গল্প- 'মাটির ব্যাংক' by পল্লব বিশ্বাস

মরা দুই ভাই। বাবা সরকারি চাকরি করেন। ঘন ঘন পোস্টিংয়ের কারণে আমাদের পড়াশোনার ক্ষতি হওয়ায় খুলনা শহরে আমাদের থাকার বন্দোবস্ত করে দিয়েছেন। আমরা দুই ভাই স্থানীয় স্কুলে পড়াশোনা করছি। আমার ছোট ভাই ভীষণ দুষ্টু। আমার পড়ার টেবিলে থাকা প্রয়োজনীয় জিনিস কখন সে নিয়ে যায়, বোঝা মুশকিল। অনেক খোঁজাখুজি করার পর ঠিকই তার গোপন স্থানে জিনিসটি খুঁজে পাওয়া যায়। ভাইয়ের দুষ্টুমিটা আমার খুবই ভালো লাগে। বাবা চাকরির কারণে বাইরে থাকেন।
মাঝেমধ্যে বাড়ি এসে আমাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে দিয়ে যান। বাবার দেওয়া টাকা জমানোর জন্য আমাদের দুই ভাইকে দুটো মাটির ব্যাংক কিনে দিয়েছেন। আমরা দুই ভাই সেই ব্যাংকে টাকা জমাই। মা-বাবার ইচ্ছে, টাকাগুলো ভালো কাজে ব্যয় করি। বাসা থেকে আমার স্কুল দূরে হওয়ায় ওই জমানো টাকা দিয়ে একটা বাইসাইকেল কিনব বলে মনে মনে স্থির করি।
স্কুলে প্রান্ত আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু। তার বাসা আমাদের বাসা থেকে অনেক দূরে, শহরতলিতে। শীতের সকাল। একদিন স্কুলে ক্লাস না হওয়ায় প্রান্ত জোর করে আমাকে তাদের বাড়িতে নিয়ে যায়।
গ্রামটি খুবই মনোরম। গাছগাছালিতে পরিপূর্ণ। তারপর ফাঁকা মাঠ। মাঠে কৃষকেরা চাষাবাদ করছে। মাঠের ঘেরের পানি কম হওয়ায় সাদা বক হেঁটে হেঁটে মাছ ধরে খাচ্ছে। কাঠঠোকরা পাখি বাবলা গাছে বসে ঠুকঠাক শব্দ করছে।
প্রান্তদের বাড়ির পাশেই জঙ্গলে পরিপূর্ণ একটা বাড়ি। সেখানে একটা সমাধি রয়েছে, যা ঘাসে ও আবর্জনায় ভর্তি। ওই বাড়িতে একটা বরইগাছ আছে। প্রান্ত বলল, ‘একটা জিনিস দেখবি?’ বলেই একটা ইটের টুকরা বরইগাছের দিকে ছুড়ে দিল।
ওই বাড়ি থেকে বৃদ্ধা এক বুড়ি কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, ‘এই, কে রে হতচ্ছাড়া, বরইগাছে ঢিল মারে! আমাকে একটু শান্তিতে থাকতে দিবি না!’
প্রান্ত হাসতে হাসতে বলল, ‘দেখেছিস?’
আমি বললাম, ‘কে বুড়িটা?’
প্রান্ত বলল, ‘বুড়িটা হাড়কিপটে। ওইটুকু ছাড়া কিছুই নেই। ওর আত্মীয়স্বজন এসে কতবার নিয়ে যেতে চাইল, কিন্তু ওই ভিটে ছেড়ে কোথাও যেতে চায় না। আমরাও কতবার বলেছি, “টাকা দিচ্ছি, জমিটা দিয়ে যাও।” কিন্তু বুড়ি নাছোড়বান্দা। ওই ভিটে ছাড়তে নারাজ। কেন জানিস? ওই যে ছেলের সমাধি আছে, তাই।’
‘চল তো, বুড়ির সঙ্গে কথা বলে আসি।’
প্রান্ত মাথা নেড়ে বলল, ‘তুই যা। ওর সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগে না।’ খানিক পর আমি আস্তে আস্তে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করলাম।
বললাম, ‘বুড়িমা আছ নাকি?’
বুড়িমা বারান্দায় শুয়ে ছিলেন। অনেক কষ্টে উঠে চশমা চোখে দিয়ে খানিকক্ষণ নিরীক্ষণ করে বললেন, ‘তুমি কে, দাদুভাই? আগে তো কখনো দেখিনি।’
আমি বারান্দায় বসতে বসতে বললাম, ‘আমি প্রান্তর বন্ধু। বেড়াতে এসেছি।’
বুড়িমা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, ‘বুড়ি হয়েছি তো, দাদুভাই, তা ছাড়া আমার তো কিছু নেই। তাই আমাকে কেউ দেখতে চায় না। আমার এই জমিটুকু সবাই চায়। কেন দেব বলো তো, দাদুভাই?’ সমাধি দেখিয়ে বললেন, ‘এই যে আমার ছেলেটা শুয়ে আছে। মুক্তিযুদ্ধ করেছে। এই স্বাধীন দেশে লাল-সবুজ পতাকা এনে দিয়েছে। তাকে কি আমি মা হিসেবে ফেলে দিতে পারি, অসম্মান করতে পারি, বল তো, দাদুভাই?’ বলেই ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন।
আমি বললাম, ‘কী হয়েছিল, বুড়িমা?’
বুড়িমা চোখ মুছে বললেন, ‘যতীন আমার ছেলে। মুক্তিযুদ্ধে যাবে। আমি যেতে দিইনি। একদিন বাড়ি থেকে পালিয়ে গেল সে। তার কয়েক দিন পর লাশ হয়ে ফিরে এল। সেই দীর্ঘ আটত্রিশ বছর ধরে ওই সমাধিতে ফুল দিয়ে আসছি, দাদুভাই। আমার আর কী আছে বলো!’
আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বললাম, ‘খুবই কষ্টের জীবন, বুড়িমা। কী করবেন? আপনার ছেলে তো দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান। এই মাটি, লাল-সবুজ পতাকা আমাদের উপহার দিয়েছে। দেবতাকে অসম্মান করে এমন সাহস কার !’
বুড়িমা চোখ মুছে গলাটা পরিষ্কার করে বললেন, ‘দাদুভাই, তাই তো ভিটেটুকু আঁকড়ে ধরে আছি। আমি মরে গেলেও আমার ছেলের সমাধিটা যেন কেউ গুঁড়িয়ে দিতে না পারে। তুমি এর দায়িত্ব নেবে, দাদুভাই?’ বলেই হাত বাড়িয়ে আমার হাতটা ধরে ফেললেন।
‘অত বড় দায়িত্ব কি আমি নিতে পারব, বুড়িমা?’
‘চেষ্টা করো, দাদুভাই। তোমরাই তো দেশের ভবিষ্যৎ।’ একটু থেমে আবার বললেন, ‘তোমার বাসা কত দূর?’
‘কেন, বুড়িমা?’
‘তোমার সঙ্গে কথা বলে বুকটা হালকা হয়েছে। যদি মাঝেমধ্যে আসতে পার। তা ছাড়া আমার শরীরটা খুবই খারাপ যাচ্ছে, কখন কী হয়, বলা যায় না। তুমি কি আজকে বিকেলে একবার আসবে?’
আমি বুড়িমাকে কথা দিয়ে বিদায় নিয়ে চলে এলাম।
বিকেলবেলা পথে বের হয়েই বুড়িমার কথা মনে পড়ল। কাউকে কিছু না বলেই সমাধিতে ফুল দেব বলে একটা ফুলের মালা কিনে নিয়ে বুড়িমার কাছে চলে এলাম। বাড়িতে ঢোকার আগেই দেখি সেখানে অনেক লোকের ভিড়। লোকজন বলাবলি করছে, ‘বুড়িটা হাড়কিপটে। এলাকার লোকজনরে তো কম জ্বালায়নি। কিছুই তো রেখে যায়নি। এখন ওর সৎকার করবে কে! বারান্দায় রেখে যাও, শিয়াল-কুকুরে খাবে।’
ভেতরে গিয়ে দেখি, বুড়িমার নিথর দেহ বিছানায় পড়ে আছে। মুখটা হাঁ করা। তাঁর মৃতদেহ থেকে কী দীপ্তি যেন বের হচ্ছে! আমার চোখে জল চলে এল। ফুলের মালাটা সমাধিতে দেব বলে এনেছিলাম, কিন্তু বীর সন্তানকে যিনি পেটে ধারণ করেছেন, তাঁর সম্মানও তো কম নয়। তাই ফুলের মালাটা বুড়িমার গলায় পরিয়ে দিলাম। চোখ মুছে উপস্থিত লোকজনকে বললাম, ‘সৎকার করতে কত খরচ হবে?’
‘তা, হাজার দেড়েক।’
আমি দ্রুত বাসার দিকে রওনা হলাম।
বাসায় ফিরে আমাদের মাটির ব্যাংক দুটো নিয়ে রওনা দিলাম। মা বারবার করে বলল, ‘ও কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস?’ আমি কোনো জবাব দিলাম না।
বুড়িমার সৎকার শেষে সন্ধ্যার পর বাসায় ফিরে দেখি, আমাকে রীতিমতো খোঁজাখুঁজি শুরু হয়ে গেছে। বাবাও বাসায় ফিরে এসেছেন।
আমি অপরাধীর মতো মাথা নত করে বাবার কাছে গিয়ে সব ঘটনা খুলে বললাম।
বাবা আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘শাবাশ বেটা! এই তো চাই। আমার ছেলে বড় হয়েছে। মানুষের কষ্ট বুঝতে শিখেছে। আমি ভীষণ খুশি হয়েছি, বাবা।’
আমি মনে মনে ভাবলাম, আমার বাইসাইকেল কেনার চেয়েও ভালো কাজে টাকাটা ব্যয় করেছি। আমিও আনন্দে কেঁদে ফেললাম। আমার কান্না দেখে আমার ছোট ভাই ও আমার মা কাঁদতে লাগল।
কয়েক দিন পরে শুনি, বুড়িমার জমিটা সরকার দখল নিয়েছে এবং সমাধিটারও সংস্কার করেছে। গর্বে আমার মন ভরে গেল। বুড়িমার আশা পূর্ণ হয়েছে।
বাবা আমাদের দুই ভাইয়ের জন্য আরও দুটো মাটির ব্যাংক কিনে দিয়েছেন এবং ব্যাংকে টাকা জমাচ্ছি। মা-বাবার ইচ্ছে, ওই টাকা যেন আরও ভালো কাজে ব্যয় হয়।
============================
গল্পসল্প- 'সাগরকে যাঁরা পোষ মানালেন'  স্মরণ- 'আমাদের সেলিনা আপা'  আলোচনা- 'বেতন-ভাতা না নেওয়ার ‘নীতিগত’ সিদ্ধান্ত নয় কেন?  ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে অভিযোগ পরীক্ষা করছে নরওয়ে  খালেদার মালপত্র আজ বুঝিয়ে দেওয়া হবে  আলোচনা- 'পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি ও অশান্তির মনস্তত্ত্ব'  সাক্ষাৎকার- পাহাড়ে পাহাড়িদের সংখ্যালঘু করা হচ্ছে  আলোচনা- 'শান্তিচুক্তির ১৩ বছর'  রাজনৈতিক আলোচনা- 'উন্মত্ত নৈরাজ্যের শক্তি বনাম সোনালি সম্ভাবনা'  আলোচনা- ''ট্রানজিট' না 'করিডোর' না 'কানেকটিভিটি'  আলোচনা- 'ওরাও মানুষ আছে ওদের অধিকার'  আন্তর্জাতিক- অং সান সু চির মুক্তি ও গণতন্ত্রের পথ  শিল্প-অর্থনীতি 'আঞ্চলিক রফতানি বাণিজ্য এবং বাংলাদেশ  স্মরণ- 'সিদ্ধার্থকে মনে পড়ে' by খুশবন্ত সিং  আলোচনা- প্রসঙ্গ:বেসরকারী চ্যানেলে বিটিভি'র খবর  আলোচনা- 'আজও পাহাড় অশান্ত'  আন্তর্জাতিক- 'চীনের দৃষ্টিতে এক হবে দুই কোরিয়া ইরাকে গণতন্ত্র চাননি মুবারক'  আন্তর্জাতিক- 'তরুণদের ভবিষ্যৎ মানে দেশের ভবিষ্যৎ'  রাজনৈতিক আলোচনা- 'খালেদা জিয়ার লিখিত অনাস্থা, আপিল বিভাগের নীরবতা'  রাজনৈতিক আলোচনা- 'কেউ কথা রাখেনি এবং গণতন্ত্রের বিকট চেহারা'  বক্তব্য- তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসাবে খায়রুল হককে প্রশ্নবিদ্ধ করাই তাদের উদ্দেশ্য  শিল্প-অর্থনীতি 'করমুক্ত থাকার নানা চেষ্টা নোবেল বিজয়ীর  অনাস্থা নয়, খালেদার আশঙ্কা ছিল ন্যায়বিচার না পাওয়ার  খেলা- 'বাংলাদেশ তো আসলে জিততেই চায়নি!'  আলোচনা- 'ড. ইউনূসের কেলেঙ্কারি!'  খেলা- 'বাংলাদেশকে মাটিতে নামাল জিম্বাবুয়ে'


দৈনিক প্রথম আলো এর সৌজন্যে
লেখকঃ পল্লব বিশ্বাস
খুলনা পাবলিক কলেজ, খুলনা


এই গল্প'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.