মৌখিক পরীক্ষায় কারসাজি চাকরি পাচ্ছেন না মেধাবীরা

বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদে (বিসিএসআইআর) বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা নিয়োগে মেধাবীদের ঠাঁই মিলছে না। মৌখিক পরীক্ষায় বিশেষ কারসাজির মাধ্যমে অধিকতর মেধাবীদের প্রাপ্য চাকরি থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। এমন অভিযোগ করেছেন খোদ নিয়োগ কমিটির কয়েকজন সদস্য ও চাকরিপ্রার্থীদের অনেকে।
বিসিএসআইআর বিজ্ঞান এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠান। রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়ে এর কার্যালয়। এ দফতরের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তার ১৩টি শূন্যপদে লোক নিয়োগের জন্য ২৩ ডিসেম্বর সংশ্লিষ্ট কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মোট ১০০ নম্বরের মধ্যে ৭০ নম্বর লিখিত পরীক্ষা, ২০ নম্বর একাডেমিক ও ১০ নম্বর নির্ধারণ করা হয় মৌখিক পরীক্ষার জন্য। বলা হয়, লিখিত পরীক্ষায় ৭০ নম্বরের মধ্যে যেসব প্রার্থী ৪৫ নম্বর পাবেন তারা কৃতকার্য হিসেবে গণ্য হবেন। তবে মৌখিক পরীক্ষায় পরীক্ষার্থীর সংখ্যা কমানোর জন্য ১:৩ পলিসি নির্ধারণ করা হয়। নিয়োগকৃত মোট পদের বিপরীতে তিন গুণ প্রার্থীকে মৌখিক পরীক্ষার জন্য ডাকা হবে। এ সিদ্ধান্ত দফতরের বোর্ড কর্তৃক (বোর্ডের সভাপতি হলেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী) অনুমোদন করা হয়। এরপর বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা পদে নিয়োগের জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়।
এদিকে চাকরির জন্য আবেদন জমা পড়ে সাত শতাধিক। লিখিত পরীক্ষার জন্য বিবেচিত হন ছয় শতাধিক পরীক্ষার্থী। পরীক্ষা হয় গত ১৩ ফেব্রুয়ারি। এরপর মৌখিক পরীক্ষার দিনক্ষণ নির্ধারিত হয় ১৫ ও ১৬ ফেব্রুয়ারি, যা জানিয়ে দেয়া হয় নিয়োগ কমিটির প্রত্যেক সদস্যকে। ৮ সদস্যের কমিটির মধ্যে বিসিএসআইআরের ৫ জন, জনপ্রশাসন ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের দু’জন কর্মকর্তা। এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের একজন সিনিয়র অধ্যাপক। কিন্তু দিনক্ষণ নির্ধারণের পর হঠাৎ মৌখিক পরীক্ষা স্থগিত করে দেয়া হয়। এর কারণ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিয়োগ কমিটির একজন সদস্য যুগান্তরকে জানান, মূলত ১৩টি পদের সব কটিতেই তদবিরের প্রার্থী নিয়োগ দেয়ার অলিখিত অপতৎপরতা তারা শুরু থেকেই লক্ষ্য করেছেন। বিশেষ করে লিখিত পরীক্ষার পর তা অনেকটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এ প্রক্রিয়ার পেছনে একটি প্রভাবশালী মহল সক্রিয় ছিল। কিন্তু একটি পদের বিপরীতে লিখিত পরীক্ষার নম্বর অনুযায়ী তিনজন করে প্রার্থী ডাকা হলে সেখানে তাদের তদবির সংশ্লিষ্ট একজন প্রার্থীও আসতে পারছেন না। মূলত এ বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর মৌখিক পরীক্ষা স্থগিত করে দেয়া হয়। যদিও এর কারণ হিসেবে সে সময় নিয়োগ কমিটির বহিরাগত সদস্যদের বলা হয়, দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সব প্রার্থীর পক্ষে পরীক্ষায় যোগ দেয়া সম্ভব হবে না। সে কারণে পরবর্তী সময়ে সুবিধাজনক সময়ে মৌখিক পরীক্ষা নেয়া হবে।
কিছু দিন পর পরীক্ষার তারিখ নির্ধারিত হয় ১৩ ও ১৪ মার্চ। কিন্তু পরীক্ষা নেয়ার আগে ১:৩-এর পরিবর্তে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ সবাইকে মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত দেয়া হয়। তবে এ বিষয়ে নিয়োগ কমিটির অন্তত তিনজন সদস্য একমত হতে পারেননি। পূর্বের সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের বিষয়ে বোর্ড কর্তৃক সংশোধিত সিদ্ধান্ত অনুমোদন নেয়ার প্রস্তাব দেয়া হলে প্রভাবশালী সদস্যরা তা আমলে নেননি। বলা হয়, পরীক্ষা শেষে ভূতাপেক্ষ অনুমোদন নেয়া হবে।
এদিকে ১৩ ও ১৪ মার্চ অনুষ্ঠিত মৌখিক পরীক্ষার বিষয়ে নিয়োগ কমিটির দু’জন সদস্য যুগান্তরকে বলেন, প্রথম দিনের পরীক্ষায় সবাই আলোচনা করে নম্বর দেবেন বলে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কিন্তু মৌখিক পরীক্ষায় মোটেই ভালো করেননি এমনকি কিছু প্রার্থীকে বেশি নম্বর দিতে তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হয়। বিপরীতে যারা সবচেয়ে ভালো করেছেন, সব কটি প্রশ্নের উত্তর দিতে সক্ষম হয়েছেন এমন প্রার্থীদের ১০-এর মধ্যে ৯ নম্বর দিতে চাইলে তাতে প্রবল আপত্তি জানানো হয়। এতে করে প্রথম দিনের মৌখিক পরীক্ষায় মতবিরোধ ও জটিলতা দেখা দিলে শেষ দিনে (১৪ মার্চ) যে যার মতো করে নম্বর দেবেন বলে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। নিয়োগ কমিটির অপর এক সদস্য বলেন, শেষ দিনে যে যার মতো নম্বর দিলেও ভালো প্রার্থীদের অনেকে শেষ পর্যন্ত চাকরি পাবেন না। কেননা কমিটির সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য তদবিরের প্রার্থীদের পক্ষে। যার প্রমাণও মিলেছে মৌখিক পরীক্ষা বোর্ডে। দেখা গেছে, কিছু প্রার্থীকে পূর্বনির্ধারিত একই প্রশ্ন করা হয়েছে। সব কটির উত্তরও তারা দ্রুত সঠিকভাবে দিতে পেরেছেন। কিন্তু একই প্রার্থীরা তাদের (তিনজন সদস্যের) করা একটি প্রশ্নেরও উত্তর দিতে পারেননি। এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভালো ফলাফল করে পাস করা বেশ কয়েকজন চাকরিপ্রার্থী বোর্ডের প্রত্যেক সদস্যের করা প্রতিটি প্রশ্নের জবাব যথাযথভাবে দিতে পারলেও তাদের অনেক কম নম্বর দেয়া হয়েছে। ফলে এসব মেধাবীর চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।
এ প্রসঙ্গে নিয়োগ কমিটির একজন সদস্য তার ক্ষোভের কথা বলতে গিয়ে বলেন, তার বিবেচনায় চাকরিপ্রার্থীদের মধ্যে একজন প্রার্থী সবচেয়ে ভালো করেছেন। ইন্টারভিউ শেষে আমি তার বাড়ির ঠিকানা জানতে চাই। সে আমাকে বলে মানিকগঞ্জ। আমি তাকে বলেছি, তুমি মানিকগঞ্জের মানিক। দোয়া করি বাংলাদেশের মানিক হবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এ ছেলেটিও চাকরি পাবে না। মৌখিক পরীক্ষা নেয়ার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক অন্য সদস্যদের বলেন, এখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যেসব ছেলেমেয়ে পরীক্ষা দিতে এসেছে তাদের অনেকে আমাদের শিক্ষকদের চেয়েও যোগ্য। তারা অনেক জানে। তিনি বলেন, নিয়োগ কমিটির আমরা কয়েকজন সদস্য এমন প্রস্তাবও দিয়েছিলাম যে, মেধার ভিত্তিতে অন্তত ৫০ ভাগ প্রার্থীকে চাকরি দেয়া হোক। তাহলে গ্রামের বহু গরিব ঘরের মেধাবীরা প্রাপ্য চাকরি থেকে বঞ্চিত হবে না। তারা-তো আমাদেরও সন্তান হতে পারত। কিন্তু সে সুযোগ রাখা হয়নি। বরং কারসাজির অংশ হিসেবে ২৫ নম্বরের এমসিকিউ (টিক মার্ক) পরীক্ষাপত্রে পরিদর্শকের স্বাক্ষরই রাখা হয়নি। ফলে কিছু করতে চাইলে এই পরীক্ষাপত্রও পরিবর্তন করা সম্ভব হবে।
এদিকে নিয়োগ নিয়ে এসব অনিয়মের অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের চেয়ারম্যান ডা. একেএম আসাদুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, এই নিয়োগ নিয়ে কোনো অনিয়ম হয়েছে বলে তার জানা নেই। এ রকম কোনো অভিযোগও তার কাছে আসেনি। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে তদন্ত করে দেখা হবে।

No comments

Powered by Blogger.