জকিগঞ্জের 'ফিশ গার্ডেন' থেকে বছরে আসছে ৬০০ টন মাছ by এম আবদুল্লাহ্ আল মামুন

সিলেটের সীমান্ত উপজেলা জকিগঞ্জে আট বিনিয়োগকারীর শ্রম, ঘাম ও মেধায় গড়ে উঠেছে বিশাল এক মৎস্য খামার। বিদ্যুতের অভাব, প্রযুক্তির ছোঁয়া ও রাস্তাঘাটের দুরবস্থায় উদ্যোক্তাদের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হলেও খামার থেকে বছরে আয় হচ্ছে প্রায় কোটি টাকা। উৎপাদন হচ্ছে প্রায় ৬০০ টন মাছ।
খামারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহসিনুর রহমান জানান, ২০০১ সালে উপজেলার কাজলসার ইউনিয়নে কামালপুর এলাকায় স্বল্প পরিসরে আমেরিকান ফিশারি নামে এ 'ফিশ গার্ডেন'-এর যাত্রা শুরু। ২০০৫ সালে মালিকানা পরিবর্তনের পাশাপাশি খামারের নামেও আসে পরিবর্তন। প্রথমপর্যায়ে মাত্র ৪৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ করা হয়। প্রথম তিন বছর লাভের চোখ দেখেননি উদ্যোক্তারা। ২০০৭ সালের বন্যায় ভেসে যায় খামারের সব মাছ। কিন্তু অদম্য ইচ্ছায় উদ্যোক্তারা কাজ শুরু করেন নতুন উদ্যোমে। খামারের বাঁধকে বন্যামুক্ত করে ব্যাপক পরিকল্পনায় শুরু হয় মাছ উৎপাদন। ১৪ বছরের জন্য প্রায় ২০০ একর জমি লিজ নিয়ে মাছচাষ শুরু করেন তাঁরা। ছোট-বড় ২৪টি পুকুর রয়েছে এ খামারে। ছোট পুকুরের পরিমাণ দুই বিঘা ও সবচেয়ে বড় পুকুরের পরিমাণ ১৭৫ বিঘা। নার্সারি পুকুর এবং কালচার পুকুরে চাষ করা হচ্ছে তেলাপিয়া, রুই, কাতল, মৃগেল, কার্পু, গ্রাসকার্প, সরপুঁটি ইত্যাদি। তবে তেলাপিয়া চাষই এখানে প্রধান। খামারে নতুন সংযোজন হচ্ছে হাইব্রিড শিং, মাগুর ও কই মাছ। এখানে সুস্বাদু ও দামি আইড় মাছের পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু হয়েছে গত বছর থেকে। ফিশ গার্ডেনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহসিনুর রহমান বলেন, মাছচাষের প্রতি আগ্রহ বহু পুরনো। বাড়ির পুুকুরে শখের বসে মাছচাষ করতেন। পুকুরে মাছের খেলা ভালো লাগত। সুযোগ পেয়ে ট্রাভেল্স ব্যবসা ছেড়ে নেমে পড়েন মাছচাষে।
প্রায় চার কিলোমিটার দীর্ঘ খামারের চারপাশে লাগানো হয়েছে নানা জাতের বনজ, ফলদ ও ওষুধি গাছ। উৎপাদন হচ্ছে নানা জাতের সবজি ও ফল। ফিশ গার্ডেনের চার পাশে রয়েছে আটটি পাহারা চৌকি। বছরের পর বছর অনাবাদি থাকা জমিকে মাছ উৎপাদনে কাজে লাগিয়ে এলাকায় চমক সৃষ্টি করেছেন উদ্যোক্তারা। বর্তমানে এই খামারের মাছ জকিগঞ্জ, কানাইঘাট, বিয়ানীবাজার ও গোলাপগঞ্জে মানুষের মাছের চাহিদা ও পুষ্টি পূরণে বিশাল ভূমিকা রাখছে। স্থানীয় চাহিদা পূরণের পর তা পাঠানো হয় সিলেট শহরেও।
প্রাকৃতিক কারণে হাওরের মাছ কমে যাওয়ায় বিকল্প মাছের এই উৎপাদনকে সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। উপজেলা ভারপ্রাপ্ত মৎস্য কর্মকর্তা মো. আনিছুর রহমান বলেন, সিলেটে বছরের পর বছর অনেক জায়গা অনাবাদি ও পতিত পড়ে থাকে। এসব জায়গা পরিকল্পিতভাবে মাছচাষের আওতায় আনা সম্ভব, তা প্রমাণ করেছেন 'ফিশ গার্ডেন'-এর উদ্যোক্তারা। স্থানীয় মৎস্য অফিস এ কাজে সার্বিক সহযোগিতা ও প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে আসছে বলে জানান তিনি।
সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও আইড় মাছ গবেষক ড. ইকবাল আহমদ জানান, আইড় মাছ বর্তমানে বিলুপ্তপ্রায়। সংকটাপন্ন এই প্রজাতির মাছ উৎপাদনে 'ফিশ গার্ডেন'-এর উদ্যোগ প্রশংসনীয়। নিজস্ব ফার্মে দেশীয় প্রজাতির আইড় মাছের প্রজনন ও উৎপাদন প্রচেষ্টার ভবিষ্যৎ ভালো।
'ফিশ গার্ডেন'-এর উদ্যোক্তা সদস্য শফিকুর রহমান জানান, বর্তমানে তাঁদের খামারে ১০০ জন শ্রমিক কাজ করছেন। ৫০০টি পরিবারের প্রায় তিন হাজার মানুষ প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষে এই খামার থেকে উপকৃত হচ্ছেন। এটি বৃহত্তর সিলেটের সর্ববৃহৎ মৎস্য খামার বলেও দাবি করেছেন তিনি। তিনি জানান, তাঁদের লক্ষ্য খামার থেকে বছরে এক হাজার ৫০০ থেকে এক হাজার ৬০০ টন মাছ উৎপাদন করা। বর্তমানে উৎপাদন হচ্ছে ৫০০-৬০০ টন মাত্র। প্রতিদিন বিক্রি হচ্ছে দেড়-দুই টন মাছ, যার বাজার মূল্য দেড়-দুই লাখ টাকা।

No comments

Powered by Blogger.