স্বাস্থ্য খাতের নতুন পঞ্চবার্ষিক কর্মসূচি শুরুতেই পিছিয়ে by তৌফিক মারুফ

রকারের সদ্য গৃহীত স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি খাত উন্নয়ন কর্মসূচি (২০১১-১৬) নিয়ে শুরুতেই সংশয় দেখা দিয়েছে। এ কর্মসূচি বাস্তবায়নের পরিকল্পনা গত ২৩ আগস্ট একনেকে অনুমোদন পায়। বাংলাদেশে এটি এ খাতের জন্য তৃতীয় কর্মসূচি। আগের কর্মসূচির কার্যকারিতা শেষ হয়ে যায় গত ৩০ জুন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ১ জুলাই থেকে নতুন উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের কার্যক্রম শুরু হওয়ার প্রয়োজন ছিল। অথচ আগের কর্মসূচির মেয়াদ শেষ হওয়ার প্রায় দুই মাস পরে নতুনটি একনেকে অনুমোদন পেয়েছে মাত্র। এখন প্রস্তুতি গ্রহণ ও বাস্তবায়নকাজ শুরু করতে আরো দেরি হবে। এতে নির্ধারিত সময়সীমা পাঁচ বছরের মধ্যে অনেকটা সময় নষ্ট হবে।
নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক বিশেষজ্ঞ কালের কণ্ঠকে বলেন, দেশের স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি খাতের সার্বিক কার্যক্রম পরিচালনা ও উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রতি পাঁচ বছরের জন্য পরিকল্পনা কর্মসূচি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন করছে সরকার। নতুন পঞ্চবার্ষিক স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি খাত উন্নয়ন কর্মসূচি প্রণয়নের কাজ শুরু হয় দুই বছর আগে। এর পরও প্রক্রিয়াটি এতটা পিছিয়ে থাকার কারণ বোধগম্য নয়। এমনকি
সরকার এখন পর্যন্ত বিশ্বব্যাংক ছাড়া অন্য কোনো দাতার কাছ থেকে অর্থ পাওয়ার নিশ্চিত প্রতিশ্রুতি পায়নি। এ খাতে দীর্ঘদিনের অর্থায়নকারী নেদারল্যান্ডস এবার কেন থাকছে না, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। অবশ্য এবার নতুন দাতার তালিকায় যুক্ত হয়েছে অস্ট্রেলিয়া সরকারের নাম।
কর্মসূচিতে দাতাদের অর্থায়ন সম্পর্কে খোদ স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী নিজেও জোরালো কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারেননি। সম্প্রতি ঢাকায় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ-২ সম্মেলন কক্ষে সরকার ও বিশ্বব্যাংকের মধ্যে একটি চুক্তি সই হয়। এতে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি খাত উন্নয়ন কর্মসূচি (এইচপিএনএসডিপি) বাস্তবায়নে ৩৫৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা দুই হাজার ৬৫৬ কোটি ৬০ লাখ টাকা ঋণ সাহায্য দেওয়ার অঙ্গীকার করে।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী ডা. আ ফ ম রুহুল হক সাংবাদিকদের বলেন, ২০১১-১৬ সালের এর জন্য এইচপিএনএসডিপির মোট ব্যয়ের মধ্যে বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী দেশ ও সংস্থা থেকে পাওয়া যাবে ১ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। বাকি অর্থ দেবে সরকার। বিশ্বব্যাংকের বাইরে অন্য দাতাদের মনোভাব সম্পর্কে জানতে চাইলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, 'বাকিরা পর্যায়ক্রমে চুক্তি করবে বলে আশা করছি।' তিনি ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত অন্যান্য দাতা সংস্থার প্রতিনিধিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে চুক্তি করার অনুরোধ জানান।
দাতাদের সহায়তার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা বাজেট পরিবীক্ষণ কার্যক্রমের পরামর্শক ডা. মুহাম্মদ আবদুস সবুর কালের কণ্ঠকে বলেন, 'তাদের অংশগ্রহণ ও অর্থায়ন না থাকায় দ্বিতীয় কর্মসূচির সময়ে প্রথম দুই বছর তেমন কোনো কাজ হয়নি। ফলে দ্বিতীয় কর্মসূচিতে শেষ পর্যন্ত টাকা খরচ করা নিয়ে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছিল। এতে অনেক অস্বচ্ছতার সুযোগ তৈরি হয়। পাশাপাশি নির্দিষ্ট মেয়াদের মধ্যে উদ্যোগগুলো বাস্তবায়ন করা যায় না।'
বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহম্মেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, আগের পঞ্চবার্ষিক কর্মসূচির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ইতিমধ্যেই কয়েক মাস চলে গেছে। নতুন এইচপিএনএসডিপি নিয়ে সরকারের যতটা গতিতে কাজ করা উচিত ছিল, সেটা হয়নি। এর ফলে দেশের স্বাস্থ্য খাতের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। তিনি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীলদের আরো সক্রিয় হওয়ার আহ্বান জানান।
স্বাস্থ্য ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দেশে প্রথম খাতভিত্তিক কর্মসূচি_স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা খাত কর্মসূচি (এইচএসএসপি) চলে ১৯৯৮ সালের জুলাই থেকে ২০০৩ সালের জুন পর্যন্ত। দ্বিতীয় খাতভিত্তিক কর্মসূচি_স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা খাত কর্মসূচি (এইচপিএনএসপি) চলে ২০০৩ সালের জুলাই থেকে ২০১১ সালের জুন পর্যন্ত। দ্বিতীয় কর্মসূচির বাস্তবায়নকাজ নানা জটিলতার কারণে পাঁচ বছরের জায়গায় আট বছর চলেছে। কাগজে-কলমে ২০০৩ সালের জুলাইয়ে কর্মসূচি শুরু হওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে কাজ শুরু হয় ২০০৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে।
তৃতীয় কর্মসূচির ক্ষেত্রে এমন পরিস্থিতি যাতে না হয় সে লক্ষ্যেই প্রায় দুই বছর আগে প্রাথমিক কাজ শুরু হয়।
২০০৯ সালের ৩১ আগস্ট একটি কারিগরি কমিটি গঠনের মাধ্যমে স্বাস্থ্য খাতের তৃতীয় খাতভিত্তিক কর্মসূচি প্রণয়নের কাজ শুরু হয়। পরে একই বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর আরেকটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি এবং ৪ অক্টোবর একটি কর্মসূচি প্রস্তুতি কোষ গঠন করা হয়। এ কাজের জন্য কমপক্ষে চারজন আন্তর্জাতিক পরামর্শদাতা ও চারজন দেশীয় পরামর্শক নিয়োগ করা হয়। আগের অভিজ্ঞতার আলোকে এবার ৩০ জুন দ্বিতীয় কর্মসূচির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে একনেকের বৈঠকে নতুন কর্মসূচি অনুমোদন দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির অনুমোদন পায় ২৩ আগস্ট। এরপর চলছে বাস্তবায়ন পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ। এসব পরিকল্পনা অনুমোদন করা হবে বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। এরপর কর্মসূচির প্রকৃত বাস্তবায়ন শুরু হবে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বর্তমান কর্মসূচির বাজেট ধরা হয়েছে পাঁচ বছরের জন্য ৫৬ হাজার ৯৯৩ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকার ৭৬ শতাংশ অর্থের জোগান দেবে। স্বাস্থ্য খাতের পরিবীক্ষণ বিশেষজ্ঞ ডা. মুহাম্মদ আবদুস সবুর কালের কণ্ঠকে বলেন, 'প্রচলিত ধারণা হচ্ছে, এত বড় কর্মসূচিতে দাতাদের প্রভাব অনেক বেশি। ক্ষেত্রবিশেষ দাতাদের মতামত চাপিয়ে দেওয়া হয় সরকারের ওপর। অথচ দেখা যাচ্ছে, বর্তমান কর্মসূচিতে সরকারের অর্থায়নই ৭৬ শতাংশ। দ্বিতীয় কর্মসূচিতে সরকারের অর্থায়ন ছিল ছিল ৭৩ শতাংশ এবং প্রথম কর্মসূচির প্রথম বছরে ছিল ৬৯ শতাংশ। যেখানে সরকারের অর্থায়ন সিংহভাগ, সেখানে দাতাদের প্রাধান্য বিস্তারের সুযোগ থাকার কথা নয়। অথচ সরকারের ব্যর্থতার সুযোগে অনেক ক্ষেত্রে দাতারা প্রাধান্য বিস্তার করে থাকে।'
ডা. মুহাম্মদ আবদুস সবুর বলেন, 'স্বাস্থ্য খাতে সরকারের অর্থায়ন বাড়াতে হচ্ছে মূলত রাজস্ব খাতের পরিধি বাড়ার কারণে। রাজস্ব খাতের অংশ বেড়ে যাওয়ার মূল কারণ জনবল ও তাদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি পাওয়া। আর রাজস্ব খাতের ভাগ ক্রমাগত বৃদ্ধি পেলে উন্নয়ন খাত সংকুচিত হয়। এদিকে যথাযথ নজর না দিলে উন্নয়ন কার্যক্রম বিঘি্নত হতে পারে। এসব ক্ষেত্রে শুরুতেই গুরুত্ব দেওয়া না হলে সামনে আরো হোঁচট খেতে হতে পারে। কর্মসূচির অনুমোদনপ্রক্রিয়া সময়মতো শেষ না করতে পারার কারণেও হোঁচট খেতে হয়েছে।'

No comments

Powered by Blogger.