সালাহ উদ্দিনের স্বজনরা গভীর উৎকণ্ঠায় by কবির হোসেন

নিখোঁজের এক সপ্তাহ পরও সালাহ উদ্দিন আহমেদের সন্ধান না পাওয়ায় তার পরিবার, আত্মীয়স্বজন, দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে উৎকণ্ঠা বাড়ছে। কবে নাগাদ তার সন্ধান পাওয়া যাবে সে বিষয়েও কেউ নিশ্চিত করে কিছুই বলতে পারছেন না। তাকে খুঁজে বের করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দৃশ্যমান তৎপরতা নেই বলে অভিযোগ করেন স্বজনরা। সালাহ উদ্দিন আহমেদকে খুঁজে বের করতে কি কি পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, কোথায় কোথায় অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে তার কোনো বর্ণনাও নেই হাইকোর্টে দাখিল করা প্রতিবেদনগুলোতে। সোমবার আদালত বিষয়গুলো অ্যাটর্নি জেনারেলের নজরে এনেছেন। ১০ মার্চ রাত থেকে সালাহ উদ্দিন আহমেদ নিখোঁজ। হাসিনা আহমেদ দাবি করেন, উত্তরা ৩ নম্বও সেক্টরের ১৩-বি রোডের ৪৯/বি নম্বর বাসা থেকে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে তার স্বামীকে তুলে নিয়ে যায়। এদিকে সালাহ উদ্দিন আহমেদকে খুঁজে বের করে আদালতে হাজিরের বিষয়ে জারি করা রুলের ওপর পরবর্তী শুনানি আগামী ৮ এপ্রিল। সোমবার রাষ্ট্রপক্ষের শুনানির পর আদালতের দৈনন্দিন কার্যক্রমের সময়সূচি শেষ হয়ে যায়। ফলে শুনানির পরবর্তী এই তারিখ নির্ধারণ করা হয়। ওইদিন আবেদনকারীর পক্ষে বক্তব্য শুনবেন আদালত। বিচারপতি কামরুল ইসলাম সিদ্দিকী ও বিচারপতি গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুরের সমন্বয়ে গঠিত দ্বৈত বেঞ্চ এই শুনানি গ্রহণ করছেন।
পুলিশ, র‌্যাব, সিআইডি ও এসবির পক্ষ থেকে আদালতে প্রতিবেদন দিয়ে জানানো হয়েছে, ‘সালাহ উদ্দিন আহমেদকে তাদের হেফাজতে নেয়া হয়নি।’ সোমবার এই বক্তব্য আদালতে এফিডেভিট আকারে উপস্থাপন করা হয়। পরে এর ওপর শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
আদালত বলেছেন, ‘পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেনি। তাকে খোঁজা হচ্ছে এবং খোঁজার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু খোঁজার জন্য কী কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, কী চেষ্টা করা হয়েছে সে ব্যাপারে প্রতিবেদনে কিছুই বলা হয়নি।’ এ অবস্থায় র‌্যাব তল্লাশি চৌকির সংখ্যা বাড়িয়েছে বলে অ্যাটর্নি জেনারেল আদালতকে জানিয়েছেন।
সালাহ উদ্দিন আহমেদকে উদ্ধারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় সন্তুষ্ট নন তার পরিবার। আদালত শেষে সালাহ উদ্দিন আহমেদের স্ত্রী হাসিনা আহমেদ অভিযোগ করেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাকে উদ্ধারে কোনো তৎপরতা দেখাচ্ছে না। এ কারণে হাইকোর্টের প্রতিবেদনেও তারা বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন। বরং হাইকোর্টে দাখিল করা প্রতিবেদনে তারা মনগড়া তথ্য তুলে ধরেছেন বলে তিনি উল্লেখ করেন।
হাসিনা আহমেদ বলেন, ‘একটি মানুষকে উদ্ধার করতে ৭-৮ দিন লাগতে পারে না। তিনি বলেন, তাকে মানুষের সামনে হাজির করতে সমস্যা কোথায়? তাকে অতি দ্রুত আদালতে হাজির কার দাবি জানান। তিনি বলেন, আমরা আশ্বস্ত হতে চাই যে, তিনি ভালো আছেন, সুস্থ আছেন।’
পুরো পরিবার উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দাবি করে হাসিনা আহমেদ বলেন, ‘আমার ছোট ছেলে কোচিং থেকে ফোন করে বারবার জিজ্ঞেস করছেন ‘আব্বুর খবর কী।’ কিন্তু আমি কোনো জবাব দিতে পারছি না। আমার কাছেই কোনো তথ্য নেই, ছেলেকে কি বলব। আমার অন্য তিন ছেলেমেয়েও বারবার তাদের বাবার খবর জানতে চাইছে। কিন্তু আমি তো তাদের কোনো জবাব দিতে পারছি না।’
তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রপক্ষ আদালতে যে বক্তব্য দিয়েছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, উত্তরা পশ্চিম থানার ওসির যে বক্তব্য আদালতে দাখিল করা হয়েছে তাও সত্য নয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীই আমার স্বামীকে তুলে নিয়ে গেছে। সে ব্যাপারে ওই ফ্ল্যাটের দারোয়ানের বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রচার হয়েছে। কাজেই তারা (রাষ্ট্রপক্ষ) যে বক্তব্য দিয়েছেন তা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট।’
হাসিনা আহমেদ দেশবাসীর কাছে, প্রধানমন্ত্রীর কাছে সালাহ উদ্দিন আহমেদকে ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জানান। তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেভাবে আমার স্বামীকে তুলে নিয়ে গেছে সেভাবে অক্ষত অবস্থায় তাকে আদালতের সামনে হাজির করা হোক। এই দায়িত্ব সরকারের ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। আমরা নাটক করছি বলে সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে। আমরা যদি নাটকই করে থাকি, তাহলে সেটা প্রমাণের দায়িত্বও সরকারের।
আদালত থেকে বের হয়ে সালাহ উদ্দিন আহমেদের আইনজীবী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিষয়টি এখন আদালতে বিচারাধীন থাকবে। এ সময়ের মধ্যে তাকে খুঁজে বের করার জন্য সরকারের ওপর একটা প্রেসার থাকবে। এই সময়ের মধ্যে যদি তাকে খুঁজে পাওয়া যায় তাহলে তাকে আদালতকে এসে জানাতে হবে।’
সোমবারও আদালতের শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল ১১ মার্চ তারিখে উত্তরা পশ্চিম থানার ওসি রফিকুল ইসলামের করা জিডি ও ওই জিডির ভিত্তিতে করা একটি তদন্ত প্রতিবেদন তুলে ধরেন। যে তদন্ত প্রতিবেদনে ১০ মার্চ তারিখে রাত আনুমানিক নয়টার দিকে উত্তরা ৩ নম্বও সেক্টরের ১৩-বি রোডের ৪৯/বি নম্বর ভবনের দোতলা বাসা থেকে ‘রায়হান’ নামের একজন পুরুষ অতিথি চার-পাঁচজন মেহমানের সঙ্গে চলে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। অন্যদিকে সালাহ উদ্দিন আহমেদের স্ত্রী দাবি করছেন, ওই বাসা থেকেই তার স্বামী সালাহ উদ্দিন আহমেদকে র‌্যাব-পুলিশ তুলে নিয়ে গেছে।
হাসিনা আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, ঘটনার দিন রাত ৯টার দিকে ওই বাসা থেকে ৪-৫ জনের সঙ্গে রায়হান নামে একজন মেহমান চলে গেছে বলে ওসি রফিকুল ইসলাম তার তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন তা সত্য নয়। কারণ তিনি (সালাহস উদ্দিন আহমেদ) নিজে ইচ্ছে করে যাননি। তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ওখানে আরও কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন যারা বলেছেন, সেখানে ফ্ল্যাটের সামনে র‌্যাব ও পুলিশের গাড়ি ছিল।’
জিডি করতে দেরির কারণ তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘খোঁজখবর নিয়ে তাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হতে বিলম্ব হয়েছে। সঙ্গত কারণেই জিডি করতেও দেরি হয়। বাড়ির মালিক হাবিব হাসনাতের কাছে জেনেছি তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ১১ তারিখ বিকাল চারটায় হাবিব হাসনাতের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। কারণ সকালের ফ্ল্যাইটে তিনি দুবাই চলে যান। সেখানে পৌঁছানোর পর তিনি আমাকে বিস্তারিত বলেন।’
অন্যদিকে আদালত থেকে বের হয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, ‘পুলিশ আদালতে প্রতিবেদন দিয়ে যেসব বক্তব্য দিয়ে তার সবই সত্য। তারা তার খোঁজ অব্যাহত রেখেছে। বিষয়টি নিয়ে গুজব না ছড়ানোর অনুরোধ জানান তিনি।’
‘গত ১০ মার্চ রাত আনুমানিক ১০টার দিকে উত্তরা ৩ নম্বর সেক্টরের ১৩-বি রোডের ৪৯/বি নম্বর ভবনের দোতলা বাসা থেকে তার স্বামীকে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় বলে দাবি করে আসছেন তার স্ত্রী।’ পরে খোঁজ না পেয়ে গত ১২ মার্চ সালাহ উদ্দিন আহমেদকে আদালতে হাজিরের নির্দেশনা চেয়ে তার স্ত্রী হাসিনা আহমেদ একটি ফৌজদারি আবেদন দায়ের করেন। ওই দিনই ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯১ ধারায় করা এই আবেদনের শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট সালাহ উদ্দিন আহমেদকে খুঁজে বের করে আদালতের সামনে হাজির করতে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন। রোববার সকাল সাড়ে ১০টার মধ্যে এ রুলের জবাব দিতে বলা হয়।
সে অনুযায়ী রোববার অ্যাটর্নি জেনারেলের মাধ্যমে প্রতিবেদন দাখিল করেন পুলিশ সদর দফতর, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি), এসবি, র‌্যাব ও সিআইডি। সোমবার তাদের প্রতিবেদনগুলো এফিডেভিট আকারে আদালতে উপস্থাপন করার পর শুনানি শুরু হয়।
সোচ্চার হওয়ার আহ্বান ২০ দলের : অবিলম্বে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহ উদ্দিন আহমেদকে অক্ষত ও সুস্থ অবস্থায় তার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জানিয়েছে ২০ দলীয় জোট। একই দাবিতে দেশের সব গণতন্ত্রমনা ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন ব্যক্তি, সংগঠন ও দলের প্রতি সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তারা। সোমবার ২০ দলের পক্ষে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব বরকতউল্লা বুলু এক বিবৃতিতে বলেন, দেশের জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দিতে অক্ষম ও ব্যর্থ সরকার সোমবারও বিএনপির অন্যতম যুগ্ম মহাসচিব সালাহ উদ্দিন আহমেদকে আদালতে হাজির করতে ব্যর্থ হয়েছে। তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আমাদের এবং দেশবাসীর উৎকণ্ঠা বৃদ্ধি মানবিক-মূল্যবোধহীন এই অবৈধ সরকারের বক্তব্য ও আচরণে কোনোই প্রভাব সৃষ্টি করতে পারছে বলে মনে হয় না। দেশের একজন সাবেক নির্বাচিত সংসদ সদস্য, মন্ত্রী ও গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতাকে রাতের অন্ধকারে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের কাণ্ডজ্ঞানহীন বক্তব্য ও নিষ্ঠুর রসিকতায় দেশবাসী স্তম্ভিত ও ক্ষুব্ধ।

No comments

Powered by Blogger.