আন্দোলনে বিএনপিকে বিরতি টানতেই হবে by এ কে এম জাকারিয়া

‘এই আন্দোলন কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যক্তির বা কোনো দলের বিরুদ্ধে দলের নয়। এই আন্দোলন আদর্শিক ও মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন।’ টানা অবরোধের দুই মাসেরও বেশি সময় পর গত শুক্রবার এক ‘সংবাদ সম্মেলনে’ বিষয়টি পরিষ্কার করেছেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। ‘আদর্শিক’ বা ‘মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার’ আন্দোলন—যা-ই হোক না কেন, সব আন্দোলনেরই একটি কৌশল থাকে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ‘নির্বাচনের’ এক বছরের মাথায় বিএনপি যে আন্দোলন শুরু করেছে, তাতে দলটি যে শুরু থেকেই সন্ত্রাস ও নাশকতার কৌশল নিয়েছিল, তা আগে এক লেখায় উল্লেখ করেছিলাম (রাজনৈতিক সহিংসতা নাকি সন্ত্রাস, প্রথম আলো, ২৯ জানুয়ারি, ২০১৫)। এই কৌশলে আদৌ সাফল্য মিলবে কি না, সেই প্রশ্নও তুলেছিলাম।
এখন দেখা যাচ্ছে, নাশকতার এই কৌশলে দলটির পেট্রলবোমার ব্যবহার বা মানুষ পুড়িয়ে মারার মতো বর্বরতা আন্দোলনে সাফল্যের কোনো পরিস্থিতি তৈরি করতে পারেনি। এখন খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘যৌক্তিক পরিণতি’ না পাওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। দীর্ঘ সময় ধরে টানা অবরোধ ও হরতালের কর্মসূচির পর কোনো প্রাপ্তি বা ‘পরিণতি’ ছাড়া কর্মসূচি প্রত্যাহার করা এখন দলটির জন্য কঠিনও বটে! কিন্তু এই পরিস্থিতিতে নতুন প্রশ্ন হচ্ছে, আন্দোলনে সেই পুরোনো সন্ত্রাস ও নাশকতার কৌশলই চলবে, নাকি ভিন্ন কোনো পথ?
গত শুক্রবার খালেদা জিয়ার সংবাদ সম্মেলনের পর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখানো হলো, তাতে মনে হলো, বিএনপিকে তারা যেন পেয়ে বসেছে। দীর্ঘ এই আন্দোলনের নিষ্ফল দশায় সরকারি দল যেন আরও চাঙা ও আক্রমণাত্মক হয়েই কথাবার্তা বলছে। এরই মধ্যে বিরোধী দলের বড় নেতাদের প্রায় সবাইকে জেলে পুরা সারা হয়েছে। খালেদা জিয়ার ওপরও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ঝুলছে। বাকিরা পালিয়ে আছেন। গোপন স্থান থেকে ৭২ ঘণ্টা করে সপ্তাহে দুবার হরতাল ডাকার কাজ করে যাচ্ছিলেন যুগ্ম মহাসচিব সালাহ উদ্দিন আহমদ। তিনিও এখন নিখোঁজ। বিএনপির যে দু-একজন নেতা এখনো কোনো না কোনোভাবে সক্রিয় থাকার চেষ্টা করছেন, তাঁদের কাছে এটা এক ভয়ংকর সতর্কবার্তা হিসেবেই বিবেচিত হবে।
নাশকতা বা পেট্রলবোমা বিএনপির কাজ নয় বলে দলটি এবং এর চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দাবি করে যাচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু এসব খুব কাজে দিচ্ছে বলে মনে হয় না। দলটির ভাবমূর্তির যা ক্ষতি হওয়ার এরই মধ্যে হয়ে গেছে। গত ৬ জানুয়ারি থেকে টানা অবরোধ, সপ্তাহে পাঁচ দিন হরতাল কর্মসূচি যখন আন্দোলনে কোনো সুফল দিতে পারল না, তখন খালেদা জিয়া কোন ভরসায় বা কিসের আশায় জাতির ‘বৃহত্তর স্বার্থে’ আন্দোলন অব্যাহত রাখা ও ‘সাময়িক কষ্ট’ স্বীকার করতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানালেন, তা সত্যিই এক বড় প্রশ্ন। এসব প্রশ্নের জবাব বা ব্যাখ্যা দেওয়ার কেউ বিএনপিতে নেই। খালেদা জিয়া ‘সংবাদ সম্মেলন’ ডাকেন, কিন্তু সেখানে সাংবাদিকদের কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ থাকে না।
টানা অবরোধ ও সপ্তাহে পাঁচ দিন হরতালের কর্মসূচি যে কোনো বাস্তবসম্মত নয়, এবং জনগণের পক্ষে যে সেটা মানা সম্ভব নয়, তা আরও আগেই বিএনপির বোঝা উচিত ছিল। বিএনপির সমর্থক বা দলটির প্রতি সহানুভূতি আছে, এমন কারও পক্ষেও তো এই কর্মসূচি মেনে চলা সম্ভব নয়। হরতাল-অবরোধ এসব কারণে অনেকটাই অকার্যকর আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। ফলে বর্তমান স্টাইলে এই আন্দোলন অব্যাহত রেখে বিএনপি যে আদৌ কোনো ফল পাবে না, তা পরিষ্কার। সরকার বা সরকারি দল সম্ভবত এখন একসময় নিস্তেজ হয়ে এই আন্দোলনের মৃত্যু ঘটার অপেক্ষা করছে।
আগেই বলেছি, এবারের আন্দোলনের শুরু থেকেই কৌশল হিসেবে সন্ত্রাস ও নাশকতার পথ ধরেছে বিএনপি। ফলে খুব স্বাভাবিক কারণেই এই আন্দোলন গণ-আন্দোলনের দিকে যায়নি। বিএনপি সম্ভবত সে চেষ্টা বা পথও ধরেনি। নাশকতা বা সন্ত্রাসের মাধ্যমে দেশ অচল ও বিষয়টি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নজরে এনে তাদের মধ্যস্থতায় কিছু করার পথই মনে হয় তাদের বিবেচনায় ছিল। এখন খালেদা জিয়া যতই জনগণকে এই আন্দোলনে শরিক হওয়ার আহ্বান জানান, সন্ত্রাস ও নাশকতা দিয়ে শুরু হওয়া এই আন্দোলন অব্যাহত রেখে তাঁকে আর কখনো গণ-আন্দোলনে রূপ দেওয়া যাবে বলে মনে হয় না। একটি গ্রহণযোগ্য, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে যদি দলটি গণ-আন্দোলন করতে চায়, তবে নতুন করেই শুরু করতে হবে। বর্তমান আন্দোলনে বিএনপিকে বিরতি টানতেই হবে।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, বিএনপি দীর্ঘ সময় ধরেই একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে কাজ করছে বলে মনে হয় না। আর এখন অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে সরকারের দমন-নিপীড়নের কারণে চাইলেও দলটির পক্ষে রাজনৈতিক দল হিসেবে কাজ করা সম্ভব নয়। এই যে খালেদা জিয়া ‘অবরোধ চলবে’ বলে গত ৫ জানুয়ারি ঘোষণা দিয়ে বসলেন, সেটা তিনি কি আদৌ দলের কারও সঙ্গে পরামর্শ করে দিয়েছেন? বা এখন যে আন্দোলন অব্যাহত রাখার কথা বলছেন, সেটাই বা তিনি কার পরামর্শে করছেন? আন্দোলনের ভুল ও সর্বনাশা কৌশল সরকারের বিএনপি নির্মূলের লক্ষ্য পূরণকে অনেকটাই সহজ করে দিয়েছে। নতুন করে আন্দোলন শুরুর আগে তাই বিএনপিকে এখন রাজনৈতিক দল হিসেবে কাজ করার কঠোর সংগ্রামও করতে হবে।
সব বিবেচনাতেই আওয়ামী লীগ বা সরকার এখন সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে। কিন্তু আপতভাবে নিষ্ফল বাংলাদেশের ইতিহাসের নজিরবিহীন এই আন্দোলনের কর্মসূচি, আন্দোলনের কৌশল হিসেবে আগুনে পুড়িয়ে মানুষ মারার মতো বর্বরতার পথ ধরা ও এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে দমন-নিপীড়ন চালিয়ে প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে দৃশ্যত নির্মূল করার কৌশল—এসব বাংলাদেশকে কোন ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাবে?
বিএনপির আন্দোলন দৃশ্যত ব্যর্থ হওয়া, দলটির বর্তমান ছিন্নভিন্ন দশা বা দলটিকে কোণঠাসা করতে পারাকে হয়তো আওয়ামী লীগ বিজয় হিসেবে দেখছে। কিন্তু এটা সম্ভবত বিবেচনায় নিচ্ছে না যে বিএনপির মতো একটি বড় রাজনৈতিক দলের অসংগঠিত অবস্থা ভয়ংকর পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। বিএনপির কর্মী-সমর্থকেরা সবাই তাঁদের দল ও রাজনীতিকে ত্যাগ করেছেন—এমনটি নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগ মনে করে না। সংগঠিত একটি রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীর চেয়ে একটি অসংগঠিত দলের ক্ষুব্ধ নেতা, কর্মী ও সমর্থকেরা বেশি বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারেন। এসব ক্ষেত্রে কোনো জবাবদিহি বা দায়দায়িত্ব কাজ করে না। ফলে বিএনপি অবরোধ-হরতালের মতো কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নিলেও যে নাশকতা বা সহিংসতা ঘটবে না, সেটা নিশ্চিত করে বলা কঠিন।
সরকার শুরু থেকেই কঠোর হাতে এসব সংঘাত ও সহিংসতা দমনের কথা বলে আসছে। এখনো তা-ই বলে যাচ্ছে। কিন্তু এসব করতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ রাষ্ট্রীয় নানা সংস্থাকে যথেচ্ছা ও রাজনৈতিকভাবেই ব্যবহার করেছে। অনেক ক্ষেত্রেই বিভিন্ন বাহিনী তাদের এখতিয়ারের বাইরে গিয়ে কাজ করেছে। নাশকতা দমন করতে গিয়ে আইনের অপপ্রয়োগ এবার যে মাত্রায় ঘটানো হলো ও যে দৃষ্টান্ত তৈরি হলো, সেখান থেকে ফিরে আসা খুবই কঠিন হয়ে পড়বে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলো যদি তাদের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য হারায়, তবে ভবিষ্যতে যে বা যারাই ক্ষমতায় আসুক, তারাও যে সেই একই পথ ধরবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
অবরোধের ৭০ দিন গেছে গতকাল সোমবার। এ পর্যন্ত সহিংসতায় মারা গেছে ১২১ জন। অধিকাংশই মারা গেছে পেট্রলবোমা, ককটেল, অগ্নিসংযোগের মতো নাশকতার ঘটনায়। অনেকে এখনো কাতরাচ্ছেন হাসপাতালগুলোর বার্ন ইউনিটে। এসব বর্বরতার জবাবে ‘ক্রসফায়ারে’ মারা গেছে ৩১ জন। এগুলো সবই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। সংঘাতের রাজনীতি একটা চক্রের মতো। কোনো দেশে দীর্ঘ সময় ধরে তা চললে সে অবস্থা থেকে ফেরা কঠিন। এই পরিস্থিতি শোচনীয় হয়ে ওঠে যখন আন্তর্জাতিক নানা শক্তি তাদের নিজেদের ভিন্ন ভিন্ন স্বার্থে সেখানে সক্রিয় হয়ে ওঠে। সংঘাতের ক্ষেত্রটি তখন আর দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর হারা-জেতার মধ্যে আটকে থাকে না।
বাংলাদেশের পরিস্থিতি এখনো সে জায়গায় যায়নি। কিন্তু বিএনপির দৃশ্যত ব্যর্থ আন্দোলন ও আওয়ামী লীগের আপাতবিজয়ের বর্তমান পরিস্থিতিতে এই বিষয়গুলোকে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই।
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.