বঙ্গবন্ধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের স্বেচ্ছাচারিতা by অভিজিৎ ভট্টাচার্য

কৃষি শিক্ষার অন্যতম বিদ্যাপীঠ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৯৮ সালে গাজীপুরে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়টি একসময় 'সেন্টার অব এক্সেলিন্স' খ্যাতি পেয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে উপাচার্যের প্রশাসনিক ব্যর্থতা ও স্বেচ্ছাচারিতার কারণে সেই সুনাম হারাতে বসেছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ২১টি বিভাগ, তিনটি অনুষদ ও একটি ইউনিট চালু আছে। এর মধ্যে তিনটি বিভাগে ছাত্রছাত্রী নেই, কোনো কাজও নেই। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেছেন, প্রায় ৩০০ আসনবিশিষ্ট ছাত্রী হলে সাতজন শিক্ষককে প্রভোস্টের দায়িত্ব দিয়ে রেখেছেন উপাচার্য। তাঁর স্বেচ্ছাচারিতার কারণে মূল্যবান যন্ত্রপাতি নষ্ট হতে বসেছে বিভিন্ন বিভাগে।

জাতির জনকের নামে বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হলেও এবার তাঁর জন্মদিন পালন করা হয়েছে ছয় দিন পর। তা-ও কর্তৃপক্ষের চাপাচাপিতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শাখা বা বিভাগে অনেক শিক্ষককে নিজ দায়িত্বের পাশাপাশি অন্য কাজ দিয়ে রেখেছেন উপাচার্য। ফলে তাঁরা নিজের কাজ যেমন, অতিরিক্ত কাজও ঠিকভাবে করতে পারেন না। অথচ তাঁরা বাড়তি দায়িত্বের ভাতা পান ঠিকই। একজন ডিন বছরের চার মাস থাকেন আফগানিস্তানে। বিশ্ববিদ্যালয়ের গত সমাবর্তনে আচার্য উপস্থিত হওয়ার কথা থাকলেও তিনি আসেননি। পরে স্পিকারকে প্রধান অতিথি করা হলে তিনিও আসেননি। শেষে শিক্ষামন্ত্রীকে প্রধান অতিথি করে সমাবর্তন অনুষ্ঠান শেষ করা হয়।
বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামীপন্থী গণতান্ত্রিক শিক্ষক পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক ড. খোরশেদ আলম ভুঁইয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এই বিশ্ববিদ্যালয়ে যা হচ্ছে তা তো সরকারসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জানাই আছে। আমি আর নতুন করে কী বলব?' বিভিন্ন কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব কাজ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন বলে জানান এই শিক্ষক।
গত ৮ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়টিতে সরেজমিনে ঘুরে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। এ সময় উপাচার্য ড. আবদুল মান্নান আকন্দের সঙ্গে দেখা করতে চাইলেও সম্ভব হয়নি। অবশ্য পরদিন তিনি মোবাইল ফোনে কালের কণ্ঠকে বলেন, কয়েকটি বিভাগের কার্যক্রম শুরু করার জন্য ইতিমধ্যেই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন থাকলেও তিনি অসুস্থ থাকায় ওই দিন তা পালন করা সম্ভব হয়নি। ছয় দিন পর ২৩ মার্চ জন্মদিন পালন করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি এ প্রতিবেদককে প্রতিবেদনটি না লেখার পরামর্শ দিয়ে বলেন, 'প্রতিবেদনটি তুমি এখন লিখো না। আমার বাসায় তোমার দুপুরের খাবারের নিমন্ত্রণ। আমার সঙ্গে দুপুরের খাবার খাওয়ার পর তুমি সিদ্ধান্ত নেবে প্রতিবেদন লিখবে কি না।' তিনি বলেন, 'উপাচার্যদের বিরুদ্ধে পত্রিকায় লেখা ঠিক নয়। কারণ প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিজেই একেকটা প্রতিষ্ঠান।' পরে উপাচার্য এ প্রতিবেদককে সারা দিনে ছয়বার ফোন করে জানতে চেয়েছেন, তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে কোনো প্রতিবেদন লেখা হচ্ছে কি না।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শাখার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ২০০৯ সালের মার্চে নিয়োগ পাওয়া উপাচার্য আবদুল মান্নান আকন্দ সম্পর্কে কালের কণ্ঠকে বলেন, তিনি একজন মিথ্যাবাদী। তিনি বিভিন্ন বিষয়ে মিষ্টি মিষ্টি করে সব কথা বলবেন। কিন্তু পরে এসব বিষয়ে জানতে চাইলেই অস্বীকার করেন। এ জন্য তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে কোনো ব্যবস্থাও নেওয়া যায় না। উপাচার্য এই অভিযোগের জবাবে বলেন, 'আমি মিথ্যাবাদীও না, ভণ্ডও না। তুমি খাবার খেতে এলে সব বুঝতে পারবে।'
বায়ো-এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স : সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেছেন, এ বিভাগে একজন অধ্যাপক, একজন সহকারী অধ্যাপক, একজন ল্যাব সহকারী ও মাস্টাররোলে একজন এমএলএসএস কর্মরত আছেন। ২০০৮ সালে বিভাগটি চালু হলেও আজ পর্যন্ত স্নাতক স্তরে কোনো কোর্স চালু করা হয়নি। স্নাতকোত্তরের অনুমতিই নেই। না থাকার কারণে প্রতিমাসে অযথা লাখ টাকা খরচ গুনতে হচ্ছে। ল্যাব সহকারী থাকলেও কোনো ল্যাব নেই। বৈশ্বিক জলবায়ুর জন্য বিভাগটি বর্তমানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অথচ কর্তৃপক্ষের নেতিবাচক মনোভাবের কারণে কোনো স্তরের কোর্স চালু করা যাচ্ছে না। ল্যাবের অভাবে শিক্ষকরা গবেষণা করতে পারছেন না। ল্যাবের অনেক যন্ত্রপাতি বিভাগের একটি রুমে 'ডাম্পিং' করে রাখা হয়েছে।
জানতে চাইলে বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. আবুল হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'স্নাতক কোর্স চালুর জন্য প্রস্তাবনা গত মার্চে একাডেমিক কাউন্সিল ও সিন্ডিকেটে উত্থাপনের জন্য পাঠিয়েছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত এর অগ্রগতি নেই। কয়েক দিন আগে আমি খবর নিয়ে জেনেছি, আমার পাঠানো প্রস্তাবনা উপাচার্যের কাছে পড়ে রয়েছে।'
এগ্রো-প্রসেসিং বিভাগ : অন্য একটি বিভাগের শিক্ষককে দিয়ে চালানো হচ্ছে এই বিভাগ। রয়েছেন একজন মাত্র ভিজিটিং প্রফেসর। কিন্তু তাঁর কোনো কাজ নেই। অথচ এই বিভাগে দুটি প্রকল্প চালু আছে। নেই কোনো গবেষণাগারও। বিএসসি এগ্রি (অনার্স) কোনো কোর্স নেই। উদ্ভিদের রোগতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. আবু আশরাফ খানকে এ বিভাগের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'উপাচার্য মহোদয়ের ইচ্ছায় এ বিভাগের দায়িত্ব নিয়েছি। ছাত্রছাত্রী না থাকলে ভালো লাগে না। কাজেই অফিসে আসি আর যাই।'
এগ্রি-বিজনেস বিভাগ : খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, একজন শিক্ষক এ বিভাগে দুই বছর ধরে কর্মরত, যাঁর কোনো কাজ নেই, নেই কোনো ক্লাস। অথচ প্রতিমাসেই সরকারকে বেতন ও অন্যান্য ভাতা বাবদ প্রচুর টাকা খরচ করতে হচ্ছে। এখানেও আরেক বিভাগের একজন শিক্ষককে বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কৌলতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. এম এ খালেক এ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, উপাচার্য মহোদয়ের ইচ্ছায় তিনি এ কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি মোটেও কাজটি উপভোগ করতে পারছেন না। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, 'শিক্ষকের প্রধান কাজ ছাত্র পড়ানো। সে কাজ করতে না পারলে কি আনন্দ লাগে?'
তিনের ভেতরে এক : সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহবুবার রহমান তিন বছর ধরে 'ফিশারিজ ফ্যাকাল্টির' ডিন। একই সঙ্গে তিনি পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) পদেও আছেন। আবার বিভাগীয় অধ্যাপকের মতো বড় দায়িত্বও তাঁর। কিন্তু এর কোনোটাই ঠিকমতো হচ্ছে না। তদুপরি তিনি বছরের চার মাস আফগানিস্তানে কনসালটেন্সিতে থাকেন। ড. মাহবুবার রহমান এখন আফগানিস্তানে থাকায় কথা বলা সম্ভব হয়নি।
জাতির জনকের জন্মদিন : জাতির জনকের নামে প্রতিষ্ঠিত এ বিশ্ববিদ্যালয়ে জাতির জনকেরই জন্মদিন এবার পালিত হয়নি যথাসময়ে। ১৭ মার্চ জাতির জনকের জন্মদিন পালন হওয়ার কথা থাকলেও তা কর্তৃপক্ষের চাপাচাপিতে ছয় দিন পরে ২৩ মার্চ তিনি তা করেন। অভিযোগ রয়েছে, উপাচার্য ইচ্ছা করেই জাতির জনকের জন্মদিন পালন করতে চাইছিলেন না। অসুস্থ হওয়ার ভান করে সারা দিন বাসায় ছিলেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে উপাচার্য বলেন, 'আমি সিরিয়াসলি অসুস্থ থাকায় অনুষ্ঠানটি ওই দিন হয়নি, পরে হয়েছে।' পেটের পীড়াজনিত কারণে তিনি অসুস্থ হলেও কোনো হাসপাতালে ভর্তি হননি। উপাচার্য বলেন, 'আমি বাসায় বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম।'
গণতান্ত্রিক শিক্ষক পরিষদের সভাপতি খোরশেদ আলম ভুঁইয়া বলেন, 'উপাচার্য অসুস্থ হলে কি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ বন্ধ থাকে? উপাচার্য আমাদেরও বলেছেন তিনি অসুস্থ ছিলেন।' 'সরকার কি এগুলো দেখে না' বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন খোরশেদ আলম।
নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ : সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে নিয়োগ বাণিজ্য। তিনি উপাচার্য হওয়ার পর এ পর্যন্ত বিভিন্ন বিভাগে ৪০ জনকে মাস্টাররোলে নিয়োগ দিয়েছেন 'বাণিজ্যের মাধ্যমে'। তাঁর এসব অপকর্মের যাতে প্রতিবাদ না হয়, সে জন্য কয়েকজন সিনিয়র শিক্ষককে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা ও দায়িত্ব দিয়ে বশ করে রেখেছেন। তিনি উপাচার্য হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো উন্নতি না হলেও তাঁর ব্যক্তিগত উন্নতি হয়েছে। তাঁর নিজের জন্য দুটি গাড়ি, স্ত্রীর জন্য একটি গাড়ি ও মেয়ের জন্য একটি গাড়ি রয়েছে। নিজের নামে বরাদ্দকৃত বাসা ছেড়ে দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের গেস্ট হাউসে থাকেন। এ ছাড়া জয়দেবপুরে তিনি সম্প্রতি কিছু জমিও কিনেছেন। তাঁরা আরো জানান, উপাচার্য হওয়ার আগে তিনি সবার কাছ থেকে টাকা ধার করতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের ছোট ছোট দোকানের প্রায় প্রতিটি তাঁর কাছে টাকা পেত। উপাচার্য হওয়ার এক বছর পর ছেলেকে ইংল্যান্ডে এমবিএ করার জন্য পাঠিয়েছেন।
জানতে চাইলে উপাচার্য নিয়োগ বাণিজ্যের কথা অস্বীকার করেন। ছেলেকে ইংল্যান্ডে পাঠানো প্রসঙ্গে বলেন, 'ছেলের বিদেশে যাওয়ার টাকা আমি দিইনি। আমার এক বন্ধু দিয়েছে।' মোড়ের দোকানে টাকা বাকি রাখার বিষয়ে উপাচার্য বলেন, 'আমি সিগারেট বেশি খাই। এ জন্য স্ত্রী আমার সব টাকা তার কাছে রেখে দেয়। সিগারেট খাওয়ার জন্য সে আমাকে টাকা দেয় না। এ কারণে ধারকর্জ করে সিগারেট খাই। পরে এগুলো পরিশোধ করি।' জয়দেবপুরে উপাচার্যের জমি থাকার কথা স্বীকার করলেও কী পরিমাণ আছে তা বলেননি।
গুরুত্বহীন সমাবর্তন : গত বছরের ২৪ মার্চ অনুষ্ঠিত সমাবর্তনের প্রধান অতিথি হিসেবে বিশ্ববিদ্যালটির আচার্য তথা রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমানের আসার কথা ছিল। কিন্তু তিনি আসেননি। পরে স্পিকার আবদুল হামিদকে প্রধান অতিথি করা হলে তিনিও আসেননি। শেষে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদকে প্রধান অতিথি করে সমাবর্তন অনুষ্ঠান করা হয়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সমাবর্তনে গাজীপুরের কোনো সংসদ সদস্যও উপস্থিত ছিলেন না।
এ বিষয়ে উপাচার্য বলেন, রাষ্ট্রপতি অসুস্থ থাকায় তিনি সমাবর্তনে আসতে পারেননি। এ ছাড়া স্পিকারের ব্যক্তিগত ব্যস্ততা থাকায় তিনিও আসতে পারেননি।
হলের নামকরণ হয়নি : বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সবার দাবি হলের নামকরণ। সেটা গত দুই বছরেও হয়নি। আন্ডারগ্র্যাজুয়েট ছাত্রদের জন্য নির্ধারিত হলকে বিএস হল এবং ছাত্রী ও এমএস পর্যায়ের ছাত্রদের জন্য দুটি ডরমিটরি আছে, যেগুলোর নাম নেই। ছাত্রদের দাবি, বিএস হলের নাম তাজউদ্দিন হল, ছাত্রীদের হলের নাম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল, এমএস অংশের নাম শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার হল করা হোক। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, নামকরণের বিষয়টি ঝুলে আছে উপাচার্যের কালক্ষেপণের কারণে। এ ছাড়া ছাত্রীরা বর্তমানে যে ডরমিটরিতে থাকেন, সেখানে সাতজন প্রভোস্ট নিয়োগ দিয়ে রেখেছেন উপাচার্য। এর মধ্যে চারজন পুরুষ ও তিনজন মহিলা। এসবের জবাবে উপাচার্য বলেছেন, হলের নামকরণ শিগগিরই হয়ে যাবে। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব সমস্যা বর্তমানে রয়েছে, সেগুলোও সমাধানের পথে রয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.