে ব্যাংকক চলে যেত। টেপের কম্পাইলেশন, প্রোগ্রাম প্ল্যানিং, প্রোগ্রাম মেকিং_সব হতো ইমপ্রেস টেলিফিল্মে। এটিএন বাংলার পক্ষ থেকে সে সময় সার্বক্ষণিক আমাদের সঙ্গে থাকতেন সরকার ফিরোজ, বাংলাদেশ টেলিভিশনের সাবেক প্রেজেন্টেশন কন্ট্রোলার। একই সঙ্গে বিটিভির প্যাকেজের আওতায় কেনা ৮০ শতাংশ অনুষ্ঠান আমরা বানাই। অনেকের হয়তো মনে থাকতে পারে সেই সময়ের প্রেক্ষাপট।
বিটিভির নিজস্ব প্রোডিউসার্স অ্যাসোসিয়েশন, ওয়ার্কার্স অ্যাসোসিয়েশন অনেক দেন দরবার করল। কেউ কেউ অনেক গণ্ডগোল করল। প্যাকেজ অনুষ্ঠান নিয়ে বড়সড় বিদ্রোহ হলো। তাদের কথা_ইমপ্রেস টেলিফিল্মের প্রতি সপ্তাহেই নাটক থাকবে কেন? কোন বিশেষ 'ক্যারিশমা' রয়েছে তাদের?
পরে তাদের বোঝানো হলো, প্রতিদিনই বা প্রতি সপ্তাহেই ইমপ্রেস টেলিফিল্মের অনুষ্ঠান বা নাটক থাকার কারণ হলো_আপনি একজন প্রোডিউসার বা ডিরেক্টর যেখানে একটি অনুষ্ঠান জমা দিচ্ছেন, সেখানে ইমপ্রেস জমা দিচ্ছে দশটা। কারণ আপনি যখন একটা অনুষ্ঠান বানাচ্ছেন, ইমপ্রেস তখন বানাচ্ছে দশজনকে দিয়ে দশটা। ইমপ্রেস তো একটা প্রোডাকশন হাউস, একজন নির্মাতা নয়। তাই অটোমেটিক্যালি সিরিয়ালি তারটাই থাকবে বেশি। সেই কঠিন বাস্তবতা মেনে নিতে তখন কষ্ট হচ্ছিল অনেকেরই।
আমাদের ঘর তখন প্রতিদিন নানা কিসিমের প্রোডাকশনে ভরে যাচ্ছে। দেশের প্রায় সব সেরা নির্মাতা আমাদের প্রোডাকশন বানাচ্ছেন। এ রকম করতে করতে দেখা গেল, আমাদের প্রোগ্রাম ব্যাংক দিনের পর দিন বিশাল আকার নিল। যদি প্রোডাকশন হাউস চালু রাখতে হয় তবে আমাদের প্রতিদিনই প্রোগ্রাম অন এয়ার দিতে হবে, নয়তো এগুলো গোডাউনের আলু কিংবা মরিচা ধরা মেশিনে পরিণত হবে। তখন মনে হলো, এবার আমাদের একটি প্রাইভেট টেলিভিশন চ্যানেল শুরুর সময় এসেছে। এবার আমাদের প্রস্তুতি নেওয়া দরকার। আমাদের হাতে তত দিনে কয়েক শ ঘণ্টার প্রোগ্রাম মজুদ।

চিন্তাটা ১৯৯৭-৯৮ সালের...
এটিএনের ভেতরেই এক ঘণ্টার একটা চাংক আমরা মাহফুজ ভাইয়ের কাছ থেকে আলাদা করে কিনে নিলাম। ওই চাংকটার আমরা নাম দিলাম ইমপ্রেস টিভি টাইম। এর মানে, প্রতিদিন সন্ধ্যা ৭টার সময় একটা কার্ড আসবে টিভি চ্যানেলে_ইমপ্রেস টিভি টাইম। মানে একটা টেলিভিশন চ্যানেলের ভেতরে অন্য একটা টেলিভিশন। এই এক ঘণ্টার চাংককে আমরা আমাদের মতো সাজিয়ে নিলাম। প্রথমে একটা গ্রাফিঙ্ আসবে। এরপর একজন এনাউন্সার আসবেন। তিনি ইমপ্রেস টিভি টাইমে সবাইকে স্বাগত জানাবেন। এরপর অনুষ্ঠানগুলোর সামারি আসবে। এরপর ১০ মিনিট ২০ মিনিট করে একেকটা প্রোগ্রাম প্রচারিত হবে। সব শেষে আবার একটা গ্রাফিঙ্ দিয়ে ইমপ্রেস টিভি টাইমের সমাপ্তি।

প্রোগ্রামের জন্য স্টুডিও তৈরি
এটার জন্য তখন আমরা একটা স্টুডিও তৈরি করেছিলাম। আমাদের পার্টনার পারভেজের বাসাবোর বাসা খালি হয়ে গেল। ওরা সপরিবারে মিন্টো রোডে এল। ওই খালি বাসার ড্রইংরুমটিকে আমরা সাজিয়ে নিলাম স্টুডিও হিসেবে। সেখানেও ঘটল আরেক বিপত্তি। পাশ দিয়ে জোরালো শব্দে বেবিটেঙ্ িযায়। টেম্পো যায়। সারা দিন টেম্পোর শব্দের ফাঁকে আমরা শুটিং করতাম। দিস ইজ দ্য হিস্ট্রি অফ ইমপ্রেস টিভি। যার নতুন নাম_চ্যানেল আই।
১৯৯৯ সালের ১ অক্টোবর। এ যাবৎকালে বাংলাদেশে যত চ্যানেল হয়েছে, তার মধ্যে একমাত্র চ্যানেল যে সম্প্রচারের দিন-তারিখ পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী ঠিক রেখেছিল। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী বিকেল ৫টায় ট্রান্সমিশন স্টার্ট করল। বাংলাদেশের, বাংলা ভাষার প্রথম ডিজিটাল বাংলা চ্যানেল। সেই সময়টির কথা মনে এলে এখনো ভেতরটা শিউরে ওঠে। অদ্ভুত এক অনুভূতি। প্রথম সিজিটি পর্দায় ভেসে উঠতেই সে সময়ের চ্যানেল আই পরিবারের সবার আনন্দে চোখে পানি এসে যায়। খুব মনে আছে, সেদিন প্রথম শুভেচ্ছা জানাতে এসেছিলেন অভিনয়শিল্পী নিমা রহমান।
কিন্তু শুরু করলেই তো হবে না। হাতে শুধু প্রচুর নতুন প্রোডাকশন থাকলেও চলবে না। একটা চ্যানেল নন স্টপ চালিয়ে নিয়ে যেতে হলে চাই নূ্যনতম অবকাঠামো।
সেই কুটির শিল্পের অবকাঠামোর মধ্যে আমাদের পুঁজি কেবল নিরলস পরিশ্রম, সাহস আর সৃজনশীলতার শক্তি। একটা ১৭০০ স্কয়ার ফিটের বাড়ি থেকে, একটা রেসিডেনশিয়াল অ্যাপার্টমেন্টের ভেতর থেকে একটা টেলিভিশন চ্যানেলের আত্মপ্রকাশ। আমাদের হাত ধরেই সেই ইতিহাসের রচনা হলো। ৬২/এ সিদ্ধেশ্বরীর ঠিকানায়। প্রথম দিন থেকেই ২৪ ঘণ্টা প্রচার।

ট্রান্সমিশন প্ল্যানিং
আমাদের প্রথম পরিকল্পনায় ছিল, আমাদের প্রথম চাংক হবে আট ঘণ্টার টাটকা অনুষ্ঠান। মানে আমাদের এটিএনের জন্য তৈরি ইমপ্রেস টিভি টাইমের এক ঘণ্টার বদলে আট ঘণ্টার একটা ক্যাপসুল বানাতে হবে। এর ভেতরে গান, নাচ, নাটক_সব থাকবে। আট ঘণ্টার একটা কিউশিট। এই কিউশিট অনুযায়ী আমাদের অনুষ্ঠান চলবে। অনুষ্ঠান চলবে আট ঘণ্টার। এই আট ঘণ্টার ট্রান্সমিশনটা আমরা সিঙ্গাপুরে পাঠাব। পাঠাব আট ঘণ্টার টেপ। একদম সিরিয়ালি টেপ। রাত ১টায় আমাদের শেষ ট্রান্সমিশন। এরপর ৫টায় যে ট্রান্সমিশনটা শুরু হয়েছিল, সেটা আবার রিপিট হবে। আট ঘণ্টা। সকাল ৯টায় সেকেন্ড রিপিট টেলিকাস্ট শেষ। ঠিক বিকেল ৫টায় শেষ। আবার নতুন দিনের নতুন ট্রান্সমিশনের যাত্রা। অর্থাৎ এই আট ঘণ্টাকে দুবার রিপিট করে সেই ২৪ ঘণ্টা।

বিদেশে পাঠাতে হতো, কেন?
বাংলাদেশে তখনো কোনো আপ লিংকের ব্যবস্থা নেই। ফরেন স্যাটেলাইটগুলো হায়ার করে আমরা ব্যবহার করতাম। তখন আমাদের নিজস্ব স্যাটেলাইট বুকিং দেওয়ার সিস্টেম ছিল না। একটা বিদেশি স্যাটেলাইট হায়ার করে ওই পোর্টটাতে আপ করে দিতে থাকলাম। এরপর ওটা ডাউনলিংক হয়ে ডিস্ট্রিবিউট হতে থাকল ওয়ার্ল্ড ওয়াইড। ফুটপ্রিন্ট অনুযায়ী।
তখনো পর্যন্ত বাংলাদেশ গভর্নমেন্ট এখান থেকে এসএনজি পারমিশন দেয়নি। মানে এ দেশের মাটি থেকে অনুষ্ঠান আপলিংক এবং ডাউনলিংকের সুবিধার ব্যাপারটার কথা বলছি।
পরিকল্পনার শুরুতে আমাদের আরো যাঁরা পার্টনার আছেন আবদুর রশীদ মজুমদার, জহিরউদ্দিন মাহমুদ মামুন, মুকিত মজুমদার বাবু, রিয়াজ আহমেদ খান, এনায়েত হোসেন সিরাজ, রবিউল ইসলাম, ফরিদুর রেজা সাগর ও অমি, সবাই মিলে একাধিক মিটিং হলো। রুদ্ধদ্বার বৈঠক হলো। নানা দিক ভেবে দেখা হলো। ভাবা হলো, আদৌ আমরা পারব কি না, পারলেও এখনই যাওয়া ঠিক হবে কি না, গেলেও কিভাবে আমরা যাব, স্যাটেলাইট ভাড়া কত আসবে? শেষমেশ আমরা তা সামাল দিতে পারব কি না। এসব নিয়ে দীর্ঘ আলোচনার পর ঠিক হলো_আমরা করব।
এই বাংলাদেশ জন্ম লাভ করার পেছনে তরুণদের একটা বিশাল অবদান। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বর থেকে শুরু করে রাজনীতির মাঠে। মুক্তিযুদ্ধে। দেশগড়ার নবচিন্তায়। সবখানে। বাংলাদেশের ব্যবসায়িক অঙ্গনেও আমরা যদি বলি, তারুণ্যের প্রচণ্ড একটা শক্তি কাজ করেছে। তারুণ্যের সেই সৃজনশীল স্পর্শ বাকি ছিল কেবল ইলেকট্রনিক মিডিয়ায়।
কিন্তু ইলেকট্রনিক মিডিয়া এমনই একটা প্রযুক্তিগত দিক, যার জন্য একটা নূ্যনতম একাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ড থাকা প্রয়োজন। প্রয়োজন পূর্ব অভিজ্ঞতার। কারো সেসব নেই। আমাদের ক্যাপিটাল যা ছিল সেটা হলো, ছোটবেলা থেকে দীর্ঘ সময় বাংলাদেশ টেলিভিশনে কাজ করার ধারাবাহিক অভিজ্ঞতা। ব্যাপারটা তো এমন নয় যে ১০টা গার্মেন্ট দেখে এসে আরেকটা গার্মেন্ট তৈরি করছি আমরা। এমনও নয়, এ দেশে একটা-দুটো প্রাইভেট টেলিভিশন আগে তৈরি হয়েছিল, সেই ফর্মেট অনুসরণ করে শুরু করে দিলাম।

কিভাবে হবে তাহলে?
সাগর আর আমি বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচুর অনুষ্ঠান তৈরি করেছি। কিন্তু ওখানে তো বিশাল স্টুডিও। এত বড় স্টুডিও আমরা কিভাবে বানাব? খরচ করার অর্থ কই? বানানোর জায়গা কই? ওদিকে থেমে যাওয়ারও উপায় নেই।
গালে হাত দিয়ে বসে থাকলেও চলবে না। ডিসিশন লকড হয়ে গেছে, উই আর গোয়িং ফর আ নিউ টেলিভিশন চ্যানেল...। অতএব, শুরু তো করে ফেলতে হবে। অ্যাপার্টমেন্টের বেডরুমকে স্টুডিও বানিয়ে, বাথরুমকে এডিটিং প্যানেল বানিয়ে, স্টোররুমকে আর্কাইভ বানিয়ে এবং কিচেনকে মেকআপরুম বানিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু হলো।
এরও আগে আরেকটা চিন্তায় আমরা ব্যতিব্যস্ত হলাম। আমাদের স্বপ্নভরা চ্যানেলের নাম কী হবে? চ্যানেলের তো একটা জুতসই নাম লাগবে। অথচ নামের বিষয় নিয়ে আমরা শুরুতে কেউই মাথা ঘামাইনি, আমাদের পার্টনাররা কেউই ভাবেননি। কিন্তু আমি শিওর, বিষয়টা সাগরের মগজের ভেতর প্রথম থেকে একটা সুপ্ত বীজ হিসেবে ছিল। আগে থেকেই সে নিজে কনসিভ করে রেখেছিল আইডিয়াটা। তারপর প্রথমেই এসে আমার সঙ্গে আলোচনা করল যে এটা হতে পারে কি না।
হঠাৎ করে সে বলল কী..., 'সিরাজ_চ্যানেল আই।' একবারেই বলল নামটা।
বলেই আবার কিছক্ষণের জন্য চিন্তায় পড়ে গেল।
কেননা, আমরা তো বাংলার পূজারি। বাংলা আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা। মাতৃভাষার সূত্র ধরে স্বাধীনতা। দুজন আবারও আলোচনা শুরু করলাম। ভাবছিলাম, ইংরেজিটা মানুষ কিভাবে নেবে?
আমি ওকে প্রশ্ন করলাম। ও আমাকে প্রশ্ন করল। সমাধানে আর আসতে পারি না।
আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে, আমিই ওকে হুট করে বলে ফেললাম 'নেবে...। এই নামটা দর্শক নেবে। যদিও ইংরেজি, কিন্তু নামটার ভেতর একটা প্রচলিত স্মার্টনেস আছে।'
সুন্দর হবে। পার্টনাররা সবাই জানিয়েছেন, আমাদের সবকিছুর মধ্যে যেন বাংলাদেশ বিষয়টা আসে। পারভেজ বলছিল, লাল-সবুজ বিষয়টাকে মাথায় রাখার কথা।
'আই' শব্দটার অনেক রকম ব্যাখ্যা দাঁড় করলাম আমরা। সাগর বলল, 'আই' মানে হচ্ছে তোমার করপোরেট আই। 'আই' মানে হচ্ছে ইমপ্রেস গ্রুপের প্রথম অক্ষর 'আই'। আবার 'আই' মানে 'আমি'। 'আই' মানে 'চোখ'। 'আই' মানে 'ভিশন'। তো এরকম অনেক ব্যাখ্যা দাঁড়িয়ে গেল। আমরা এটা ম্যানেজিং বোর্ডে উপস্থাপন করলাম। অন্য অনেক মতামত, মতভেদ থাকার পরও আমাদের যুক্তি শুনল সবাই মন দিয়ে। সবশেষে সবাই বলল 'হ্যাঁ, এটা ভালো, স্মার্টনেস আছে।'
দায়িত্ব পড়ল আমার ওপর, জিনিসটার লোগো কেমন হবে? লোগো করিয়ে নেওয়া, সেটা ম্যাচিওর করে বোর্ডে উপস্থাপন_সব আমাকে করতে হবে ফাইনাল হলো।
আলোচনাক্রমে এই লোগো তৈরির দায়িত্বটা গেল রম্য রহিম নামে একজন আর্কিটেক্টের কাছে। কম্পিউটার গ্রাফিঙ্ েঅসম্ভব মেধাবী ও গুণী এক তরুণ। তিনি এখন লন্ডনে, সনির সঙ্গে কাজ করেন। রম্য রহিমের সঙ্গে দিনের পর দিন বসলাম। আমাদের থিমটা তাঁকে বোঝালাম। এই রকম একটা লোগো। খুব সহজ কাজ নয়।
তখন রহিম অনেক সময় নিয়ে_প্রায় দুই মাস সময় নিয়ে কিছু ডিজাইন তৈরি করলেন। এরপর নিয়ে এলেন আমাদের কাছে। ইমেজগুলোর কালার ফটোকপি করে নিয়ে এলেন। তখন আমাদের ইমপ্রেস টেলিফিল্মের কর্মব্যস্ততা কিন্তু চলছে। পাশাপাশি চ্যানেল আই অন এয়ারের প্রস্তুতি। অনুষ্ঠান তৈরি শুরু হয়ে গেছে, শুরু হয়ে গেছে নাটক তৈরি।
তো ডিজাইনগুলো যখন আমার কাছে রহিম নিয়ে এলেন, তখন সেগুলো আমি আবারও একাধিক কালার ফটোকপি করালাম। তখন আমাদের হাউসে যেসব গুণীজন অনুষ্ঠান বানাচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদও আছেন, ওই সব প্রডিউসার, ডিরেক্টরের হাতে হাতে ফটোকপিগুলো ধরিয়ে দিলাম। বললাম, 'ধরেন, এই শিটে ৫টা লোগো আছে, লোগোগুলোর উল্টোদিকে আপনি পছন্দের টিক চিহ্ন দেবেন।

সেটি ১৯৯৮ সালের কথা
এভাবে দেখলাম কোনটার দিকে বেশি ভোট পড়েছে। এরপর সেগুলো কম্পাইলেশন করে বাকিগুলো ছাঁটাই করে আমি আর সাগর ফাইনাল বোর্ড মিটিংয়ে সাবমিট করলাম। বললাম, এই লোগোগুলো আছে আমাদের কাছে, এর মধ্যে কোনটা আমরা গ্রহণ করব?
লোগোটিতে প্রথম আমরা কী কনসিভ করেছিলাম? যে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করে একটা দেশ স্বাধীন করেছি। এখানে আমার ভাষা, আমার দেশাত্মবোধ_অনেক বিষয় আছে। ভাষার জন্য যুদ্ধ করে একটা জাতি স্বাধীন হয়েছে। আমার গ্রাম, আমার অর্থনীতি, আমার শক্তি_আমার রং। আমার সূর্যের রং, আমার পতাকার রং_বাংলাদেশের পতাকা, লাল-সবুজের পতাকা। বাংলাদেশের পতাকার ভেতর একটা সূর্য আছে, লাল সূর্য_আমার রক্তের মতো, আমার রক্তঝরা স্বাধীন বাংলাদেশ। আর সবুজ প্রান্তর, আমার বাংলাদেশ। আমার শস্যের প্রতীক, আমার ফসলের গান, আমার বাংলাদেশ। বোর্ডে ওই লোগো প্রেজেন্ট করলাম এবং সবাই একসেপ্ট করলেন। একসেপ্ট করার পর আমরা ঠিক করলাম, সামনে আমাদের আরো একটা বড় কাজ বাকি। সেটা কী? মানে আমাদের কেব্ল্ অপারেটর ভাইদের কাছে পেঁৗছাতে হবে, হতে হবে তাঁদের আপন মানুষ। তাঁদের মাধ্যমেই তো এখনো আমি-আপনি স্যাটেলাইট টেলিভিশন দেখতে পাই। তাঁদের সঙ্গে আমাদের কখনোই কোনো প্রাতিষ্ঠানিক মিটিং হয়নি। আমাদের একটা সেতুবন্ধন হওয়া দরকার। তাঁরা আমাদেরই একটি বড় পার্ট। তাঁদের সঙ্গে তো সেই মিটিংয়ের জন্য আমরা সারা দেশের মোট ৫০০ কেব্ল্ অপারেটরকে একসঙ্গে ডাকলাম। ১ অক্টোবর চ্যানেল আই লঞ্চ করবে। ১৯৯৯ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর শেরাটন হোটেলের উইন্টার গার্ডেনে আমরা তাঁদের আমন্ত্রণ জানালাম। ৫০০ নয়, কেব্ল্ অপারেটরদের সঙ্গে অতিথি হিসেবে এসেছিলেন আরো ৩০০ জন। শেষ পর্যন্ত মোট ৮০০ জনের ব্যবস্থাই করা হলো। রাতে আমাদের সঙ্গে মিটিং হবে, ডিনার হবে। পাশাপাশি 'হোয়াট ইজ চ্যানেল আই'_বিষয়ে একটা ভিডিও প্রেজেন্টেশন হলো। উইন্টার গার্ডেনের ওই মেগা স্ক্রিন প্রেজেন্টেশনে কেব্ল্ অপারেটরদের সঙ্গে সিঙ্গাপুরের অ্যাপস্টার টু আর স্যাটেলাইট স্টেশন থেকে ভিডিওতে সরাসরি কথা বলেন আব্দুন নূর তুষার। মনে আছে, সেখানে কেব্ল্ অপারেটরদের জন্য দেওয়া হয় একটি কুইজ। একটি রোমিং নম্বরে ফোন করে যে সবচেয়ে আগে আব্দুন নূর তুষারের সঙ্গে কথা বলতে পারবেন, তাঁকেই দেওয়া হবে ঢাকা-সিঙ্গাপুর-ঢাকা এয়ার টিকিট। সেটি কেব্ল্ অপারেটরদের জন্য ছিল বিস্ময়কর এক ব্যাপার এবং সেই ধারাবাহিকতাতেই তৃণমূল পর্যায় থেকে এই চ্যানেলকে এ পর্যন্ত কেব্ল্ অপারেটররা সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছেন।
১ অক্টোবর শুরু হলো অন এয়ার। আমাদের প্রাণ যায় যায় অবস্থা। ২৪ ঘণ্টা একটা চ্যানেলকে চলমান রাখা, তাকে অনুষ্ঠান দিয়ে ভরপুর রাখা চাট্টিখানি কথা নয়। সারা দিন সারা রাত কাজ করতাম। আমরা হয়তো এক সকালে বাসা থেকে অফিসে আসতাম, তিন দিন পর বাড়ি ফিরতাম। মনে হতো কাজে যত আনন্দ, শরীরে ততটাই কষ্ট। এর ভেতরেই সাগর দৌড়াদৌড়ি করছে সিঙ্গাপুর। কারণ আমাদের স্যাটেলাইট তখন ছিল সিঙ্গাপুর। ব্যাংককে স্যাটেলাইটের সঙ্গে কথা চূড়ান্ত ছিল। হঠাৎ তারা চুক্তিভঙ্গ করায় চলে গেলাম সিঙ্গাপুর স্যাটেলাইটে। অ্যাপস্টার টু আর স্যাটেলাইট।
আমাদের ভিশন ছিল, সেই বিটিভির সঙ্গে আমাদের তফাত অনেকটা থাকতে হবে। পর্দাটাকে অলওয়েজ চকচকে-ঝকঝকে রাখতে হবে। রাখতে হবে গতিময়। মানে দর্শককে সঙ্গে রাখতে চোখের পলকে খেলতে হবে সবকিছু। দর্শককে আটকে রাখতে হবে রিমোট কন্ট্রোলে। এসব ইকোয়েশন মাথায় রাখতাম সবসময়।

চোখ যাতে না সরে
একটা বিশেষ দৃশ্যের জন্য, তিন মিনিট ধরে ধারণ করা হয়েছে একটা দৃশ্য। সে দৃশ্যের সঙ্গে মানুষ মোহিত হয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সেটা এক জিনিস। সেটা একটা ফিল্মে থাকতেই পারে। কিন্তু টেলিভিশনে প্রতি তিন সেকেন্ডে শট না কাটলে ঝুলে যাবে। আর সেই শটের সঙ্গে সারফেস, মিউজিক সবকিছু যদি এভাবে কোয়ালিটি থাকে, তাহলেই মানুষ দেখবে। নয়তো না। আর গ্ল্যামারাস হতে হবে। পর্দা হতে হবে চকচকে । হতে হবে ঝকঝকে।
তখনো পর্যন্ত বাংলাদেশ টেলিভিশনে অ্যানিমেশন জিনিসটা আসেনি। সেই অ্যানিমেশন আছে কোথায়? আছে ফরেন চ্যানেলগুলোতে। ফরেন চ্যানেলগুলো তখন বাংলার ঘরে ঘরে। মানুষ জিটিভি দেখে। তো ওই যে রম্য_যে রম্য চ্যানেল আইয়ের লোগো বানিয়ে দিল, সেই রম্য খুব ভালো অ্যানিমেশন বানাতে পারত। অসম্ভব ভালো অ্যানিমেটর। রম্যর করা বেশ কিছু অ্যানিমেশন প্রচার শুরু হলো। ওইসব স্মার্ট সিজিগুলো এখনো চ্যানেল আইতে প্রচারিত হয়। মিউজিক পিস হলো একটা। ১৮ সেকেন্ডের মিউজিক পিস। চ্যানেল আইয়ের আইডেনটিটি পিস। যেটা হচ্ছে ইনসিগনিয়া। ৫টার সময় চ্যানেল আই যে শুরু হবে, শুরু হবে এই ইনসিগনিয়া বাজিয়ে।

কিভাবে এই ইনসিগনিয়া?
ইনসিগনিয়ার মিউজিক তৈরি করালাম শিল্পী আইয়ুব বাচ্চুকে দিয়ে। যেটা আজও চলে। ও দীর্ঘদিন, প্রায় এক-দেড় মাস কাজ করে মিউজিক পিসটা তৈরি করল। যথেষ্ট শ্রম দিয়েছে। মানে তখন যে মানুষগুলো কাজ করেছে চ্যানেল আইয়ের সঙ্গে, যে আমাদের সঙ্গে কাজ করেছে, কনট্রিবিউট করেছে, তার ভেতরও এটা ছিল যে আমাদের দেশে নতুন একটা চ্যানেল আসছে। একটা ভালো চ্যানেল আসছে। ওই ফোর্সটা কাজ করছিল সবার ভেতর।
তো সেই ইনসিগনিয়া তৈরি হলো, অ্যানিমেশন তৈরি হলো। প্রোগ্রাম তো থাকবেই। গানের প্রোগ্রাম, নাচের প্রোগ্রাম, নাটক, টকশো এবং নিরীক্ষাধর্মী প্রোগ্রাম হবে। টেলিভিশনে যা কিছু নতুন এ যাবৎকালে বাংলাদেশে হয়েছে, চ্যানেল আই-ই প্রথম করেছে। বিশেষ দিন মানেই চ্যানেল আই। সাত দিনব্যাপী অনুষ্ঠান, অমুক আয়োজনে তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠান_সবকিছু চ্যানেল আইয়ের 'ব্রেইন চাইল্ড'।
তো এরকম একটা পরিস্থিতিতে, ইনসিগনিয়া তৈরি হলো। সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে, সেই ১৯৯৯ সালে রম্য রহিম সিজি বানালেন, ইনসিগনিয়াটা তৈরি করল বাচ্চু। আজকে ২০১১ সাল, এই সময়ের ভেতর আমি এত স্মার্ট, এত অর্থবহ, এত কালারফুল ইনসিগনিয়া দেখতে পাই না।
একটা নতুন চ্যানেল দ্রুততার সঙ্গে সাফল্য নিয়ে এগোতে থাকল। কিন্তু এর পরও আমাদের চিন্তা থামল না। থেমে গেল না। আমরা ভাবলাম, একটা চ্যানেলে গান যাবে, নাটক যাবে, অনুষ্ঠান যাবে, সংবাদ যাবে_ভালো কথা।... এগুলোতে মানুষ বিনোদন পাবে। কিন্তু একটা টেলিভিশন চ্যানেলের কি শুধু বিনোদন দেওয়াটাই দায়িত্ব? আর কোনো দায়িত্ব নেই? আছে, আরো অনেক দায়িত্ব আছে। তখন একটি নতুন চ্যানেল, বিজ্ঞাপনদাতারা আছে, তখন বিজ্ঞাপনদাতার সংখ্যা হাতেগোনা। লিভার ব্রাদার্স, কেয়া কসমেটিঙ্, স্কয়ার, হেনোলাঙ্, কিউট_এরা তখন বিজ্ঞাপনদাতা। চ্যানেল আইয়ের পর্দায় প্রথম বিজ্ঞাপন ছিল 'কনফিডেন্স সিমেন্ট'-এর। কনফিডেন্স সিমেন্টের মালিক কোন কনফিডেন্সে আমাদের প্রথম বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন, ভাবলে এখনো অবাক হই। তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা জাগে। তখন বিজ্ঞাপনের সংখ্যা কম। অনুষ্ঠানের ফাঁকে হাতে থাকত সময়। তাই আমরা চিন্তা করলাম, কিছু ফিলার বানাতে হবে। যে ফিলারগুলো আমাকে দেশাত্মবোধ শেখাবে। যে ফিলারগুলো আমাদের বুদ্ধিবৃত্তি পরিষ্কার রাখবে। যে ফিলারগুলো আমাদের মাদকাসক্তি থেকে দূরে রাখতে সহায়তা করবে। মানুষের প্রতি দায়িত্ববোধ শেখাবে।
এরকম প্রচুর ইস্যু মাথায় নিয়ে ফিলার বানালাম। এগুলো মাঝেমধ্যে অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে যেতে থাকল। ফিলার শেষে ভেসে আসত 'জনস্বার্থে চ্যানেল আই'। যেগুলো বাংলা টেলিভিশন চ্যানেলে কেউ কোনো দিন দেখেনি।
এই অতিক্রমের পথ যেমন অমসৃণ, বন্ধুর, কষ্টের, ততটাই আনন্দের।
আমরা চ্যানেল আই পরিবারের প্রতিটি অহংকারী সদস্য নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করে, আনন্দময় ইতিহাস তৈরি করে ১২ বছর অতিক্রম করেছি। অতিক্রম করতে চাই আরো অসংখ্য বছর। এই যে চ্যানেল আইয়ের জন্মের ইতিহাস, যত ইনোভেটিভ আইডিয়া_অধিকাংশই এসেছে সাগরের মাথা থেকে। বাস্তবায়ন করেছি সবাই মিলে।
প্রকৃতির নিয়মে একদিন আমরা থাকব না। থাকবে চ্যানেল আই। থাকবে চ্যানেল আইয়ের গর্বভরা সাফল্যের ইতিহাস।

No comments

Powered by Blogger.