বঙ্গবন্ধু স্বমহিমায় ভাস্বর by ইকতেদার আহমেদ

বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি অবিস্মরণীয় নাম। বঙ্গবন্ধু একজন ক্ষণজন্মা পুরুষ। এ ধরাতে বঙ্গবন্ধুর বিচরণ ছিল স্বল্পকালীন। এ স্বল্প সময়ে তিনি বিভিন্ন চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্য দিয়ে যেমন খ্যাতির সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছেছিলেন; আবার এর বিপরীতে বিভিন্ন টানাপড়েনে মৃত্যুর দু’বছর আগে থেকে তার জনপ্রিয়তায় ব্যাপক ভাটা পড়েছিল। বঙ্গবন্ধুর জন্মের আগে বাঙালি জাতির ইতিহাসে তার মতো কিংবদন্তিসম ব্যক্তিত্বের জন্ম হয়নি এবং তার মৃত্যুর পর এমন ব্যক্তিত্বের জন্ম হবে কি না, তা আপাতদৃষ্টিতে প্রতিভাত নয়। বাংলাদেশের মুক্তি তথা স্বাধীনতা সংগ্রাম বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তার নামেই পরিচালিত হয়েছিল এবং স্বাধীনতার ঘোষণাটিও অকুতোভয় সেনাকর্মকর্তা তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর পক্ষেই দিয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর জন্ম ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ। তিনি তদানীন্তন ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়া থানার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধুর বাবা শেখ লুৎফর রহমান দেওয়ানি আদালতে পেশকার পদে কর্মরত ছিলেন এবং অবসর গ্রহণের আগে তিনি সেরেস্তাদার পদে উন্নীত হয়েছিলেন। পেশকার ও সেরেস্তাদার পদ দু’টি আমাদের দেওয়ানি আদালতগুলোতে এ উপমহাদেশে শের শাহের শাসনকাল থেকে চালু রয়েছে। শের শাহের শাসনামলে দেওয়ানি আদালতের বিচারকদের মুন্সেফ বলা হতো। দেওয়ানি আদালতের এ পদবিটি আমাদের দেশে ১৯৮৬ অবধি চালু ছিল। তখন এ পদবিটি ‘সহকারী জজ’ নামে স্থলাভিষিক্ত হয়। দেওয়ানি আদালতে পেশকার ও সেরেস্তাদারÑ এ দু’টি পদবি এখনো অব্যাহত আছে। দেওয়ানি আদালতে বিচারকালীন পেশকারের মাধ্যমে বিচারকের সম্মুখে নথি উপস্থাপন করা হয়। অপর দিকে, মামলা রুজুসংক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রম সেরেস্তাদারের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয়।
বঙ্গবন্ধু তার শৈশবকাল থেকেই বাবা-মা উভয়ের প্রতি খুবই শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী পদে বহাল থাকাকালে তার বাবা-মায়ের মৃত্যু হয়। একজন সুযোগ্য ও আদর্শ সন্তান যেভাবে বাবা-মার সেবা শুশ্রƒষা করে থাকেন, বঙ্গবন্ধুর ক্ষেত্রে কোনো দিক থেকে এর কমতি পরিলক্ষিত হয়নি।
বঙ্গবন্ধুর বাবা শেখ লুৎফর রহমান ধর্মীয় জাতিসত্তায় বিশ্বাসী ছিলেন আরো অনেকের মতো এবং বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে উল্লেখ রয়েছেÑ একদা পিতা শেখ লুৎফর রহমান পুত্র শেখ মুজিবুর রহমানকে বলেছিলেন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে এ দেশে মুসলমানদের অস্তিত্ব থাকবে না। বঙ্গবন্ধু সর্বপ্রথম ১৮ বছর বয়সে ১৯৩৮ সালে কারাবরণ করেছিলেন। তখন তার অপরাধ ছিল, হিন্দু ও মুসলমান যুবকদের মধ্যে বিরোধে তিনি মুসলমানদের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে তাদের অধিকারের ব্যাপারে সোচ্চার ছিলেন। বঙ্গবন্ধু তার দৃঢ়তা ও নেতৃত্বের গুণের কারণে ছাত্র বয়সেই অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর একান্তে সান্নিধ্যে আসতে সমর্থ হয়েছিলেন। সোহরাওয়ার্দী অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে ১৯৪৬ সালে কলকাতায় হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে যে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয়েছিল, তাতে বিপন্ন মুসলিম নর-নারীদের জীবন রক্ষায় বঙ্গবন্ধু নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। সে সময় বঙ্গবন্ধুর সাহসিকতায় সোহরাওয়ার্দী এতই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, বাংলায় দাঙ্গা অবসান-পরবর্তী বিহারে দাঙ্গা আরম্ভ হলে তিনি বিহারের রাজধানী পাটনা থেকে দাঙ্গায় আহত সহস্রাধিক মুসলিম নর-নারীকে বর্ধমানের আসানসোল নিয়ে আসার জন্য বঙ্গবন্ধুকে পাঠিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু এ কাজটিও নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাহসিকতা ও সাফল্যের সাথে সমাধা করেছিলেন।
অবিভক্ত ভারতের মুসলিম লীগের ছাত্র সংগঠনের সদস্য হিসেবে বঙ্গবন্ধুর রাজনীতিতে হাতেখড়ি হলেও পাকিস্তান সৃষ্টির অব্যবহিত পর তিনি এ দেশের প্রথম বিরোধী দল আওয়ামী মুসলিম লীগে যোগদান করেন। আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে পরে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেয়া হয়। ১৯৫৪ সালে তিনি কিছু সময়ের জন্য শেরে বাংলার নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্টের প্রাদেশিক মন্ত্রিসভার সদস্য হয়েছিলেন। পাকিস্তান শাসনামলে ’৫৪ ও ’৫৬ সালে কিছু সময়ের জন্য প্রাদেশিক সরকারের মন্ত্রী হওয়া ব্যতীত অবশিষ্ট সময়ের বেশির ভাগ তিনি কারান্তরীণ ছিলেন।
১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তদানীন্তন পূর্ব-পাকিস্তানের নাগরিকদের অধিকারের প্রশ্নে যে ৬ দফা দাবি উত্থাপন করা হয়েছিল, এটিকে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী ভালো চোখে দেখেনি। বঙ্গবন্ধুকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িত করা পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর একটি ঐতিহাসিক ভুল ছিল। এ মামলা বঙ্গবন্ধুকে আওয়ামী লীগের একচ্ছত্র নেতৃত্বের আসনে সমাসীন করে। ছাত্রজনতার দুর্বার আন্দোলনে ১৯৬৯ সালে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুকে কারান্তরীণ অবস্থা থেকে মুক্তি দিয়েছিল। মুক্তি পাওয়ার পর বঙ্গবন্ধু তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের সব জেলা সফরের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এ উদ্যোগের অংশ হিসেবে তিনি নোয়াখালী জেলা সফর করেন। সে সময় আমি নোয়াখালী জিলা স্কুলের নবম শ্রেণীর ছাত্র । তখন দেশে সামরিক শাসন থাকায় উন্মুক্ত স্থানে জনসভা নিষিদ্ধ ছিল। তাই নোয়াখালী শহরের রওশন বাণী সিনেমা হলে সভার ব্যবস্থা করা হয়। নোয়াখালী জিলা স্কুল ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে সে সভায় আমি উপস্থিত ছিলাম। সভার পরদিন সকালে বঙ্গবন্ধু জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাংগঠনিক সম্পাদক মরহুম শহীদ উদ্দিন এসকান্দার কচি ভাইয়ের বাসায় এসেছিলেন। কচি ভাই ছিলেন আমার বড় ভগ্নিপতি। তিনি নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অ্যাডভোকেট সেকান্দারের দ্বিতীয় ছেলে। কচি ভাই তার বাসার বৈঠকখানায় বঙ্গবন্ধুর সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিলে তার সাথে করমর্দন করি। আমি ছাত্রলীগের একজন কর্মীÑ বঙ্গবন্ধুকে এ কথা বলার পর, তিনি বলেন, তোমাদের ভালোভাবে লেখাপড়া করতে হবে। কারণ, আমরা বাঙালিরা চাকরি ও ব্যবসার ক্ষেত্রে পাকিস্তানের পশ্চিমাংশের চেয়ে অনেক পিছিয়ে রয়েছি।
পাকিস্তানের ১৯৭০ সালের নির্বাচন বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগকে কেন্দ্র ও প্রদেশে বিপুল বিজয় এনে দেয়। কিন্তু নানামুখী ষড়যন্ত্রের কারণে তার কাছে শাসনক্ষমতা হস্তান্তর না করায় তা শেষ অবধি বাঙালির মুক্তি তথা স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপ নেয়।
২৫ মার্চ, ১৯৭১-এর রাতে বঙ্গবন্ধুর গ্রেফতারের আগ মুহূর্তে তাজউদ্দীন আহমদ, ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম, ড. কামাল হোসেন, আ স ম আব্দুর রব প্রমুখ তার সাথে দেখা করে তাকে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করার জন্য এবং তাদের সাথে আত্মগোপনে চলে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। তিনি তাদের সবাইকে আত্মগোপনে চলে গিয়ে যথাযথভাবে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করতে বলেন। সে দিন সে মুহূর্তে তিনি কেন স্বাধীনতার ঘোষণাটি পাঠপূর্বক এটি টেপ রেকর্ডারে ধারণ করতে দিলেন না এবং আত্মগোপনে গেলেন নাÑ এ দু’টি বিষয় এখনো দেশবাসীর কাছে অস্পষ্ট।
বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানে অন্তরীণ অবস্থা থেকে লন্ডন ও দিল্লি হয়ে ১০ জানুয়ারি, ১৯৭২ সালে ঢাকায় পৌঁছলে তাকে বীরোচিত সংবর্ধনা দেয়া হয়। এর পরদিন তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। বাংলাদেশের মুক্তি তথা স্বাধীনতার সংগ্রাম আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পরিচালিত হলেও এতে দেশের সব শ্রেণী-পেশার মানুষসহ সাধারণ জনমানুষের সমর্থন ছিল। বাঙালিদের অধিকার প্রশ্নে বাঙালিরা যেমন পাকিস্তানিদের দিয়ে শাসিত ও শোষিত হতে চায়নি, অনুরূপ ভারতেরও শাসিত ও শোষিত হওয়ার পক্ষপাতী ছিল না। এ বিষয়ে দেশের সাধারণ জনমানুষের সাথে বঙ্গবন্ধুর একধরনের আত্মিক মিল পাওয়া যায়।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দেয়া বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি একটি ঐতিহাসিক ভাষণ। এতে একটি জাতির মুক্তি তথা স্বাধীনতা সংগ্রামকে চূড়ান্ত লক্ষ্যে নিয়ে যাওয়ার দিকনির্দেশনা পাওয়া যায়। এ ভাষণের এক জায়গায় পাকিস্তানিদের উদ্দেশ করে বলা হয়েছেÑ ‘আমরা ভাতে মারব, আমরা পানিতে মারব’। এ দু’টি বাক্য বিশ্লেষকদের দৃষ্টিতে ভাষণটির দুর্বল দিক। মানুষের রিজিক এবং বেঁচে থাকা ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস অনুযায়ী সম্পূর্ণরূপে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের হাতে। আর তাই রিজিক ও জীবন বিষয়ে একজন মানুষের এমন কিছু বলা উচিত নয়, যাতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কর্তৃত্ব বিষয়ে প্রশ্ন করার অবকাশ সৃষ্টি হয়। একজন মানুষের কোন কথায় আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সন্তুষ্ট হন আর কোন কথায় অসন্তুষ্ট হন, এটি একমাত্র তিনিই ভালো জানেন। আর তাই ১৯৭৪ সালে যখন আমাদের দেশে ভয়াবহ বন্যা ও দুর্ভিক্ষ দেখা দিলো, তখন এ দেশের জনগণের প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয়েছে ভাতে ও পানিতে এ দেশের সাধারণ মানুষও মরেছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগবহির্ভূত স্বাধীনতার সপক্ষের অন্যান্য দলের প্রত্যাশা ছিল, বঙ্গবন্ধু সব দলের সমন্বয়ে একটি জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করবেন এবং তিনি সরকারের কোনো পদ গ্রহণ না করে জাতীয় মর্যাদার সর্বোচ্চ আসনে আসীন থাকবেন। স্বাধীনতার অব্যবহিত পর জাতীয় সরকার গঠন করলে এ জাতিকে দ্বিধাবিভক্তি হতে রক্ষা করা যেত। বঙ্গবন্ধু সে উদ্যোগটি গ্রহণ করেছিলেন ১৯৭৫ সালে বাকশাল গঠনের মধ্য দিয়ে। কিন্তু বিলম্বে গৃহীত সে উদ্যোগ কেন সফল হয়নি, তার সঠিক বিশ্লেষণ অদ্যাবধি হয়নি।
১৯৭৫ সালে সেনাবাহিনীর যেসব বিপথগামী সদস্যের হাতে বঙ্গবন্ধু দুই মেয়ে ব্যতীত সপরিবারে নিহত হয়েছিলেন, এদের নেতৃত্বে যারা ছিলেন তারা সবাই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি। মুক্তিযোদ্ধা ও ‘স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি’ কেন বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে, সেটিরও রহস্য অদ্যাবধি উদঘাটন করার প্রয়াস নেয়া হয়নি। এ ধরনের ঘটনার ক্ষেত্রে পৃথিবীর সর্বত্র তদন্ত কমিশন গঠনপূর্বক প্রকৃত সত্য উদঘাটনের সর্বাত্মক চেষ্টা করা হয়।
বঙ্গবন্ধু আজ নেই কিন্তু তার আদর্শ ও দর্শন রয়ে গেছে। মুজিবের আদর্শ ও দর্শন জানতে হলে তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থটি অধ্যয়ন আবশ্যক। এ গ্রন্থটি যারা সঠিকভাবে অধ্যয়ন করবেন, তাদের পক্ষে তার আদর্শ ও দর্শন অনুধাবন করা সহজ হবে। আর এ অনুধাবনের মধ্য দিয়েই প্রকৃত জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান যারা, তাদের মনের আয়নায় ধরা দেবে আজ যারা বঙ্গবন্ধুর অনুসারী দাবিদার, তারা কি বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও দর্শনের লক্ষ্যাভিমুখী নাকি লক্ষ্যচ্যুত।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
E-mail: iktederahmed@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.