সম্রাট বাবরের উইলপত্র ও আমরা by ড. মুহম্মদ মোয়াজ্জেম হোসেন

১৫২৬ খ্রিষ্টাব্দে পানিপথের প্রথম যুদ্ধে দিল্লির লোদি বংশের সুলতান ইব্রাহিম লোদিকে পরাজিত করে বাবর এ দেশে মোগল শাসনের ভিত্তি গড়ে তোলেন। জীবনের শেষ প্রান্তে বাবর তার পুত্র নাসির উদ্দীন মুহম্মদ হুমায়ুনকে গোপন উইলপত্রে তার উত্তরাধিকার নিযুক্ত করেন। উইলপত্রের ভাষায় সম্রাট বাবরের প্রশাসনিক জ্ঞান ও অসাধারণ প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়। উইলপত্রে বাদশাহ বাবর বলেন, ‘হে আমার পুত্র! সব প্রশংসা আল্লাহর, যিনি তোমার ওপর এই বিশাল সাম্রাজ্যের সার্বভৌমত্ব রক্ষার দায়িত্ব অর্পণ করেছেন। এই দায়িত্ব পালনে তোমার হৃদয়ফলক থেকে সব ধরনের ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতার দুরাগ্রহ ঝেড়ে ফেলতে হবে। প্রতিটি ধর্মের মৌলিক আদর্শের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট ধর্মের অনুসারীদের প্রতি সুবিচার নিশ্চিত করবে। গোহত্যা পরিহার করে চলবে, নতুবা তুমি হিন্দুস্তানের জনগণের হৃদয় জয় করতে পারবে না। তোমার উদারনীতি প্রজাদের হৃদয়ে শ্রদ্ধা ও নৈতিক বাধ্যবাধকতার ঠাঁই করে নেবে।’
অনুগত প্রজাতের প্রতি তুমি সদয় আচরণ করবে। তাদের ধর্মশালা, পবিত্র স্মৃতিচিহ্ন সম্বলিত প্রার্থনালয়, পুণ্য তীর্থস্থান তুমি কখনো ধ্বংস করবে না। এমনভাবে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করবে, যাতে প্রজাদের ওপর রাজার অত্যাচার আরোপিত না হয়। রাজা যেন প্রজাদের ওপর জুলুম না করেন; অপর দিকে প্রজাসাধারণ যেন শাসকের ওপর পরিতুষ্ট থাকে।
উইলপত্রে বাদশাহ আরো বলেন, আইনগত বাধ্যবাধকতা ও পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে ইসলামের স্বার্থ যতটুকু রক্ষা করা সম্ভব তরবারির ভয় দেখিয়ে, জুলুম-অত্যাচারের মাধ্যমে সেটা কখনোই অর্জন সম্ভব নয়। মুসলিম জাতির মধ্যে শিয়া-সুন্নি মতবাদের পথ ধরে যে বিতর্ক ও ব্যবধান সেটা নিয়ে বাড়াবাড়ি না করার জন্য পুত্রকে পরামর্শ দেন। নতুবা অভ্যন্তরীণ কোন্দলের বিষয়গুলো মুখোমুখি সঙ্ঘাতময় অবস্থানে চলে আসবে। একাধিক উপাদানের সমন্বয়ে মানবদেহ গঠিত। প্রাচীন দার্শনিকদের মতে, মানবদেহের গঠনে মাটি, আগুন, পানি, বায়ু এই চার উপাদানের মিশ্রণ থাকে। রাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রেও এমনই নানা জাতিসত্তা, ধর্মীয় বিশ্বাস ও মতাবাদের সমন্বয় ঘটে থাকে। নানা জাতি-ধর্ম, আচার-আচরণ ও ভাষার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে একটি রাষ্ট্রের জনগোষ্ঠী এক স্বতন্ত্র সত্তায় ভাস্বর।
সম্রাট বাবর উইলপত্রে তার পুত্রকে তাদের পূর্বসূরি ভাগ্যবান তৈমুরের শাসনব্যবস্থা থেকে শিক্ষা গ্রহণের পরামর্শ দেন। উইলপত্রে তিনি লিখেছেন, ‘তুমি ভাগ্যবান (পূর্বপুরুষ) তৈমুরের শাসনব্যবস্থা থেকে রাষ্ট্র পরিচালনার নির্দেশনা লাভ করতে পারো।’
এই উইলপত্র জামিদউল আওয়াল মাসের ১ তারিখ, ৯৩৫ হিজরিতে লেখা হয়।
যুবরাজ হুমায়ুনকে দেয়া উইলপত্র ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করা হয়। স্বর্গীয় ড. বলকৃষ্ণপাল, অধ্যক্ষ, কোলাপুর কলেজ, ভারতে এই উইলপত্রের কপি সংরক্ষিত ছিল। প্রকাশিত 'The search light, Patna (Anniversary Number 19, 26)| G Qvov 'Hindusthan Standard' Calcutta, Amritabazar' Calcutta, প্রভৃতি পত্রিকায় উইলপত্রের বিষয় উল্লেখ করা হয়েছিল। সম্রাট বাবর সুশাসন প্রতিষ্ঠার রূপরেখা উইলপত্রে দিয়েছিলেন। অথচ বর্তমান প্রজাতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণের মৌলিক অধিকার হরণ করে যদি oligarchy ধারায় গোষ্ঠী শাসন চলে সেটাকে কিভাবে গণতন্ত্র বলবেন?
ফিল্ড মার্শাল আইউব খান কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল ছাত্রকে গুণ্ডাপাণ্ডা বানিয়ে, চিরকাল ক্ষমতায় থাকতে চেয়েছিলেন। তার উর্বর মস্তিষ্কের সেই এনএসএফ এবং নব্য উদ্ভাবিত মৌলিক গণতন্ত্র দেশে বেশি দিন টেকেনি। বর্তমান বাংলাদেশ সরকার কানে তুলো দিয়েছে। বুঝেও না বোঝার ভান করছে। আজ প্রায় দু’মাস হলো দেশে সরকার থাকলেও মানুষের নিরাপত্তা নেই।
সরকার জনগণের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। অন্য দিকে সরকার বিরোধী দলের সাথে আলোচনা করতেও অনীহা প্রকাশ করছে। এমন একটি সংঘর্ষণ বলয়ে জনগণের অবস্থান। এ জন্য কি দেশবাসী ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছিল? আওয়ামী লীগ একটি গণতান্ত্রিক দল। ১৯৪৯ সাল থেকে আজ পর্যন্ত দলের বয়স প্রায় সাত দশক হতে চললো। দলের নীতি ও ইতিহাস গণতন্ত্রের এবং সংগ্রামের। সেই আওয়ামী লীগ আজ গণতান্ত্রিক ধারা থেকে পিছিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা এটাই যে, জনবিচ্ছিন্ন হয়ে বা কূটকৌশলে কোনো ব্যক্তি বা কোনো দল ক্ষমতায় থাকতে পারে না। কিছু দিনের জন্য বা স্বল্পকালের জন্য জনগণের ইচ্ছাকে দাবিয়ে রাখা যায়; কিন্তু জনগণের দমিত ইচ্ছা একসময়ে বাধভাঙা জোয়ারের মতো গতিপথ করে নেবেই। এ জন্যই বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘সাত কোটি বাঙ্গালীকে দাবাইয়া রাখতে পারবা না’। বর্তমানে দেশের অবস্থা ভালো নয়। রাজধানী শহরের রাস্তাগুলোতে গাড়ি চলে ঠাসাঠাসি জানজট অবস্থায়। সময়ের মূল্য ও তেল খরচের হিসাবে কোটি কোটি ডলারের শ্রাদ্ধ চলে। সরকার যেহেতু নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসেনি, এসেছে কূটবেশেÑ এ জন্য অধস্তন পর্যায়েও তার প্রতিফলন ঘটেছে। দুর্নীতি বেড়ে গেছে। নিরাপত্তা বাহিনীর কর্তব্য দেশের সমাজবিরোধী লোকেদের বিরুদ্ধে তৎপর থাকা; কিন্তু দেশের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত, পেট্রলবোমার দৌরাত্ম্য রাজনৈতিক সহিংসতা থামাতেই নিরাপত্তা বাহিনীর হাবুডুবু অবস্থা। এর সুযোগ নিচ্ছে চোর, ডাকাত, সন্ত্রাসীদের দল। খুনি, অর্থলোলুপ ভূমিদস্যুদের স্বর্গরাজ্য হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এখানে সবলকে রক্ষা করে দুর্বলকে সংহার করা হচ্ছে। ভিুক বেড়েছে, বস্তিবাসীদের সংখ্যা বেড়েছে বই কমেনি। এর মূলে রয়েছে ক্ষমতাবানদের অর্থের দাপট, শোষণ আর লুণ্ঠনপ্রক্রিয়া।
শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। পাসের হার বেড়েছে, শিক্ষার মান কমেছে। রাজনীতিতে যুক্তি, উন্নত আদর্শ ও জ্ঞান প্রসারের মাধ্যমে আগামী দিনে নাগরিকদের মধ্যে যারা অজ্ঞতামুক্ত, সংস্কারমুক্ত ও আলোকপ্রাপ্ত সেসব নাগরিকে দেশ পরিচালনার সুযোগ করে দিতে হবে। রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও মেধাকে সার্বজননীতা দিতে হবে। পরিবারতান্ত্রিক চিন্তাচেতনার মধ্যেই কেবল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড আবদ্ধ রাখা চলবে না। আজ প্রায় নয় সপ্তাহ ধরে দেশ অচলাবস্থায়, অথচ দু’টি পক্ষই গোঁ ধরে আছে। দেশ চলেছে মৎস্য ন্যায় অবস্থায়। সরকারের উচিত এবং কর্তব্য হচ্ছে দেশের জনগণের নিরাপত্তা বিধান করা। স্বাধীন রাষ্ট্রে সরকার সার্বভৌম অধিকার বলেই তাদের পক্ষে বিরোধী দলের বিরুদ্ধে নানা উসকানিমূলক কথা বলা সম্ভব হয়েছে। প্রত্যেক মন্ত্রীর দায়িত্ব হচ্ছে প্রথমে তার নিজের ঘর সামলানো। দায়িত্বপ্রাপ্ত সংশ্লিষ্ট বিভাগকে নিয়ে কথা না বলে বিরোধী দলের বিরুদ্ধে অপ্রাসঙ্গিক কথা, গালিগালাজ আর হুমকি প্রয়োগ মোটেও বাঞ্ছনীয় নয়। বিরোধী দলের কোনো মুরোদ নেই আন্দোলন করার’ ইত্যাদি উসকানিমূলক বাক্য বারবার উচ্চারণ করার কোনো প্রয়োজন ছিল না। প্রকাশ্য জনসভায় ‘চোরের মায়ের বড়গলা, কোন পরীক্ষায় কত নম্বর পেয়েছিল, কোথায় কোন বাগানে কার জন্ম হয়েছিল’Ñ এসব বিষয় নিয়ে কথা বলা একেবারেই অযৌক্তিক ও অবাঞ্ছিত। গিবত করা বড় পাপ। দেশের স্বার্থরক্ষা, গঠনমূলক আলোচনা ও বিরোধী পক্ষের কার্যকলাপের সমালোচনা না করে ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে গিবত ও ঝগড়া করার প্রবণতা কমবেশি উভয় পক্ষেই রয়েছে। ইলিয়াস আলী হত্যা, নারায়ণগঞ্জ হত্যা, সাগর-রুনি হত্যা যেমন নিন্দনীয়, তেমনি নিন্দনীয় জনসভায় গ্র্যানেড হামলা, অর্থমন্ত্রী কিবরিয়া হত্যা। গণতান্ত্রিক আন্দোলনে এসব বিষয়ে আলোচনা ও বিতর্ক হতে পারে। কিন্তু প্রমাণ ছাড়া একজনকে খুনি বলা, গালাগালি দেয়া, চরিত্রের ওপর কালিমা নেপনের মতো ইঙ্গিত দেয়া চলে না। কিন্তু এটাও চলেছে। এ দিকে চিকিৎসাব্যবস্থায় নৈরাজ্যকর অবস্থা। সম্প্রতি দৌলতপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গাইনি বিশেষজ্ঞ না থাকায় হাসপাতালের আরএমও’র পরামর্শ অনুযায়ী একজন প্রসূতি জরুরিভাবে মানিকগঞ্জ সদর হাসপাতালে নেয়ার পথে অটোরিকশায় সন্তান প্রসব করেন। অপর দিকে পত্রিকার খবর অনুযায়ী, বার্ন ইউনিটে ২০১৫ সালের ১ মার্চ পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা ৬০ জন। দেশের শাসনব্যবস্থায় যখন এমন নৈরাজ্যকর অবস্থা, তখন সরকারপক্ষ থেকে সিটি করপোরেশনের নির্বাচিত মেয়রদের নানা কূটকৌশলে বিএনপি সমর্থিত সিটি মেয়রদের বাদ দেয়ার তৎপরতা চলছে। এভাবে স্থানীয় প্রতিনিধিদের হেনস্তা করা হচ্ছে। এভাবে অন্যায় আচরণের মাধ্যমে সরকার কর্তৃক জনপ্রতিনিধিদের সর্বনাশই করা হচ্ছে না, বিএনপি রাজনীতির সাথে যুক্ত থাকায় স্থানীয় সরকারব্যবস্থায় গুরুতর ক্ষতি সাধন করা হচ্ছে।
উল্লেখ্য, সিটি করপোরেশনগুলোর নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছেÑ এটা সরকারেরও ঘোষণা। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কর্তব্য পালনে ক্ষমতাসীন সরকারের অসহযোগিতা এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের বরখাস্ত করার অশুভ তৎপরতা ও ষড়যন্ত্র সমগ্র জাতির দুর্ভাগ্য টেনে আনবে। ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে গুটিকয়েক লোকের হবে বুলন্দনসিব, লাখ লাখ হবে বদনসিব, এ বিধান গণতন্ত্রে নেই। প্রায় পাঁচ শ’ বছর আগে সেই রাজতন্ত্রের যুগে বাবর তার উইলপত্রে পুত্রকে অতি সত্য কথাটাই বলেছেন। রাজতন্ত্রের সেই যুগে বলেছিলেন, ‘এমনভাবে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত করবে, যাতে প্রজাদের ওপর রাজার অত্যাচার আরোপিত না হয়। রাজা যেন প্রজাদের ওপর জুলুম না করেন এবং প্রজারা যেন রাজার ওপর সন্তুষ্ট থাকেন এবং রাজাও যেন প্রজাদের সন্তুষ্টি বিধান করেন বাবর। শাসক আর সাধারণ জনগণের মধ্যে এমন সম্পর্কের কথাই বাবর তার পুত্রকে দেয়া উইলপত্রে উল্লেখ করেছিলেন।’ রাজনীতি যারা করেন তাদের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়া উচিত। অথচ দুর্ভাগ্য এটাই যে, কেউ ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে না।
লেখক : গ্রন্থকার ও ইতিহাসবিদ

No comments

Powered by Blogger.