ভারতের রেলওয়েকে সঠিক পথে আনতে হবে by শশী থারুর

প্রতি ফেব্রুয়ারিতে ভারতীয় সংসদে এক আজগুবি ও অনন্য অনুষ্ঠান হয়, এটা ধর্মীয় আচারের রূপ নিয়েছে। রেলমন্ত্রী (খুব কম গণতান্ত্রিক দেশেই এ পদ আছে) সেই মাসে সংসদের নিম্নকক্ষে রেলের বাজেট পেশ করেন। সংসদ সেদিন থাকে কানায় কানায় পূর্ণ, সবাই তাঁর কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেন। এই চর্চা সেই ব্রিটিশ রাজের আমল থেকে শুরু হয়েছে। সে সময় ভারতের রেল বাজেটের সঙ্গে অন্যান্য খাতের বাজেটের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। তবে আজ রেলওয়ের রাজস্ব ও ভারতের সামগ্রিক বাজেটকে আর খাটো করে না। রেলওয়ের রাজস্ব সেখানে ২৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, সেখানে দেশটির বাজেটের আকার ২৬৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। কিন্তু ভারতের রেলওয়ের কিছু তথ্য-উপাত্তে ভিরমি খাওয়ার জোগাড় হবে: দৈনিক ২ দশমিক ৩ কোটি যাত্রী পরিবহন (বছরে আট বিলিয়ন, যা দুনিয়ার মোট জনসংখ্যার চেয়েও বেশি), ট্রেনের সংখ্যা ১২ হাজার ৬১৭, স্টেশনের সংখ্যা ৭ হাজার ১৭২, রেললাইনের দৈর্ঘ্য ৬৫ হাজার কিলোমিটার। আর ভারতীয় রেলওয়ের কর্মীর সংখ্যা ১১ লাখ ৩১ হাজার, তারা দেশটির বৃহত্তম প্রতিষ্ঠান।
সংক্ষেপে বললে, ভারতীয় রেলওয়ে দেশটির অর্থনীতির প্রাণ। দেশটির প্রতিটি গোষ্ঠীর জীবনে রেলওয়ের ছোঁয়া রয়েছে। ভারতের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশে মানুষ ও মালামাল পরিবহনে রেলওয়ে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। মানুষের স্বপ্নও পরিবহন করে রেলওয়ে। তার পরও এর অনেক কিছুই ঠিক করতে হবে।
ভারতের রেলওয়ে চীনের রেলওয়ের চেয়ে চার গুণ বেশি যাত্রী পরিবহন করে, যদিও তার লাইন চীনের অর্ধেক। কিন্তু তার পরও বছরে তার সাত বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়। সমস্যা হচ্ছে, সব রেলমন্ত্রীই ট্রেনকে গরিব মানুষের একমাত্র বাহন হিসেবে চিহ্নিত করে এর ভাড়া বাড়াতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। আবার মালগাড়ি সংখ্যাও কমে গেছে। এতে ভোটারদের কাছে মন্ত্রীরা জনপ্রিয় হলেও ভারতের বারোটা বেজে গেছে।
ভারতীয় রেলওয়ের ৬৭ শতাংশ রাজস্ব এখনো আসে মালামাল পরিবহন থেকে। কিন্তু যাত্রী পরিবহনে ভর্তুকি দেওয়ায় মালামাল পরিবহনকারীরা নিরুৎসাহিত হয়েছে। ফলে ট্রেনে মালামাল পরিবহন ক্রমবর্ধমান হারে কমেছে, ১৯৫০-৫১ সালে যা ছিল রেলওয়ের মোট পরিবহনের ৮৯ শতাংশ, আজ তা ৩১ শতাংশে নেমে এসেছে।
এর বদলে সড়কে মালামাল পরিবহনের পরিমাণ বেড়ে গেছে। এতে ভারতের সরু মহাসড়কে আরও চাপ পড়ছে। ভারতের বাতাসে ইতিমধ্যে নিঃশ্বাস নেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে, এতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। এর বিপরীতে চীনের রেলওয়ে ভারতের রেলওয়ের চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি মালামাল পরিবহন করে, যদিও চীনের সড়ক ভারতের চেয়ে অনেক ভালো।
আরও খারাপ ব্যাপার হচ্ছে, রাজনীতিকেরা জনপ্রিয়তার জন্য একের পর এক ট্রেন যুক্ত করেই যাচ্ছেন, কিন্তু লাইন তো বাড়ছে না। ভূমিস্বল্পতার কারণে ভারত ১৯৪৭ সালে স্বাধীন হওয়ার পর এত দিনে মাত্র ১২ হাজার কিলোমিটার রেললাইন বানিয়েছে, আর ব্রিটিশ রাজ রেখে গিয়েছিল ৫৩ হাজার কিলোমিটার (চীন এ সময়ে ৮০ হাজার কিলোমিটার বানিয়েছে), ফলে অনেক লাইনই তার ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত ট্রেন বহন করছে আর তাতে দীর্ঘ জটও লাগছে। এই অক্ষমতার আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছে ট্রেনের ধীরগতি। এর গতি খুব কম ক্ষেত্রেই ৫০ কিলোমিটার অতিক্রম করে, মালগাড়ির ক্ষেত্রে এই গতি ৩০ কিলোমিটার। এর আংশিক কারণ হচ্ছে রাজনৈতিক বিবেচনায় মাত্রাতিরিক্ত স্টেশনে থামা।
কিন্তু সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে রেলওয়েরই বিপজ্জনক অবস্থা। পুরোনো রেল, বিধ্বস্ত কোচ, পুরোনো ধাঁচের সংকেত ও লেভেল ক্রসিং আর মানুষের ভুলের কারণে প্রতিবছর বহু লোক মারা যাচ্ছে।
কিন্তু তার পরও রেলমন্ত্রীরা জনপ্রিয় ধারায় চলছেন। সরকার প্রতিবছর যাত্রী পরিবহনে সাড়ে চার বিলিয়ন মার্কিন ডলার ভর্তুকি দেয়। ফলে ব্যবস্থার উন্নয়নে খরচ করার মতো টাকা আর তার হাতে থাকে না বললেই চলে: অবকাঠামো উন্নয়ন, নিরাপত্তা জোরদার, রেলের গতি বাড়ানো প্রভৃতি কাজে। এতে দেখা যায়, পরিকল্পনা শেষ হওয়ার আগেই রেলের টাকা শেষ হয়ে যায়। গত ৩০ বছরে সংসদে পাস হওয়া ৬৭৬টি পরিকল্পনার মধ্যে মাত্র ৩১৭টি বাস্তবায়িত হয়েছে। আর বাকি ৩৫৯টি পরিকল্পনা বাস্তবায়নে হিসাবকৃত ৩০ বিলিয়ন ডলার কোথায় পাবে, সেটা কল্পনা করাও কঠিন।
এসবও যদি যথেষ্ট না হয়, তাহলে বলতে হয়, ভারতের নেতৃত্ব রেলওয়ের চ্যালেঞ্জ বুঝতেই ব্যর্থ হয়েছেন। যে দেশে রেলে পরিষ্কার টয়লেটই নেই, সেখানে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বুলেট ট্রেন নামানোর কথা বলেছেন। ভারতীয় রেল এখনো সময়মতো পৌঁছায় না। এমন অনেক বড় আকাঙ্ক্ষার কথা তিনি সম্প্রতি বলেছেন। নতুন টেকনোক্র্যাট রেলমন্ত্রী সুরেশ প্রভু আবারও যাত্রীভাড়ার বিষয়টি স্পর্শ না করে মালগাড়ির ভাড়া বাড়িয়েছেন। যদিও পূর্বসূরিদের মতো তিনি নতুন ট্রেন নামানোর মতো প্রলুব্ধকর ঘোষণা দেওয়া থেকে বিরত থাকতে সক্ষম হয়েছেন, তাঁর পরিকল্পনা যথেষ্ট নয়।
প্রভু অঙ্গীকার করেছেন, রেললাইন সম্প্রসারণ ও উন্নত করা হবে। তিনি বলেছেন, স্টেশনে তারবিহীন ইন্টারনেট চালু করা হবে, সব লেভেল ক্রসিংয়ে রক্ষী নিয়োগ করা হবে, ২৪ ঘণ্টা বিনা পয়সায় অভিযোগ জানানোর ব্যবস্থা করা হবে আর নারীর নিরাপত্তায় নিরাপত্তা ক্যামেরা বসানো হবে। এসব উন্নয়ন তাঁর সমালোচকদের কাছে খুব কম মনে হয়। আর তাঁর দলের সাংসদেরা এতে খুব একটা উল্লসিত নন।
প্রভুর সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক অঙ্গীকার হচ্ছে, তিনি বাজারের ঋণদাতাদের কাছ থেকে ১৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার তুলবেন। এটাও সমস্যাজনক, কারণ এ টাকা তিনি কীভাবে শোধ করবেন, তা পরিষ্কার করেননি। বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে কত সুদ তিনি দেবেন, সেটা এক বড় প্রশ্ন। রেলওয়ের পরিচালনাগত উদ্বৃত্ত হচ্ছে মাত্র ৬ শতাংশ বা বছরে মাত্র ১০০ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ, নেটওয়ার্ক আধুনিকায়নে যা দরকার, তার মাত্র ১ শতাংশ।
প্রভু যে পরিষ্কার, নিরাপদ ও দ্রুতগতিসম্পন্ন রেলওয়ের মহাস্বপ্ন দেখছেন, তা কীভাবে পূরণ হবে, সেটা মোটেও পরিষ্কার নয়। রেলমন্ত্রী এক স্বপ্নের বাজেট তৈরি করেছেন। সেটাকে ‘পাইপ ড্রিম’ আখ্যা দিলে আরও সত্য ভাষণ হয়।
বস্তুত, এটা মোদি সরকারের অ্যাপ্রোচের সঙ্গে মানানসই: বড় বড় আকাঙ্ক্ষা, উচ্চকিত বাগাড়ম্বর, উদ্ধৃতিযোগ্য শব্দের আড়ম্বর। আর তার সঙ্গে আছে বাস্তবায়নের পরিকল্পনার অভাব, বাস্তবায়নের সক্ষমতার কোনো উন্নতি না হওয়া। ভারতের ভারাক্রান্ত রেলওয়ে গরম বাতাসে আর চলতে পারে না। কিন্তু তার ভাগ্যে এটাই আছে বলে মনে হচ্ছে।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন; স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
শশী থারুর: ভারতের মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী।

No comments

Powered by Blogger.