স্মৃতি ও গল্প- ছিন্নস্মৃতি by দ্বিজেন শর্মা

ত্তর বছর আগের পাঠশালার স্মৃতিচারণা, দীর্ঘবিস্মৃতির আবরণ উন্মোচন, কঠিন হলেও দুঃসাধ্য নয়, কেননা কিছু কিছু কৈশোরস্মৃতি মস্তিষ্কে আমৃত্যু ধৃত থাকে এবং হূদয়েও। আমাদের গ্রামটি সিলেটের প্রত্যন্ত এলাকায়, পাহাড়ঘেঁষা অন্য দশটি গ্রামের মতোই, আকারে ছোট, টিলাটালা ও গাছগাছালিতে ভরা, ছোট একটি স্রোতস্বিনী, সচ্ছল-অসচ্ছল জনগোষ্ঠী, সমসংখ্যক হিন্দু-মুসলমান, আমার ছেলেবেলার স্বপ্নরাজ্য।
পূর্ব কিনারে আসাম-বেঙ্গল রেলপথ, একটি স্টেশন ও সামান্য দূরে ঘাটাঘর আর ওখানেই আমাদের পাঠশালা—আবদুল লতিফ সিদ্দিকী প্রাথমিক বিদ্যালয়। ওই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন বিখ্যাত মৌলানা, হায়দ্রাবাদ রাজ্যের নিজামের সভাসদ, তাঁর মুরিদবর্গ ছিল সারা ভারতে।
প্রথম পাঠশালা-যাত্রা, মনে আছে, ইনাই চাচার কোলে চড়ে। তিনি ছিলেন আমাদের সংসারেরই একজন। ছোটদের অভিভাবকের মতো, আমাদের সম্ভব-অসম্ভব আবদার মেটাতে কসুর করতেন না। মোটাসোটা গড়ন, হাতে লাঠি ইনাই চাচাকে গ্রামের লোকজন কেন জানি সমীহ করত, এমনকি পাঠশালার মাস্টারমশাইও। মাঝেমধ্যে স্কুলেও হানা দিতেন এবং মাস্টারমশাইকে শাসাতেন যেন আমাকে বকাঝকা না করেন। কিশোরকালের স্মৃতিভুবনে তিনি আছেন অনেকটা জায়গাজুড়ে, তাঁকে নিয়ে বড় একটা গল্প লেখাও যায়।
স্কুল বলতে একটিই টিনের ঘর, লম্বা বারান্দা, সামনে রাস্তা, তারপর একসার আমগাছ, পেছনে উঠোন, এক পাশে একটি কাঁঠালগাছ, অন্য পাশে নাগেশ্বর, শেষ মাথায় বাঁশ ও গাছগাছালির জঙ্গল। পুরো ঘরে একটিই শ্রেণীকক্ষ, প্রধান শিক্ষক নীরদচন্দ্র শর্মা, সর্বদাই অগ্নিশর্মা, সহকারী আছদ্দর আলী একেবারেই উল্টো, সর্বদাই স্নেহসিক্ত। ‘বেত নেই তো ছেলে নষ্ট’—আদর্শনির্ভর সেকালের পাঠশালাগুলো ছিল কিশোরদের জন্য আনন্দহীন অকুস্থল।
স্কুলে যেতাম শেক্সপিয়রের মতো ‘শম্বুকগতিতে পা দুটি টেনে টেনে’ একান্ত অনিচ্ছায়। বেঞ্চিতে বই-শ্লেট রেখেই রেললাইনে ছোটা, উত্তরমুখে একদৃষ্টিতে দাঁড়ানো, মনে দুরাশা—যদি তিনি না আসেন। কিন্তু বৃথা, অনিবার্য ছিল সেই আগমন। ক্ষণিক পরেই চোখে পড়ত পতপত উড়ছে সাদা ধুতির খুঁট, আখেরি নিশান। ছুটে গিয়ে বেঞ্চিতে বসতাম পাথরখণ্ডের মতো। কেন তাঁকে এত ভয় পেতাম? খুব যে মারধর করতেন তাও না। তবে? সেকালে গুরুজনদের ভয় পাওয়ার যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল সম্ভবত সে জন্য। তবে এমন শিক্ষক সেকালেও ছিলেন, আজও আছেন, যাঁরা স্বভাবগুণেই নিষ্ঠুর।
আজকাল অনেক ছেলেমেয়েরই বাড়ির চেয়ে স্কুলের প্রতি অধিক পক্ষপাত দেখি। আমাদের সময় কিন্তু এমনটি একেবারেই ছিল না। অভিভাবকেরা ছেলেদের শিক্ষকের হাতে সঁপে দিয়ে বলতেন—প্রাণটা আমার, শরীরটা আপনার। এমন বন্দোবস্ত যেখানে, সেখানে কার যেতে ইচ্ছে হবে! তাই স্কুল ফাঁকি দেওয়ার নানা অজুহাত খুঁজতাম আর মোক্ষম ছিল পেটব্যথা ও জ্বরজ্বর ভাব। এগুলো শনাক্তির কোনো নির্ভরযোগ্য উপায় না থাকায় রেহাইও মিলত, কিন্তু পরিণতি সর্বদা শুভ হতো না। এমনটি একাধিকবার ঘটেছে—মা সামান্য পরীক্ষা করে স্কুলে না-যাওয়ার আরজি মঞ্জুর করেছেন, একসময় পালিয়ে বাড়ির পেছনের জঙ্গলে খেলায় বিভোর, তখনই মায়ের হাঁকডাক, একান্ত অনিচ্ছায় ঘরে ফিরে দেখি উঠোনে জনাতিনেক গাট্টাগোট্টা ছাত্র, যথার্থ যমদূত, স্কুলে নাকি ‘বাবু’ অর্থাৎ পরিদর্শক আসবেন, তাই হাজিরা একান্ত আবশ্যক। নিদয়া মা অসুখের কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে প্যান্ট-জমা পরিয়ে ওদের হাতেই যখন তুলে দিতেন, মরে যেতে ইচ্ছে হতো।
সে ছিল এক দুঃসহ যাত্রা, পা চলত না, বুক ধড়ফড় করত, গলা শুকিয়ে যেত, চলতাম হাড়িকাঠে নেওয়া বলির পাঁঠার মতো। স্কুলের কাছে পৌঁছালে একটা গুনগুন আওয়াজ কানে আসত, সেই সঙ্গে মাঝেমধ্যে নীরদ শর্মার তর্জন-গর্জন। শরীর ঠান্ডা হয়ে যেত, দাঁড়িয়ে পড়তাম। সঙ্গীরা ঠেলে, কখনো পাঁজাকোলা করে সেই যমালয়ে হাজির করত। অভ্যর্থনা কেমন ঘটত বলাই বাহুল্য। বাবু আসা, জানতাম আগেই, সব মিথ্যা। এমনই ছিল আমাদের সময় স্কুল ফাঁকির ‘অপরাধ ও শাস্তি’।
বাবু আসার সত্যিকার ব্যাপার ছিল সম্পূর্ণ অন্য রকম। দু-তিন দিন তখন সে রকম পড়াশোনা হতো না, তর্জন-গর্জন না, ছাত্রদের কিছু প্রশ্নোত্তর শেখানো হতো বাবু যেগুলো জিজ্ঞেস করতে পারেন। একসময় আমাদের আমতলায় পাঠানো হতো ক্লাসের ফার্স্টবয় মাখমদের জিম্মায়। সে আমাদের নামতা শেখাত এক একে এক, দুই একে দুই...। কখনো চলত মানসাঙ্কের মহড়া। মাস্টারমশাই স্কুলঘর সাজাতেন নিজের আঁকা চমৎকার সব ছবি দিয়ে। তাতে থাকত গ্রাম, থানা, মহকুমা, জেলা, উপত্যকা, প্রদেশ এবং বর্মা ও সিংহলসহ ভারতবর্ষের রঙিন ম্যাপ আর সেই সঙ্গে ফুল-ফল, জীবজন্তু, পাখপাখালির ছবি। সারা ঘর ঝলমলিয়ে উঠত। ভেবে অবাক হতাম, কীভাবে ছাপার মতন এমন ছবি আঁকেন তিনি। নির্দিষ্ট দিনে স্যুটকোট পরা বাবু আসতেন, দেখতাম শিক্ষকেরাও তাঁকে ভয় পান, খাতাপত্র দেখাতে তাঁদেরও হাত কাঁপে, সর্বক্ষণ জড়সড় থাকেন। ছাত্রদের তিনি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতেন, ভালো ছাত্ররাই আগবেড়ে উত্তর দিত। ব্যাপারটা প্রায় সর্বদাই নির্বিঘ্নে শেষ হতো এবং একদিনের ছুটির ঘোষণা দিয়ে বাবু বিদায় নিতেন।
ছবিগুলো আরও কয়েকদিন দেয়ালে ঝুলত। ময়নার একটি ছবি ছিল আমার বেঞ্চির সামনের খুঁটিতে। ওটি থেকে কেন যেন চোখ ফেরাতে পারতাম না। পাখিটি ধীরে ধীরে আমাকে জাদু করে ফেলল। ঘরে বিকেলে আলো ছড়িয়ে পড়লে মনে হতো সে জীবন্ত হয়ে উঠছে, নড়াচড়া শুরু করেছে। একসময় ছবির ময়না ঘরে উড়তেও লাগত, ওর ডাকও স্পষ্ট শুনতে পেতাম। কেউ কোথাও নেই, আমি সম্বিতহারা। তারপর মাথায় মাস্টারমশায়ের হাতের স্নেহ স্পর্শে হুঁশ হতো। ‘কী দেখছিস পাগলের মতো, স্কুল কখন ছুটি হয়ে গেছে, বাড়ি যা।’ এখন ভাবি ছবির ওই পাখিটিই কি প্রকৃতির সঙ্গে সারা জীবনের মতো আমার গাঁটছড়া বেঁধে দিয়েছিল?
পাঠশালায় আমারও বৃত্তিপরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল। মাস্টারমশায় আমি আর মাখমদকে অনেক দিন ধরে ছুটির পর নিয়মিত পড়িয়েছিলেন। কিন্তু আমার পরীক্ষা দেওয়া হয়নি। যন্ত্রজগৎ সম্পর্কে অবিশ্বাসী পিতৃদেব কেন জানি নিশ্চিত ছিলেন যে শহরে গেলে গাড়িচাপা পড়ে আমার অপঘাতমৃত্যু অনিবার্য। নীরদ শর্মার অনুনয়-বিনয়, অনুরোধ-উপরোধ কোনো কাজেই আসেনি। মাস্টারমশায়ের এই প্রথম চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় মনে বড় একটা আঘাত পেয়েছিলেন। মাখমদ শহরে গিয়ে পরীক্ষা দিয়ে নিরাপদেই ফিরে এসেছিল, বৃত্তি অবশ্য পায়নি, আমি গেলেও পেতাম না। সেকালে বৃত্তিলাভের সৌভাগ্য মোটেও সহজ ছিল না। আমি ও মাখমদ ছাড়া আমাদের ক্লাসে আরও কজন ভালো ছাত্র ছিল। মুচদ্দর ও মখদ্দচের কথা মনে আছে। সবাই পাঠশালা ভালোই পাস করেছিল, কিন্তু আমি ছাড়া কেউই হাইস্কুলের আঙিনা মাড়ায়নি। তখনকার গ্রামাঞ্চলের কৃষিনির্ভর নিম্নবিত্ত সমাজে ইংরেজি শিক্ষার তেমন কদর ছিল না। মায়ের অনমনীয় জেদের জন্যই আমার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ঘটেছিল, নইলে আমাকেও কোনো টোলে পাঠিয়ে শেষ পর্যন্ত পারিবারিক কবিরাজি পেশা জোয়ালে জুতে দেওয়া হতো।
পাঠশালা পেরিয়ে হাইস্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় টপকে, শেষে বহু দূরে চাকরি, তারপর বিদেশে। বহুদিন পর বাড়ি ফিরেছি। স্টেশনে আমার সঙ্গেও নামল কয়েকজন। কেউ আমাকে চেনে না। প্লাটফর্ম খালি হলে হাঁটতে শুরু করি এবং একসময় আমাদের পাঠশালার কাছে পৌঁছে রেললাইনে দাঁড়িয়ে উত্তরে তাকাই। না, সাদা ধুতির কোনো খুঁট চোখে পড়ে না। জানি পড়বে না কোনো দিন। স্কুলের সামনে এসে থামি। নামটি বদলে গেছে, বাদ পড়েছেন এককালের নমস্য মৌলানা সাহেব। কী আশ্চর্য! হঠাৎ শুনতে পাই মাখমদের গলার আওয়াজ—এক একে এক...তারপর আমরা দুজনে গলাগলি করে হাঁটি, গল্প করি, দেখি ছবির ওই ময়নাটিও জুটে গেছে, উড়ে চলেছে আমাদের সঙ্গে। আমরা পৌঁছে যাই বারোয়ারি গোরস্থানে। শেষ রাতে ট্রেন ধরার সময় কতবার জায়গাটা চোখবুঝে দৌড়ে পার হয়েছি। সম্বিত ফিরলে দেখি কেউ নাই, মাখমদ ও ময়না আমাকে ফেলে চলে গেছে। ভাবি মাখমদ বেঁচে আছে তো! আবার হাঁটি। দশ মিনিটের পথ আর ফুরোয় না, বাড়িটা যেন যোজন যোজন দূর।
=======================
স্মৃতি ও গল্প- স্কুল জীবনে বাঁকুড়া, জলপাইগুড়ি ও যশোর  ফিচার- তাঁহাদের দান  ফিচার- ডায়ানার আংটি  গল্প- 'অভিমান'  গল্প- 'মাটির ব্যাংক'  গল্পসল্প- 'সাগরকে যাঁরা পোষ মানালেন'  স্মরণ- 'আমাদের সেলিনা আপা'  আলোচনা- 'বেতন-ভাতা না নেওয়ার ‘নীতিগত’ সিদ্ধান্ত নয় কেন?  ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে অভিযোগ পরীক্ষা করছে নরওয়ে  খালেদার মালপত্র আজ বুঝিয়ে দেওয়া হবে  আলোচনা- 'পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি ও অশান্তির মনস্তত্ত্ব'  সাক্ষাৎকার- পাহাড়ে পাহাড়িদের সংখ্যালঘু করা হচ্ছে  আলোচনা- 'শান্তিচুক্তির ১৩ বছর'  রাজনৈতিক আলোচনা- 'উন্মত্ত নৈরাজ্যের শক্তি বনাম সোনালি সম্ভাবনা'  আলোচনা- ''ট্রানজিট' না 'করিডোর' না 'কানেকটিভিটি'  আলোচনা- 'ওরাও মানুষ আছে ওদের অধিকার'  আন্তর্জাতিক- অং সান সু চির মুক্তি ও গণতন্ত্রের পথ  শিল্প-অর্থনীতি 'আঞ্চলিক রফতানি বাণিজ্য এবং বাংলাদেশ  স্মরণ- 'সিদ্ধার্থকে মনে পড়ে' by খুশবন্ত সিং  আলোচনা- প্রসঙ্গ:বেসরকারী চ্যানেলে বিটিভি'র খবর  আলোচনা- 'আজও পাহাড় অশান্ত'  আন্তর্জাতিক- 'চীনের দৃষ্টিতে এক হবে দুই কোরিয়া ইরাকে গণতন্ত্র চাননি মুবারক'  আন্তর্জাতিক- 'তরুণদের ভবিষ্যৎ মানে দেশের ভবিষ্যৎ'  রাজনৈতিক আলোচনা- 'খালেদা জিয়ার লিখিত অনাস্থা, আপিল বিভাগের নীরবতা'  রাজনৈতিক আলোচনা- 'কেউ কথা রাখেনি এবং গণতন্ত্রের বিকট চেহারা'  বক্তব্য- তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসাবে খায়রুল হককে প্রশ্নবিদ্ধ করাই তাদের উদ্দেশ্য


দৈনিক প্রথম আলো এর সৌজন্যে
লেখকঃ দ্বিজেন শর্মা


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.