স্মরণ- 'আমাদের সেলিনা আপা' by শামীম আহমেদ

খনো মন বিশ্বাস করতে চায় না, বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়—কথার সাগর, সদা কলকণ্ঠমুখর, সদা হাস্যময় প্রাণপ্রিয় সেলিনা আপা আমাদের মাঝে নেই ছয়-ছয়টি বছর ধরে। মনে হয়, এই তো সেদিন ফোনে জানতে চাইলেন, ‘কখন আসছ? নাকি আমি চলে আসব টিএসসিতে।’ পরক্ষণেই বলতেন, ‘তুমিই বরং চলে এসো। চা খেয়ে, তারপর একসঙ্গে বের হব।’
আমি যেন আজও তাঁর ডাকের আশায় থাকি। প্রহর গুনি তীর্থের কাকের মতো। এখনই বুঝি বলবেন, ‘আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করছি, চলে এসো।’ কী অদ্ভুত সম্মোহন! এড়ানো বড় কঠিন সেই ডাক। শত ব্যস্ততার মধ্যেও ছুটে যেতে হতো তাঁর ডাকে। কিন্তু ডাক তো আর আসে না। কোথায় কোন স্বপ্নলোকে হারিয়ে গেছেন আমাদের প্রাণপ্রিয় সেলিনা আপা। কেননা, তিনি যে ঢেউয়ের মতো ভেসে গেছেন চাঁদের আলোর দেশে। সত্যি কথা বলতে কি, আমরা কেউ-ই তাঁর এই হঠাৎ চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। হয়তো তিনি নিজেও। কেননা, তাঁর যে অনেক কিছু দেওয়ার ছিল এই সমাজকে। তিনি যে উজাড় করে দিতে বড় বেশি ভালোবাসতেন, কর্তব্য মনে করতেন। অসহায় মানুষের জন্য কিছু করতে তাঁর সংবেদনশীল মন সব সময় খুঁজে ফিরত ক্ষুধার্ত শীতার্ত সহায়সম্বলহীন আদমসন্তান। যেখানে মানবতা বিপন্ন, সেখানেই তাঁর নীরব উপস্থিতি ছিল অনিবার্য। অসময়ে এই প্রিয় মানুষটিকে হারিয়ে আজ আমরা তাঁর প্রিয়জনেরা সত্যিই বিপন্ন।
একজন ঐতিহ্যসচেতন মানুষ ছিলেন সেলিনা বাহার জামান। তিনি সারা জীবনের সঞ্চিত অর্থ ব্যয় করে, আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে, একান্ত ভালোবাসায় যেসব স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ করে গেছেন, আগামী প্রজন্ম তাঁর সেই অসামান্য অবদানের কথা মনে রাখবে। সেলিনা বাহার জামানের বড় গুণ ছিল, তিনি অমায়িক, বন্ধুবৎসল ও সদালাপী। আর তিনি তা পেয়েছিলেন উত্তরাধিকার সূত্রে।
বঙ্গীয় মুসলিম-সমাজে অগ্রবর্তী পরিবার বলতে যা বোঝায়, সেলিনা বাহারের পরিবার ছিল তারই প্রতীক। কৃতী ভাইবোন শামসুন্নাহার মাহমুদ (সেলিনা বাহার জামানের ফুপু) ও হবীববুল্লাহ বাহার চৌধুরী (তাঁর বাবা) ছিলেন বহুবিধ কর্মকাণ্ডের সাথি ও কান্ডারি। শিল্প-সংস্কৃতি, ক্রীড়া—সব ক্ষেত্রেই ছিল তাঁদের অবাধ বিচরণ।
বন্ধুবৎসল ও আড্ডাপ্রিয় এই মানুষটিকে ঘিরে বিশাল এক সারস্বতবৃত্ত গড়ে উঠেছিল। কবি কাজী নজরুল ইসলামের ঘনিষ্ঠ সুহূদ, চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখলের অন্যতম নায়ক অনন্ত সিংহের একান্ত বান্ধব, কলকাতা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব ফুটবল দলের অধিনায়ক এবং বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমাজের নিষ্ঠাবান সংগঠক হবীবুল্লাহ বাহার ছিলেন উদ্যোগী, উদারবাদী মুসলিম তরুণসমাজের মধ্যমণি। মা আনোয়ারা বাহার চৌধুরী ছিলেন সাহিত্যানুরাগী, সুলেখিকা ও বিশিষ্ট শিক্ষাব্রতী। মা-বাবার এই যুগল প্রতিভার ছায়া পড়েছিল কন্যা সেলিনা বাহারের ওপর। সেই সঙ্গে ছিল বেগম রোকেয়া-প্রাণিত কর্মদ্যোগী বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ফুপু শামসুন্নাহার মাহমুদের অসীম প্রেরণা, যা তিনি পালন করেন আজীবন।
আজীবন সবাই তাঁকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে। ঐতিহ্যবিস্মৃত জাতির সামনে ইতিহাসের প্রায় একেকজন ভুলে যাওয়া মহীরূহকে একান্ত শ্রদ্ধাভরে উপস্থাপন করেছেন তিনি। তাঁর সৃজনশীল হাতের স্পর্শে প্রায় ভুলে যাওয়া মহৎ ব্যক্তিরা তাঁদের ঐশ্বর্য ও সৌকর্যে দীপ্ত হয়ে নতুনভাবে আমাদের সামনে এসেছেন এবং সেই পূর্ব পুরুষদের অগাধ পাণ্ডিত্য ও ত্যাগ-তিতিক্ষার কাহিনি পড়ে এই প্রজন্ম গর্ব, শ্রদ্ধা ও আনন্দে শিহরিত হয়েছে বারবার।
সেলিনা বাহার জামান ছিলেন প্রিয় ও পরিচিত নাম। তিনি তাঁর সময়ের অগ্রগামী মানুষ ছিলেন। স্বনামধন্য নৃত্যশিল্পী, আবৃত্তিকার, উপস্থাপক ও কৃতী অধ্যাপক প্রবন্ধ, স্মৃতিকথা, সমসাময়িক নানা বিষয় ও শিশু-কিশোরদের নিয়ে লিখেছেন অজস্র লেখা। তিনি ছিলেন একজন দক্ষ সম্পাদক এবং বেগম রোকেয়া, বেগম শামসুন্নাহার মাহমুদ, আনোয়ারা বাহার চৌধুরী, শামসুদ্দীন আবুল কালাম, ওয়াহাবউদ্দীন মাহমুদ, শওকত ওসমান, হবীবুল্লাহ বাহার চৌধুরীসহ অসংখ্য স্মারকগ্রন্থ সম্পাদিত হয়েছে তাঁর সুনিপুণ হাতে। ১৯৯০-এর দশকে ভোরের কাগজ-এ হূদয় উৎসারিত ধারাবাহিক রচনা ‘কয়েক ছত্র প্রাণের পত্র’ এবং সংবাদ-এ ‘পথে চলে যেতে যেতে’ পাঠকসমাজে বিপুলভাবে সমাদৃত হয়েছে।
মনে পড়ছে তাঁর শেষ দিনগুলোর কথা। ২৫ নভেম্বর আমি তাঁর বাড়িতে গেলাম। দুপুরে একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করে কামরুন্নাহার স্কুলে গেলাম। সেখানে তাঁর মায়ের নামে বৃত্তি দেওয়া হয়, সেই টাকা দিয়ে সেলিনা আপা আমাকে টিএসসিতে নামিয়ে দিলেন। যাওয়ার আগে বললেন, ‘সোমবার সকালে চলে এসো, আমরা নাস্তা খেয়ে বনানীর বাড়ি দেখতে যাব।’ তখন বনানীতে তাঁদের বাড়ি তৈরি হচ্ছিল। আমি সোমবারের জন্য অপেক্ষা করছিলাম, কিন্তু তাঁর আগেই ১ ডিসেম্বর ভোরবেলা প্রতীতি দেবীর (মাসিমা) টেলিফোনে জানতে পারলাম, সেলিনা আপা আর নেই। আজ (৩ ডিসেম্বর) বিকেল চারটায় বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের বেগম সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে সেলিনা বাহার জামান স্মারক পঞ্চম বক্তৃতা হবে। স্মারক বক্তা বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান। তাঁকে আজ আমরা স্মরণ করব। আপনিও আসুন জাদুঘরে।
==========================
আলোচনা- 'বেতন-ভাতা না নেওয়ার ‘নীতিগত’ সিদ্ধান্ত নয় কেন?  ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে অভিযোগ পরীক্ষা করছে নরওয়ে  খালেদার মালপত্র আজ বুঝিয়ে দেওয়া হবে  আলোচনা- 'পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি ও অশান্তির মনস্তত্ত্ব'  সাক্ষাৎকার- পাহাড়ে পাহাড়িদের সংখ্যালঘু করা হচ্ছে  আলোচনা- 'শান্তিচুক্তির ১৩ বছর'  রাজনৈতিক আলোচনা- 'উন্মত্ত নৈরাজ্যের শক্তি বনাম সোনালি সম্ভাবনা'  আলোচনা- ''ট্রানজিট' না 'করিডোর' না 'কানেকটিভিটি'  আলোচনা- 'ওরাও মানুষ আছে ওদের অধিকার'  আন্তর্জাতিক- অং সান সু চির মুক্তি ও গণতন্ত্রের পথ  শিল্প-অর্থনীতি 'আঞ্চলিক রফতানি বাণিজ্য এবং বাংলাদেশ  স্মরণ- 'সিদ্ধার্থকে মনে পড়ে' by খুশবন্ত সিং  আলোচনা- প্রসঙ্গ:বেসরকারী চ্যানেলে বিটিভি'র খবর  আলোচনা- 'আজও পাহাড় অশান্ত'  আন্তর্জাতিক- 'চীনের দৃষ্টিতে এক হবে দুই কোরিয়া ইরাকে গণতন্ত্র চাননি মুবারক'  আন্তর্জাতিক- 'তরুণদের ভবিষ্যৎ মানে দেশের ভবিষ্যৎ'  রাজনৈতিক আলোচনা- 'খালেদা জিয়ার লিখিত অনাস্থা, আপিল বিভাগের নীরবতা'  রাজনৈতিক আলোচনা- 'কেউ কথা রাখেনি এবং গণতন্ত্রের বিকট চেহারা'  বক্তব্য- তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসাবে খায়রুল হককে প্রশ্নবিদ্ধ করাই তাদের উদ্দেশ্য  শিল্প-অর্থনীতি 'করমুক্ত থাকার নানা চেষ্টা নোবেল বিজয়ীর  অনাস্থা নয়, খালেদার আশঙ্কা ছিল ন্যায়বিচার না পাওয়ার  খেলা- 'বাংলাদেশ তো আসলে জিততেই চায়নি!'  আলোচনা- 'ড. ইউনূসের কেলেঙ্কারি!'  খেলা- 'বাংলাদেশকে মাটিতে নামাল জিম্বাবুয়ে'  'ধরিত্রীকে বাঁচাতে কানকুনে সফল হতেই হবে'  স্মরণ- 'চিত্রা ভট্টাচার্যের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি'


দৈনিক প্রথম আলো এর সৌজন্যে
লেখকঃ শামীম আহমেদ


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.