সরকারি জুজু : জনস্বার্থে নাকি গোষ্ঠিস্বার্থে? by সামসুল ইসলাম টুকু

স্বাধীনতার পরেও দেখা গেছে, পুলিশ কোনো আসামিকে আটক করলে গ্রামের মোড়ল মাতব্বর ডেকে সাক্ষী রেখে থানায় নিয়ে যেত। এতে পুলিশের দায়বদ্ধতা যেমন স্পষ্ট হতো, তেমনি আসামির আত্মীয়-স্বজন গ্রামের মোড়ল মাতব্বর নিশ্চিত হতো আসামির অবস্থান সম্পর্কে। আজকাল আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো অনেক ক্ষেত্রে নিজেদের পরিচয় তো দিচ্ছেই না এবং কথিত আসামিকে কেন আটক করেছে, কোথায় নিয়ে যাচ্ছে সেটাও আসামি পক্ষকে জানানোর প্রয়োজন মনে করছে না। বরং এ ধরনের প্রশ্ন উত্থাপন করলে তাকেও হয়রানিসহ লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়। এ আচরণের একমাত্র অর্থই হচ্ছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কারো কাছে দায়বদ্ধ হতে রাজি নয়। যার ফলে অ্যাটাক, কাউন্টার অ্যাটাক, ক্রসফায়ারের গল্প বানানো খুব সহজ হয়েছে। এ পদ্ধতি যদি কোনো রাষ্ট্র তথা সরকার নিজেদের স্বার্থে প্রবর্তন করে, তবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে থেকে দায়বদ্ধতা আশা করা যায় না এবং এ কাজের জন্য তাদের দায়ী করা যায় না। তবে সরকারের লোকজনের ওপরেও এর প্রয়োগ হতে পারে। তখন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার বিরুদ্ধে সরকারেরও কিছু করার থাকে না। এমন ঘটনাও এ দেশে ঘটেছে। তাই বিষয়টি সরকারসহ রাজনৈতিক দলের নেতাদের বুঝতে হবে, শুধু শত্রুদের দমনের জন্য এ পদ্ধতি চালু থাকা উচিত নয়। অবিলম্বে এ পদ্ধতির বিলোপসাধন করে আগের পদ্ধতি চালুর আইনগত বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করা হোক।
বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মচারীদের বাড়িতে বাড়িতে ‘বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মচারী’ সাইন বোর্ড টাঙিয়ে প্রায় বিনা পয়সায় হিটারসহ বিদ্যুৎ ব্যবহার এবং তাদেরই সহযোগিতায় বিদ্যুৎ চুরির নাম দেয়া হয়েছিল ‘সিস্টেম লস’। এই সিস্টেম লস পূরণের জন্য দেশের বিভিন্ন স্থানে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে হিটার ব্যবহারকারীদের জরিমানাসহ বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা, মিটারে স্টিকার লাগানোর দীর্ঘ অভিযান হয়েছে। তারপরে সিস্টেম লস কিছুটা কমেছে বলে বিদ্যুৎ বিভাগ দাবি করে সরকার ও জনগণের চোখে পর্দা দিতে চেয়েছে। কিন্তু কয়েক দিন পরে আবারো বলেছে, সিস্টেম লস কমানো খুবই কঠিন কাজ এবং বিদ্যুৎ লাইন ও অবকাঠামোগত সমস্যার কথা বলে সত্যটা চাপা দেয়ার চেষ্টা চালিয়েছে। এসব ঘটনা ১৫ বছর আগের।
সিস্টেম লসের সমস্যা দূর হলো না। শুর হলো বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের কর্মসূচি। আওয়াজ উঠল ‘বিদ্যুৎ সাশ্রয় বাল্ব ব্যবহার করুন’, ‘বিদ্যুতের অপচয় বন্ধ করুন’। এ আওয়াজে বিদ্যুৎ গ্রাহকেরা বেশ কিছু দিন সাড়া দেননি। কারণ ১০ টাকা দামের ও ৫০ টাকা দামের রড লাইট ব্যবহারে মানুষ দীর্ঘকাল ধরে অভ্যস্ত। বিদ্যুৎ বিভাগের আওয়াজে বলা হলো, সাশ্রয়ী বাল্ব ব্যবহার সরকারি কর্মসূচি এবং মাইকিং করে জানানো হলো বিভিন্ন স্পটে পুরনো বাল্বের পরিবর্তে সাশ্রয়ী বাল্ব দেয়ার। প্রায় ৫০ ভাগ গ্রাহক লাইনে দাঁড়িয়ে পুরনো বাল্ব দিয়ে সাশ্রয়ী বাল্ব সংগ্রহ করলেন। কিন্তু ওই পর্যন্তই। এদিকে বিভিন্ন পত্রিকায় বিশেষজ্ঞদের বরাত দিয়ে সংবাদ আসতে থাকল, সাশ্রয়ী বাল্ব চোখের ক্ষতি করে, আলো অস্পষ্ট এবং অন্য দেশে এটি ব্যবহার হয়নি বলে সুযোগ সন্ধ্যানীরা এই বাল্ব এ দেশে নিয়ে এসেছে। যা হোক, সাশ্রয়ী বাল্বের ব্যবহার কিছুটা বাড়লেও অকারণে গ্রাহকদের অতিরিক্ত পয়সা গুনতে হয়েছে। সর্বোপরি সাশ্রয়ী বাল্ব ব্যবহারে সমগ্র দেশে কী পরিমাণ বিদ্যুৎ সাশ্রয় হয়েছে, এমন কোনো তথ্য-প্রমাণ বিদ্যুৎ বিভাগের কাছে নেই। আসলে একটি বিদেশী কোম্পানির উৎপাদিত বাল্ব বিক্রির কার্যক্রম বাস্তবায়ন করাই ছিল বিদ্যুৎ বিভাগের কিছু প্রকৌশলী ও আমলাদের উদ্দেশ্য। সেটাও সরকারের নাম ব্যবহার করে।
একই কৌশলে ও কায়দায় এখন চলছে অ্যানালগ মিটার পরিবর্তন করে ডিজিটাল মিটার লাগানোর কর্মসূচি। পুরনো মিটারে সঠিক রিডিং আসে না। ডিজিটাল মিটারে সঠিক রিডিং আসবে। বিদ্যুৎ বাঁচবে, রেভিনিউ বাড়বে এই অজুহাতে এবং আবারো সরকারি জুজুর ভয় দেখিয়ে বিদ্যুৎ গ্রাহকদের বাধ্য করা হচ্ছে ডিজিটাল মিটার লাগাতে। অথচ বছরের পর বছর ধরে হাজার হাজার অ্যানালগ মিটারে সঠিক রিডিং দিয়ে আসার পরেও তা পরিবর্তন কবতে বাধ্য করা হয়েছে। অন্যথায় অন্যায়ভাবে গড় বিল পরিশোধে বাধ্য করা হয়েছে গ্রাহকদের। বিদ্যুৎ বিভাগ এটাও প্রমাণ করতে পারবে না যে, সারা দেশে অন্তত ৩০ লাখ অ্যানালগ মিটার পরিবর্তন করে ডিজিটাল মিটার লাগিয়ে কত টাকা বেশি আয় হয়েছে। শুধু তাই নয়, এমন বহু গ্রাহক প্রমাণ দিতে পারবেন যে, তাদের অ্যানালগ মিটারে যে বিল দিতে হতো ডিজিটাল মিটার লাগিয়েও একই পরিমাণ বিল দিচ্ছেন।
যেকোনো ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলুন এবং যত টাকার অ্যাকাউন্ট খুলুন, ছয় মাস পর পর ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ৫৭৫ টাকা করে কেটে নেবে আপনার অ্যাকাউন্ট থেকে। আপনি যদি লাখ লাখ টাকার অ্যাকাউন্ট খোলেন, তবে বিষয়টি হয়তো খেয়াল করবেন না, বুঝতে পারবেন না অথবা গুরুত্ব দেবেন না। কিন্তু যাদের ১০-২০ হাজার টাকার অ্যাকাউন্ট তারা এক বছর পরে অ্যাকাউন্ট স্টেটমেন্ট দেখলে চমকে উঠবেন আর পাঁচ-ছয় বছর পরে দেখবেন আপনার অ্যাকাউন্ট শূন্য হয়ে গেছে। ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে তারা বলবে সরকারি চার্জ কাটা হয়েছে। আপনি আপনার ঘাম ঝরানো অর্থ ব্যাংকে গচ্ছিত রাখলেন। আর ব্যাংক কর্তৃপক্ষ সে অর্থ অন্যকে ঋণ দিয়ে মোটা অঙ্কের সুদ নিয়ে ব্যাংকের টাকার স্ফীতি ঘটাল, আর আপনার অ্যাকাউন্ট শূন্য করে দিলো। কী বিচিত্র এ দেশ। আমার জানা মতে, যেকোনো অ্যাকাউন্ট থেকে সরকারি এক্সাইজ ডিউটি হিসেবে বছরে মাত্র ১২০ টাকা কাটা হয়। বাকি টাকা ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তাদের নিজের গড়া আইন জারি করে কেটে নেয়। যেটা সম্পূর্ণ অবৈধ ও অনৈতিক। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বলতে পারবে কি ওই অর্থ সরকারের কোন খাতে জমা দেন? প্রায় ২০ বছর আগে এ রীতি চালু করেছিল ব্যাংকগুলো। Incidental Charge বা নৈমিত্তিক ব্যয় হিসেবে বছরে ১০০ টাকা কাটার রীতি শুরু হয়। সেটাই ব্যাংক গ্রাহকদের সহনীয় করতে করতে বর্তমানে ৫৭৫ টাকা কেটে নিচ্ছে।
সরকারি নাম ব্যবহার করে যেসব অন্যায় ও অনৈতিক কাজ চলছে এ দেশে, তার প্রতিকার হওয়া খুবই জরুরি।
লেখক : সাংবাদিক, চাঁপাইনবাবগঞ্জ

No comments

Powered by Blogger.