তত্ত্বাবধায়ক নয়, ইসির অধীনে ভোটের প্রস্তুতি নিনঃ আশরাফ

ক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের (ইসি) অধীনে আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর প্রতি আহবান জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। তিনি বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার নয়, একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের অধীনে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তিনি আরো বলেন, 'আমাদের বিরোধী দল যদি মনে করে, নির্বাচনে অংশ নেবে না, ওনার (খালেদা জিয়া) দুই দুর্নীতিবাজ পুত্রের বিচার হবে না, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে না_তাহলে সফল হবেন না। আপনাদের এই আবদার সরকার মেনে নেবে না। নির্বাচন কমিশনের অধীনেই আগামী নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দল অংশ নেবে। আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে। আমাদের আগামী নির্বাচন বিশ্ববাসীর কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।'

ধানমণ্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে গতকাল বুধবার দুপুরে এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এসব কথা বলেন। আগের দিন চারদলীয় জোটের মহাসমাবেশে বিরোধীদলীয় নেতা ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া যে বক্তব্য দেন তার জবাব দিতেই আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আর প্রয়োজন নেই : আশরাফ বলেন, রাজনীতিবিদদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার সম্পর্কে গত দুই বছরের অভিজ্ঞতা ও আদালতের রায় প্রমাণ করে বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আর প্রয়োজন নেই। তিনি বলেন, 'আমরা মনে করি, সরকার সম্পূর্ণভাবে নির্বাচন কমিশন থেকে দূরে থাকুক; তাহলেই অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে।'
স্থানীয় সরকারমন্ত্রী বলেন, 'বর্তমান সরকারের সময় কোনো নির্বাচনেই হস্তক্ষেপ করা হয়নি। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও আপনারা দেখতে পাবেন, এখানেও সরকার কোনো হস্তক্ষেপ করবে না।'
বিরোধীদলীয় নেতা তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের যে দাবি জানিয়েছেন, তার জবাবে আশরাফ বলেন, 'তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইতিহাস আমাদের সকলের জানা আছে। বিরোধীদলীয় নেতা তো বলেছিলেন, পাগল ও শিশু ছাড়া, কেউ নিরপেক্ষ নয়। এখন তিনি ভালো মানুষ কোথায় পাবেন?'
বিরোধীদলীয় নেতার উদ্দেশে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, 'বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অভিজ্ঞতা কি আপনার নেই? সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার আপনি আবার চান?'
আশরাফ বলেন, 'আদালতের রায়ের প্রতি আমাদের পূর্ণ বিশ্বাস রয়েছে। সে অনুযায়ীই সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে।'
সার্চ কমিটি করার প্রস্তাবে একমত : সবার সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন গঠনের যে আহ্বান খালেদা জিয়া জানিয়েছেন, তার সঙ্গে একমত প্রকাশ করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। তিনি বলেন, 'সার্চ কমিটির প্রস্তাবের সাথে আমরা একমত। এটা নিয়ে আমাদের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকেও আলোচনা হয়েছে এবং পূর্ণ সমর্থন জানানো হয়েছে। এটা আইন হিসেবে জাতীয় সংসদের আগামী অধিবেশনে নিয়ে আসা হবে।'
আশরাফ আরো বলেন, 'শক্তিশালী কমিশন গঠনের জন্য নির্বাচন কমিশন যে প্রস্তাব দিয়েছে, তা যুক্তিযুক্ত। নির্বাচন কমিশন যে পরিবর্তন আনতে চাইছে, আমরা তার অধিকাংশের সাথেই একমত। তবে আইনের পরিবর্তন সংসদেই সম্ভব।'
আমরা কি গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড ইলেকশন কমিশন করতে পারি না : মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন সম্প্রতি ভারত সফরকালে সে দেশের নির্বাচন কমিশনকে গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড নির্বাচন কমিশন হিসেবে আখ্যায়িত করেন। এ প্রসঙ্গ উল্লেখ করে আশরাফ বলেন, 'আমরা কি আমাদের দেশে গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড ইলেকশন কমিশন করতে পারি না?'
বিরোধীদলীয় নেতার মূল উদ্দেশ্য দুর্নীতিবাজ দুই পুত্রকে রক্ষা এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করা : আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, 'বিরোধীদলীয় নেতার জনসভার মূল উদ্দেশ্য ছিল_দুর্নীতিবাজ দুই পুত্রকে রক্ষা এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচাব বানচাল করা। জনসভার সব কথাই মিথ্যা ও বানোয়াট। আমরা বিরোধীদলীয় নেতার কাছ থেকে এ ধরনের কথা আশা করিনি।'
খালেদা জিয়ার বক্তব্য মিথ্যা : আশরাফ বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বেশি, মানুষ ঈদে বাড়ি যেতে পারেনি, এই সরকারের সময় বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়েনি বলে খালেদা জিয়া যে বক্তব্য দিয়েছেন তা সম্পূর্ণ মিথ্যা।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, 'বর্তমান সরকারের সময় হাওয়া ভবনের মতো দুর্নীতির বিকল্প স্থান তৈরি করা হয়নি। খালেদা জিয়া ও তাঁর দুই পুত্র যে দুর্নীতিবাজ, এটা পুরো বিশ্বে স্বীকৃত। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর দুই পুত্র বিদেশের কোর্টে দোষী সাব্যস্ত হয়েছে, এটা আমাদের জন্য লজ্জাজনক। গত কয়েক বছর সরকার দুর্নীতিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নও হয়নি।'
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবেই : একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের প্রথম ধাপ এই সরকারের আমলেই সম্পন্ন করার আশা প্রকাশ করেন আশরাফ। তিনি বলেন, 'যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবেই। খালেদা জিয়া ও জামায়াত যতই চেষ্টা করুক, এই বিচার বানচাল করতে পারবে না।' তিনি আরো বলেন, 'আমাদের সুষ্পষ্ট নির্বাচনী ওয়াদা ছিল, আমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করব। এখন সে বিচার শুরু হয়েছে। অত্যন্ত দ্রুতগতিতে সে বিচার চলছে। আশা করছি, এই সরকারের সময়ই এই বিচারের প্রথম প্রক্রিয়া শেষ হবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার একটি চলমান প্রক্রিয়া। এটা ভবিষ্যতেও চলবে।'
মঙ্গলবারের মিটিংয়ে গ্রেনেড হামলা হয়নি : দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে খালেদা জিয়ার অভিযোগের জবাবে আশরাফ বলেন, 'বিএনপির কার্যালয়ের সামনে কালকের (মঙ্গলবার) মিটিংয়ে গ্রেনেড হামলা হয়নি। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের কার্যালয়ের সামনে মিটিংয়ে গ্রেনেড হামলা হয়েছিল। চারদলীয় জোট সরকারের সময় দেশের সকল জেলায় সিরিজ বোমা হামলা, তৎকালীন সাংসদ শাহ এ এম এস কিবরিয়া ও আহসানউল্লাহ মাস্টার হত্যাকাণ্ড, সংখ্যালঘু নির্যাতন, হত্যা ও ধর্ষণ এবং অপারেশন ক্লিনহার্টের সময় হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। বর্তমান সরকারের সময় এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি। কারণ আমাদের সরকার সন্ত্রাস দমনে সফলভাবে কাজ করে যাচ্ছে।' তিনি বলেন, 'বিরোধী দলের সমাবেশ শান্তিপূর্ণভাবেই হয়েছে। যারা এসেছিলেন, তাঁরা নিরাপদেই বাড়ি ফিরে গেছেন।'
আমরাও পল্টন ময়দানের অনুমতি না পেয়ে দলীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করেছি : মহাসমাবেশের জন্য বিরোধী দলকে পল্টন ময়দানের অনুমতি দেওয়া হয়নি বলে বিএনপির অভিযোগের জবাবে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী বলেন, 'ক্ষমতায় থেকেও আমরা যে কারণে পল্টন ময়দান ব্যবহারের অনুমতি পাইনি; তাঁরাও ঠিক একই কারণে পল্টন ময়দান ব্যবহারের অনুমতি পাননি। আমরাও পল্টন ময়দানের অনুমতি না পেয়ে দলীয় কার্যালয়ের সামনে বেশ কয়েকটি সমাবেশ করেছি।'
সংবিধানের শুরুতেই বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম রয়েছে : সংবিধান থেকে সরকার আল্লাহর নাম তুলে নিয়েছে বলে খালেদা জিয়া যে অভিযোগ করেছেন, তার জবাবে আশরাফ বলেন, 'সংবিধানের শুরুতেই বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম রয়েছে। বরং খালেদা জিয়া যখন কালকে (মঙ্গলবার) বক্তব্য দিচ্ছিলেন, তখন মাগরিবের আজান পড়লেও তিনি তাঁর কথা বন্ধ করেননি। যাঁরা নামাজ পড়ছিলেন তাঁদের প্রতি সম্মান দেখাননি। তাঁদের ধর্মে বিশ্বাস নেই, আস্থা নেই।'
খালেদা জিয়ার উদ্দেশে আশরাফ বলেন, 'আপনারা যতই চেষ্টা করুন, জনগণকে বিভ্রান্ত করতে পারবেন না। সময় আসলে জনগণ সঠিক সিদ্ধান্ত নেবেই। আগামী নির্বাচনে জনগণই নির্ধারণ করবে, কে ক্ষমতায় যাবে। অশুভ শক্তির রাতের আঁধারে ক্ষমতা দখলের দিন শেষ হয়ে গেছে। আপনাকে জনগণের কাছে যেতেই হবে।'
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইন হয়েছিল বিএনপির সময় : স্থানীয় সরকারমন্ত্রী বলেন, জগন্নাথ কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করা হয়েছে বিএনপির সময়। তখনই এই আইন পাস করা হয়েছিল। প্রয়োজন হলে এই আইন বাতিল করা হবে। যখন এই আইনটি করা হয়েছিল, তখন কোনো ভাঙচুরের ঘটনা না ঘটলেও এখন তা হওয়ায় বিস্ময় প্রকাশ করেন আশরাফ। তিনি বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন জানবে না, এটা দুঃখজনক। এখন যা করা হচ্ছে, এটা ছাত্র নামধারী কিছু সন্ত্রাসী করছে।' তিনি আরো বলেন, 'আটক করা ছাত্রদের এরই মধ্যে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। কারণ আমরা মনে করি, তারা অজ্ঞ।'
কোনো দলের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ করবেন না : সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য শুরু করার আগেই আশরাফ জানতে চান এনটিভি, ইটিভি, বাংলাভিশন ও ইসলামিক টেলিভিশনের প্রতিবেদক উপস্থিত আছেন কি না। এই চ্যানেলগুলোর প্রতিবেদকরা তাঁদের উপস্থিতি নিশ্চিত করলে আশরাফ বলেন, 'আমরা অত্যন্ত খুশি হয়েছি, আপনারা কালকের সমাবেশ লাইভ টেলিকাস্ট করেছেন। এটা গণতন্ত্রের জন্য শুভ লক্ষণ। আমরা আশা করব, আপনারা আজকের (বুধবার) এই সংবাদ সম্মেলনও লাইভ টেলিকাস্ট করবেন। এখানে কালকের সমাবেশের বিভিন্ন বক্তব্যের উত্তর দেওয়া হবে। তা না করলে, তা গণতন্ত্রের জন্য শুভ লক্ষণ হবে না। জনগণ মনে করবে, আপনারা একটা দলের জন্য কাজ করছেন। কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ করবেন না।'
সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন মাহাবুব-উল আলম হানিফ, নূহ-উল আলম লেনিন, অসীম কুমার উকিল, আফজাল হোসেন, ফরিদুন্নাহার লাইলী, সুজিত রায় নন্দী প্রমুখ।

No comments

Powered by Blogger.