জীবনের চেয়ে খেলা কি বড়? by বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম

বিএনপির অবরোধ প্রত্যাহার এবং দেশের প্রয়োজনে যার সাথে প্রয়োজন তার সাথেই প্রধানমন্ত্রীর আলোচনার দাবি নিয়ে ২৮ জানুয়ারি বুধবার মতিঝিলের ফুটপাথে অবস্থান নিয়েছিলাম, যা দেখতে দেখতে আজ ৪৮ দিন পার হয়ে যাচ্ছে। কত বিপদ আপদ মসিবত গেল। প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছে, আল্লাহ যেন নিজে তার কুদরতি ছায়ায় রা করে চলেছেন। ৩০ জানুয়ারি, শুক্রবার বায়তুল মোকাররমে নামাজে গিয়েছিলাম। সে দিন আওয়ামী লীগের গায়েবানা জানাজা ছিল। তাই মন্ত্রীরা ছিলেন। প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, আরো অনেকেই গিয়েছিলেন। আমির হোসেন আমু ও নাস্তিক নেতা রাশেদ খান মেননের মাঝে নামাজ আদায় করেছিলাম। এরপর আরো ছয়বার বায়তুল মোকাররমে জুমার নামাজ আদায় করলাম, একবারো কোনো মন্ত্রীর দেখা পেলাম না। তাই মনে হয়, রাজনৈতিক প্রয়োজন ছাড়া আওয়ামী লীগ মসজিদে যায় না। বায়তুল মোকাররমের বর্তমান পেশ ইমাম অধ্যাপক সালাহউদ্দিন আমার বহু দিনের পরিচিত। বড় বিনয়ী মানুষ। সুললিত কণ্ঠে যখন কুরআনের আয়াত তিলাওয়াত করেন, একটা মধুর আবহ সৃষ্টি হয়। শুধু একবার জামাতে তাকে পাইনি। নামাজ পড়িয়েছেন মাওলানা মোহাম্মদ আলী। অধ্যাপক সালাহউদ্দিন সিলেট নাকি চট্টগ্রামে কোনো মাহফিলে গিয়েছিলেন। তবে মোহাম্মদ আলী নামাজ পড়াতে গিয়ে এক অসাধারণ খুতবা দিয়েছেন। ভালো লেগেছিল তার সে দিনের সেই খুতবা। ছেলেবেলা থেকেই ঠাণ্ডার দোষে ভুগছি। যদিও আল্লাহর পরম দয়ায় এখনো চলবার মতো আছি। কিন্তু তবুও কম-বেশি যে কষ্ট হয় না, তা নয়। তাই আজ লেখার ইচ্ছে ছিল না। শরীর-মন কোনোটাই তেমন সাড়া দিচ্ছে না। তবু যখনই পাঠকদের কথা মনে হয়, তখন স্থির থাকতে পারি না। পাঠকদের এত মায়া, এত আকাক্সা; তাদের বঞ্চিত করতে মন সায় দেয় না। তাই শরীরের সাথে যুদ্ধ এবং মনের সাথে জোরাজুরি করে লেখাটি তৈরি করেছি।
আমার যখন সাত-আট বছর বয়স, তখন মারাত্মক হুপিংকাশিতে আক্রান্ত হয়েছিলাম। গ্রামের বাড়ি ছাতিহাটিতে থাকতাম। চিকিৎসাব্যবস্থা তেমন ভালো ছিল না। রাতে এক মুহূর্ত ঘুমাতে পারতাম না। শ্বাস নিতে বুক ফেটে যেতে চাইত, কখনো বুকভরে শ্বাস নিতেও পারতাম না। গলায় সাঁই সাঁই আওয়াজ হতো, দম বন্ধ হয়ে যেত, কাশতে কাশতে বাঁকা হয়ে যেতাম। মা কাছে থাকলে কোলে নিয়ে বুকে-পিঠে চেপে দিতেন, যাতে কষ্ট কমে। কত যে হাতে পায়ে বুকে পিঠে চুন-তেল মালিশ করতেন; কখনো আরাম পেতাম, কখনো পেতাম না। গ্রামের মানুষের ধারণা, শিশুদের ঠাণ্ডা লাগলে গলায় হাতে পায়ে বুকে পিঠে গরম চুন-তেল ঘষলে ভালো হয়Ñ এখন ডাক্তারদের কাছে শুনছি তার উল্টো। কিন্তু আমার হাঁচি-কাশি হলে হাতে পায়ে চুন-তেল দিলে প্রায় সময়ই আরাম পেয়েছি, কষ্ট লাঘব হয়েছে। কত দিন, কত রাত মা শিয়রে জেগেছে আর আল্লাহর কাছে কেঁদেছে, ‘হে আল্লাহ! ওর অসুখ আমাকে দিয়ে বজ্রকে ভালো করে দাও।’ জানি রাজা-বাদশাহদের কর্মকাণ্ড ইতিহাস হয়। সাধারণ ঘরের বাবা-মায়ের ত্যাগ খুব একটা ইতিহাসে জায়গা পায় না। তাই আমার মায়ের প্রার্থনা ইতিহাসে জায়গা পায়নি। আমি না বললে বা না জানালে এক আল্লাহ ছাড়া জগৎ সংসারে কারো জানার সুযোগও ছিল না। রোগশয্যায় পতিত বাদশাহ বাবরের সন্তান হুমায়ুন কোনো মতেই যখন আরোগ্য লাভ করছিল না, তখন বাদশাহ বাবর আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছিলেন, ‘আমার আয়ু হুমায়ুনকে দিয়ে আল্লাহ তাকে সুস্থ করে দাও।’ তার প্রার্থনায় নাকি স্বাভাবিকভাবে জানি না হুমায়ুন কিন্তু সুস্থ হয়েছিলেন। ক’দিনের মধ্যেই সম্রাট বাবর ইন্তেকাল করেন। আমার েেত্রও তেমনিÑ আমি আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠি, ধীরে ধীরে মা হাঁপানিতে আক্রান্ত হন। ৮০-৮৫ বছর বয়সে মা মারা গেছেন, হাঁপানিকে সাথে করেই তিনি গেছেন। মায়ের যদি হাঁপানি না থাকত বা হতো, আমার বিশ্বাস এখনো তিনি বেঁচে থাকতেন।
মতিঝিল ফুটপাথে বেশ ভালোই আছি। অন্তত বায়তুল মোকাররমে বিশাল জামাতে নামাজ পড়তে পারছি। গত শুক্রবার হঠাৎই আমাদের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিকুল ইসলাম দেলোয়ার প্রস্তাব দিয়ে বসে, কিছু দরিদ্র মানুষ নিয়ে রাস্তায় খেলে কেমন হয়। আপনি তো এমনিতেই ফুটপাথে খান। আশপাশে বস্তির কত ছোট ছোট শিশু আপনার পাশে বসে এটা-ওটা খায়। একবার দুপুরে একসাথে খেলে কেমন হয়? গরিব সংগঠন, সামর্থ্য বেশি নেই; তাই সবটাতেই ভয় করি। কারণ, এবার কিছু ধনবানকে দেখেছি তারা আমাদের বেলায় কাঙালের চেয়েও ফকির। ব্যবসায়ীদের নেতা এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি আকরাম শুধু টুঙ্গীপাড়ায় বাড়ি হওয়ার কারণে যে অসৌজন্যের পরিচয় দিয়েছেন, তাতে ধনবানদের নিয়ে ভয় আরো বেড়ে গেছে। খরচের কথা চিন্তা করে যখন আমতা আমতা করছিলাম তখন সে বলল, কয়েকজন আমাদের খাওয়াতে চায়। তারাই ব্যবস্থা করবে। চার-পাঁচ শ’ লোক খাওয়াতে কোনো সমস্যা হবে না। চিন্তা করলাম এমনিতেই ১০০ জন খায়। তাই বললাম, ঠিক আছে আপত্তি নেই। কী খাওয়াবে ভাত খিচুড়ি বিরিয়ানি? পরে ঠিক হলো পোলাও-গোশত। হিন্দুদের জন্য মোরগ-পোলাও অথবা মাছ কিংবা মোরগ-মুরগি। হলোও তাই। বড় সুন্দর অসাধারণ এক খাবারের ব্যবস্থা। ’৯৩, ’৯৪, ’৯৫-এ টুঙ্গীপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর কবরের পাশে রাত-দিন যে হাজার হাজার মানুষকে খাওয়াতাম, বহু দিন পর সে রকম একটা মধুর স্বাদ পেলাম। বস্তির দুই-আড়াই বছরের এক ছোট্ট শিশু সোহেল ছুটে এসেই কোলে বসে, অনেক সময় কোলেই ঘুমিয়ে পড়ে। সেই সোহেল ছোট ছোট হাতে যখন গোশত-পোলাও খাচ্ছিল, আমার চোখে সে এক স্বর্গীয় দৃশ্যের সৃষ্টি হয়েছিল। শুক্রবার বায়তুল মোকাররমে নামাজ আদায় করে এমনিতেই সারা দিন ফুরফুরে থাকি। গত শুক্রবার তার চেয়েও আনন্দময় ঝরঝরে ছিলাম।
সে দিন প্রধান বিরোধী দলের নেতা বেগম খালেদা জিয়া এক সংবাদ সম্মেলন করেছেন। অনেকেই অনেক রকম আশা করেছিলেন। কিন্তু তিনি তার মতো যা বলার বলেছেন। আমিও ৪৮ দিন ফুটপাথে থেকে বুঝেছি, বড় দলগুলো আর জনগণের নাÑ তারা তাদের নিজেদের, নিজেদের গোষ্ঠীর দল। তাই নিজেদের বাইরে কোনো চিন্তা তারা করেন না।
ইংল্যান্ডের সাথে বাংলাদেশ ক্রিকেট টিমের বিজয়ে সারা দেশ মেতে উঠেছিল। হঠাৎই ১২ ঘণ্টার অবরোধ-হরতাল স্থগিত করে ২০ দলীয় জোট আনন্দ মিছিল করল। সরকার তাতে যোগ দিলো, মানে তারাও আনন্দ করল। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের জয় যদি বিএনপি-আওয়ামী লীগ জোটের হয়, তারা যদি একসাথে বিজয় মিছিল করতে পারে; তাহলে আলোচনার মাধ্যমে শান্তি স্থাপন করে কেন শান্তির মিছিল করতে পারে না? শান্তির চেয়েও বড় বিজয় পৃথিবীতে আর কি কিছু আছে? তার মানে তারা দেশপ্রেমিকের মতো দেশকে ভালোবাসে না, নিজেদের সুবিধামতো ভালোবাসে বা ভালোবাসার চেষ্টা করে। ইংল্যান্ডের সাথে জিতে আনন্দে মেতে উঠেছিল, তাহলে সেদিন নিউজিল্যান্ডের সাথে হেরে শোক মিছিল করে চোখের পানিতে বন্যা বইয়ে দিলো না কেন? খেলাধুলা নিশ্চয়ই জাতীয় আনন্দের এক মস্তবড় উপাদান। কিন্তু ১৫ লাখ ছাত্রছাত্রী এসএসসি পরীা দিতে পারল না, জীবনের চেয়েও কি খেলা বড়? বাস্তবের চেয়েও কি রঙ-তামাশার মূল্য বেশি? এর জবাব কে দেবে? ৪০ দিন ফুটপাথে অবস্থান করে প্রধানমন্ত্রীকে লিখতে চেয়েছিলাম, কিন্তু এই অসঙ্গতির যুগে ৫০ দিনে লিখতে চাচ্ছি। ক’দিন আগে বাংলাদেশ টিভির ৫০ বছর পূর্তি হয়েছে। অথচ বাংলাদেশের জন্ম ৪৪ বছর। বাংলাদেশ রেডিওর ৭৫ বছর পূর্তি পালন করা হলো, কিন্তু বাংলাদেশ বিপ্লবী সরকারের অধীনে বাংলাদেশ বেতারের ৭৫ বছর পূর্তিতে প্রধানমন্ত্রী অসাধারণ বয়ান দেয়ার চেষ্টা করেছেন। অথচ এর একটিও সত্যি নয়। আর যা কিছুই হোক পিতার জন্মের আগে পুত্রের জন্ম হয় না। বর্তমান অপ্রিয় বিটিভির বয়স নিশ্চয়ই ৫০ বছর হয়েছে; কিন্তু বাংলাদেশ পিটিভি হিসেবে নয়। ঢাকার ডিআইটিতে ১৯৬৪ সালে টিটিভি হিসেবে প্রথম ১০ মাইল সীমা নিয়ে ১-২ ঘণ্টা, তারপর আস্তে আস্তে ৪০ ফুট বাঁশের ওপরে এন্টেনা বেঁধে তখনকার টিভি দেখতে হতো। পাকিস্তানের সেই টেলিভিশনের নাম বদলে বিটিভি রেখে সেই আজন্মা জন্মদিন পালন করলে, সেটা বাংলাদেশের অঙ্গ হতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান টেলিভিশন ঢাকা কেন্দ্রে রেকর্ড করা অনুষ্ঠানগুলো এখনো দেখলে প্রত্যেক বাঙালির গা-জ্বালা করবে। তখন ঢাকা রেডিওর প্রধান পরিচালক ছিলেন মুক্তাগাছার শামসুল হুদা, যিনি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে জাতীয় সংসদের স্পিকার হয়েছিলেন। বাংলাদেশ বেতারের ৭৫ বছর পূর্তিÑ সেটাও ঠিক নয়। ৭৫ বছর হয়েছে অল ইন্ডিয়া রেডিওর, তারপর পূর্ব পাকিস্তান রেডিও; সবশেষে বাংলাদেশ বেতার। কেন যে আমরা আমাদের মূল রাখতে চেষ্টা করি না, তা বুঝতে পারছি না। যে দিন বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে সে দিন থেকে বাংলাদেশ বেতার হতে পারে, কালুরঘাটে যে দিন বিপ্লবী বেতার চালু হয়েছিল সে দিন থেকে হতে পারে। তবে বাংলাদেশ টিভির জন্মদিন বাংলাদেশ হওয়ার আগে কোনো মতেই হতে পারে না। কারণ, স্বাধীনতাযুদ্ধের ৯ মাস রেডিও-টিভির কলঙ্কজনক অধ্যায় আমরা বয়ে বেড়ালে, সেটা হবে আমাদের জাতির জন্য সবচেয়ে বড় কলঙ্ক।

No comments

Powered by Blogger.