আলোচনা- 'ওরাও মানুষ আছে ওদের অধিকার' by পারভীন আফরোজা

কটি গবেষণা বলছে বিজ্ঞানের এই যুগে এখনও সমাজের আনাচে-কানাচে ধনী, গরীব, সাদা, কালো, উঁচুজাত ও নিচুজাতের বৈষম্য প্রকটভাবে বিদ্যামান। এই বৈষম্যের কারণে বহু মানুষ তাদের মৌলিক অধিকার তথা সামাজিক সম্মান থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বাংলাদেশে হিন্দু সমপ্রদায়ের মধ্যে ৩৫ লাখ লোক আছে যারা নিচুজাতের বলে পরিচিত। এই সকল নিম্ম ধরনের মানুষেরা বাংলাদেশে শহরে বন্দরে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা রক্ষার কাজে নিয়োজিত থেকে আমাদের সুস্থ ও স্বাভাবিক পরিবেশ উপহার দেয়।
যে মানুষগুলো নোংরা দুর্গন্ধময় অপরিচ্ছন্ন জিনিস নিজ হাতে পরিষ্কার করে শহরকে সাজিয়ে রাখছে এবং আমাদের সুস্থতা বজায় রাখছে। সেই মানুষগুলোর জীবনযাত্রা কেমন কাটাচ্ছে এ বিষয়কে আমরা কখনো ভেবে দেখেছি? প্রতিদিন তাদের কাজ হয়। ড্রেন পরিষ্কার করা, রাস্তা ঝাড়ু দেয়া, পায়খানা পরিষ্কার করা, যার পরিবেশ অত্যন্ত অসাস্থ্যকর, দুর্গন্ধময় এবং অনেক সময় অসহনীয় কাজগুলো করতে গিয়ে ময়লা পানিতে ডুবে, রোদ-বৃষ্টিতে ভিজে তাদের অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়। কিন্তু তাদের দুঃখ নিয়ে আমরা কি কখনো ভেবেছি? এরা এক ধরনের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী যাদের জীবনযাত্রা অত্যন্ত নিম্ম মানের এবং অভাবের মধ্যে তাদের দিন কাটে। এদের সামাজিক পরিচয়, সম্মানজনক নয় বলে ধাঙ্গড় সম্প্রদায়ের কিছু কিছু সন্তানেরা স্কুল-কলেজে গেলে তারা চেষ্টা করে তাদের সামাজিক পরিচয় লুকিয়ে রাখতে। ঢাকাসহ সারা বাংলাদেশে এদেরকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন রাখা হয় যে কারণে তারা মানবেতর জীবন যাপন করে। হিন্দু ধর্মমতে ৪৪ পদের নিম্ম বর্ণের মানুষ রয়েছে। যাদের প্রত্যেকে অবহেলিত একটা জাতি হিসাবে সমাজে পরিচিত। ঝাড়-দার বা ধাঙ্গড় সমপ্রদায়ের লোকেরা বছরের প্রতিটি দিন ভোর হওয়ার আগেই শহরের সমস্ত মলয়া আবর্জনা পরিষ্কার করে ফেলে। অথচ নিজেরা একজন নাগরিক হিসাবে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা এবং অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। সরকার শহরের বিভিন্ন জায়গায় খুব ছোট ছোট কলোনী তৈরি করেছিল যেগুলো মাস্তানদের দখলে আছে বলেই তাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই হারিয়ে ফেলেছে। এরা শিক্ষা স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন সামাজিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এদের বেশীর ভাগই কিছু নির্দষ্ট এলাকায় জীবন যাপন করে সুপেয় পানি বিদু্যৎ ও জ্বালানির জন্য গ্যাসের সরবরাহ নেই। তাদের বস্তি ঘরগুলো এত ছোট যে, একটু ঝড় আসলে চাল উড়ে যাবে এবং একটু বৃষ্টি হলে ঘরের মধ্যে পানি পড়ে। সরকারি ক্ষেত্রে তেমন নিয়োগ-এর সুযোগ-সুবিধা নাই তাই এদের মধ্যে বহু মানুষ বেকারত্বে ভুগছে। নোংরা বস্তিতে থাকার কারণে তাদের শিশুরা নানান রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। রাতে কাজ করতে হয় তাই অনেক ঝাড়- মেয়েদের ধর্ষণের শিকার হতে হয়। তারা দুর্বল এবং তাদের পাশে দাঁড়াবার কেউ নেই বলে থানা থেকেও কোন মামলা নেয়া হয় না। এমনকি অপরিচিতের দ্বারা রাতের অন্ধকারে ধর্ষণের শিকার হয় তাই থানায় মামলা নিতে চাইলেও ধর্ষণকারীদের কোন পরিচয় জানে না তাই অপরাধীকে শাস্তি দেয়া সম্ভব হয় না। আমাদের বাংলাদেশে অনেক সুইপার আছে যারা বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারে না কেউ কেউ তেলেগু ও কানপুরি ভাষায় বলে এবং তাদের নিজস্ব ভাষা এমনি বাংলা ভাষা শিক্ষারও কোন সুযোগ নাই। কিছু কিছু এনজিওরা এই সকল শিশুকে উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রদানের কাজ হাতে নিলেও এক্ষেত্রে তেলেগু ও কানপুরি ভাষার শিক্ষক নেই তাই তাদের জন্য শিক্ষা প্রদান করতে চাইলেও একটা ভাষাগত জটিলতা দেখা যায়। সরকার যদিও সবার জন্য শিক্ষা শেস্নাগানের কাজ করে যাচ্ছে শুধুমাত্র ভাষাগত সমস্যার কারণে এদের শিশুরা স্কুলে আসতে পারছে না। কিছু কিছু বাবা-মায়েরা তাদের ভাষা পরিচয় এবং ঠিকানা বদলে স্কুলে পাঠায় এক্ষেত্রে তারা বাঙালী হিসাবে বাংলা ভাষা এবং অস্তিত্ব ভুলে যায়। যে সকল সুইপার সরকারি চাকরি করে তাদের বেশীরভাগই দিন হাজিরা কাজ করে তাই মাতৃত্বকালীন ছুটিও পায় না এবং গর্ভবতী অবস্থায় খুব কষ্টকরভাবে কাজ করে থাকে এবং শিশু বাচ্চা কাপড়ে পিঠে বেঁধে রাস্তায় ধুলা-বালির মধ্যে কাজ করে। এমন অবস্থায় শিশুটির নাকে-মুখে রাস্তার ধুলাবালি ঢুকে এবং অসুস্থ হয়ে যায়। যেসব এলাকায় সুইপারা বাস করে সেখানে পয়: নিষ্কাশন ব্যবস্থা এত নোংরা যে, ড্রেন না থাকার কারণে তাদের ময়লার মধ্যে হাঁটাহাঁটি করতে হয়। সুইপারদের মনের মধ্যে অনেক হতাশা আছে। যা তারা যথাযথ জায়গায় গিয়ে সব সময় বলতে পারে না এবং অধিকার আদায় করতে পারে না। তাদের সমস্যার কথা জানিয়ে সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ঢাকার মেয়র সাদেক হোসেন খোকা এবং স্থানীয় সরকার মন্ত্রী আব্দুল মান্নান ভুঁইয়ার কাছে আবেদন করেছিল। কিন্তু কোন কাজ হয়নি। আগের দিনে তারা বাংলা মদ, গাঁজা খেত এখন তাদের অনেকেই অভাবের কারণে এসব অভ্যেস ছেড়ে দিয়েছে। তাদের বিয়েতে আগে বেশ অনুষ্ঠান উযযাপন করা হত। শুধুমাত্র পয়সার অভাবে সেই রঙিন আড়ম্বরতা আর নেই। সচেতনতার অভাবে তাদের বাচ্চা-কাচ্চার সংখ্যাই বেশী হয় এবং অদক্ষ দাই দ্বারা সন্তান প্রসব করা হয় বলে মেয়েদের প্রচন্ড ভোগান্তি পোহাতে হয়। বাংলাদেশ রাইফেলস-এর প্রধান কার্যালয় পিলখানার পাশে গনকটুলিতে প্রায় একলাখ সুইপার বাস করে। এটা সরকার নির্ধারিত একটা জায়গা যেখানে শতকরা ৫০ ভাগ সুইপার বাস করে। এবং বাকী এলাকাটা মাস্তান এবং মাদকদ্রব্য বিক্রেতাদের দখলে রয়েছে। সেখানে গাঁজা, হিরোইন মদ বিক্রেতারা বহাল তবিয়তে বানিজ্য করছে। এলাকার মাস্তানরা কলোনীর প্রায় দুই একর জমি দখল করে রেখেছে পুরো কলোনীটায় অপরিষ্কার এবং অস্বাস্থ্যকর যেখানে মানুষেরা কষ্টের মধ্যে দিন যাপন করে। তাদের জীবনযাত্রা এত নিম্নমানের যে, চিন্তার অধিক এবং অমানবিক এখানকার কলোনীতে এত ছোট ছোট বস্তি ঘর তার যেখানে সেখানে দুর্গন্ধ ময়লা যে পানি আসে তাও দুর্গন্ধ এবং ময়লা সেই কলোনীতে মাত্র চার-পাঁচটা পানির কল আছে যেখানে লাইন ধরে সামান্য করে পানি নিয়ে যায়।

সারাদিন সেই কলের পাশে পানির জন্য লম্বা লাইন লেগেই থাকে। এতে মেয়েদের পানি টানতে অনেক কষ্ট হয়। গোসলে মেয়েদের কোন আলাদা ব্যবস্থা নাই তাই ঋতু স্রাবের সময় মেয়েরা নিজেদেরকে পরিষ্কার করার জন্য কোন গোপন জায়গা না থাকার কারণে তাদের নানান ধরনের অসুখ দেখা দেয়। এক ঘরের মধ্যে পুরুষ-নারী নির্বিশেষে একের অধিক পরিবারকে বাস করতে হয়। তাই অনেক ক্ষেত্রেই মেয়েরা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। পায়খানা প্রসাবের স্থান কম থাকার কারণে লম্বা লাইন হয়্ পায়খানা প্রসাব চেপে থাকার কারণে অনেক শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। অনেকগুলো পরিবারের জন্য একটি রান্নাঘর তাই মেয়েদেরকে রান্নার জন্য লাইন দিতে হয়। সারারাত কাজ করে আসার পর আবার বাড়িতে এসে গৃহকর্মেও এত প্রতিবন্ধকতা থাকলে একটা মানুষের জীবন কত দুর্বিষহ হয়। সেটা একটি উপলব্ধির বিষয়। যেখান সেখান ময়লা থাকার কারণে মশা মাছির উপদ্রব অত্যধিক হয়ে থাকে। এলাকাটা এত ঘিনজি যে, সেখানে সুস্থ নিশ্বাস নেয়ার সুযোগ নেই। এইটুকু এলাকার মধ্যে এবং আশেপাশে প্রায় একশর বেশী মাদক বিক্রয় কেন্দ্র আসছে। যেখানে দেশীমদ, গাজাঁ, ফেন্সিডিল পাওয়া যায় এবং হিরোইন পাওয়া যায়। ঘরের মধ্যে বসে লোকেরা মাদক সেবন করে। সাধারণ জনগণের জন্য সেখানে স্বাস্থ্য সেবার কোন সুযোগ নেই। একটা মাত্র প্রাইমারী স্কুল আছে যেখানে সুইপারদের সন্তানদের লেখাপড়ার সুযোগ খুব সীমিত। সেই কলোনীর ধাঙ্গড় শিশুরা নিগৃহীত ও নির্যাতিত এমনকি স্কুলেও তাদের অপমান অপদস্ত হতে হয় তাই স্কুলে যাওয়ার উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। কলোনীতে মাদক অহরহ পাওয়া যাচ্ছে তাই উঠতি বয়সের কিশোর-কিশোরীরা মাদকাশক্ত হয়ে পড়ছে। এমনকি লেখাপড়া না শিখে তারা একটা পর্যায়ে ভাগ্যবান এমনি একটি পর্যায়ে মাস্তান হয়ে যায়। দয়াগঞ্জ সুইপার কলোনীতেও প্রায় ৫০ হাজার সুইপার, আগারগাঁও পি ডাবিস্নউডি সুইপার কলোনীতে এক হাজার, বিলপুর সুইপার কলোনীতে দুই হাজার স্পট লাইট ও মোহাম্মদপুর সুইপার কলোনীতে এক হাজার সুইপার বাস করে। যাদের বদৌলতে আমাদের প্রিয় এই দেশটা পরিচ্ছন্ন রয়েছে। তাদের বাস্তব জীবনে এমন নিঃশ্বাস নিতে হচ্ছে যা এ ধরনের নিষ্ঠুর উৎপিড়ন এবং অবহেলিত ধাঙ্গড় সমপ্রদায়ের মানবিক বৈষম্য। বাংলাদেশের সরকারের অবশ্যই এই সমপ্রদায়ের জীবন মান উন্নয়নের জন্য অতিসত্তর পদক্ষেপ নেয়া দরকার যাতেকরে এই মানবেতর জীবন যাপনকারী এই নিরীহ মানুষগুলো শান্তিপ্রিয় জীবনে কিছু সাধ খুজে পায়। বাংলাদেশ সরকারের কাছে আমার বিনীত অনুরোধ, যারা আমাদের সেবা করছেন আমাদের ট্যাক্সে এর টাকার কিছু অংশ তাদের জন্য ব্যয় করে তাদের শিক্ষা, চিকিৎসা ও আবাসিক সমস্যা কমিয়ে আনতে সরকারিভাবে বাজেট বরাদ্দ করে এবং তারা যাতে আর দশটা সাধারণ মানুষের মতো জীবন যাপন করতে পারে এই বিষয়ে সরকারি পদক্ষেপ অত্যন্ত জরুরি। একইসাথে দাতা সংস্থার কাছে আমার আকুল আবেদন, উক্ত এলাকাগুলোতে বসবাসকারী মানুষের জীবন মান উন্নয়নে ভূমিকা রাখে।
========================
আন্তর্জাতিক- অং সান সু চির মুক্তি ও গণতন্ত্রের পথ  শিল্প-অর্থনীতি 'আঞ্চলিক রফতানি বাণিজ্য এবং বাংলাদেশ  স্মরণ- 'সিদ্ধার্থকে মনে পড়ে' by খুশবন্ত সিং  আলোচনা- প্রসঙ্গ:বেসরকারী চ্যানেলে বিটিভি'র খবর  আলোচনা- 'আজও পাহাড় অশান্ত'  আন্তর্জাতিক- 'চীনের দৃষ্টিতে এক হবে দুই কোরিয়া ইরাকে গণতন্ত্র চাননি মুবারক'  আন্তর্জাতিক- 'তরুণদের ভবিষ্যৎ মানে দেশের ভবিষ্যৎ'  রাজনৈতিক আলোচনা- 'খালেদা জিয়ার লিখিত অনাস্থা, আপিল বিভাগের নীরবতা'  রাজনৈতিক আলোচনা- 'কেউ কথা রাখেনি এবং গণতন্ত্রের বিকট চেহারা'  বক্তব্য- তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসাবে খায়রুল হককে প্রশ্নবিদ্ধ করাই তাদের উদ্দেশ্য  শিল্প-অর্থনীতি 'করমুক্ত থাকার নানা চেষ্টা নোবেল বিজয়ীর  অনাস্থা নয়, খালেদার আশঙ্কা ছিল ন্যায়বিচার না পাওয়ার  খেলা- 'বাংলাদেশ তো আসলে জিততেই চায়নি!'  আলোচনা- 'ড. ইউনূসের কেলেঙ্কারি!'  খেলা- 'বাংলাদেশকে মাটিতে নামাল জিম্বাবুয়ে'  'ধরিত্রীকে বাঁচাতে কানকুনে সফল হতেই হবে'  স্মরণ- 'চিত্রা ভট্টাচার্যের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি'  রাজনৈতিক আলোচনা- 'আওয়ামী লীগে মিলন ও বিচ্ছেদের নাটকখবর- উইকিলিকসের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপের কথা ভাবছে যুক্তরাষ্ট্র  রাজনৈতিক আলোচনা- 'প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ সমাজের প্রত্যাশা আলোচনা- 'পায়ে পড়ি বাঘ মামা, বেঁচে থাকো'  আন্তর্জাতিক- 'পুরনো বন্ধুকে ত্যাগ করতে প্রস্তুত চীন  আমরাই পারি 'দ্বিতীয় রাজধানী' গড়তে  খবর- পুলিশি হরতাল  যুক্তি তর্ক গল্পালোচনা- 'উপদেশের খেসারত'  গল্প- 'স্বপ্নভঙ্গের ইতিবৃত্ত'


দৈনিক ইত্তেফাক এর সৌজন্যে
লেখকঃ পারভীন আফরোজা
নারী উন্নয়ন শক্তির নির্বাহী পরিচালক

এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.