বিএনপিকে আরও চেপে ধরছে সরকার by আবদুল্লাহ আল মামুন

আত্মবিশ্বাস বেড়েছে সরকারি শিবিরে। তদের ধারণা সহিংসতা ও নাশকতার বিরুদ্ধে আইনশৃংখলা বাহিনীর কঠোর পদক্ষেপে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট দুর্বল হয়ে পড়েছে। যার বহির্প্রকাশ ঘটেছে সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নমনীয় বক্তব্যে। এ ঘটনাকে প্রাথমিক বিজয় হিসেবেও দেখা হচ্ছে। এতে রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাসীনরা চূড়ান্ত বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। এমন অবস্থায় সরকারের পক্ষ থেকে এ মুহূর্তে কোনো ধরনের ছাড় দেয়ার সিদ্ধান্ত নেই। ফলে বিএনপির সঙ্গে কোনো সংলাপ বা সমঝোতায়ও যেতে চায় না শাসক দলের হাইকমান্ড। বরং বিএনপি ও জামায়াতকে কিভাবে আরও চেপে ধরা যায়, সে ব্যাপারে নেয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। এরই অংশ হিসেবে নাশকতা দমনে আইনশৃংখলা বাহিনীর চলমান অভিযান আরও জোরদার করা হয়েছে। আর চাঙ্গা করা হচ্ছে গত বছরের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ও পরে এক বছর এবং চলমান অবরোধে নাশকতার ঘটনায় দায়ের করা বিভিন্ন মামলা। এসব মামলায় খালেদা জিয়াসহ ২০ দলীয় জোটের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে। মামলাগুলো সন্ত্রাসবিরোধী আইনে বিচার করতে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রক্রিয়া চলছে। পাশাপাশি বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা দুর্নীতিসহ অন্যান্য মামলাও চাঙ্গা করা হচ্ছে। এছাড়া জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ককে পুজি করে জঙ্গিবাদী তৎপরতায় ২০ দলীয় জোটকে দায়ী করতেও নেয়া হয়েছে নানা কর্মসূচি। যাতে বহির্বিশ্বের কাছে দলটির ভাবমূর্তির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। আওয়ামী লীগ ও সরকারের একাধিক সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সোমবার রাতে টেলিফোনে যুগান্তরকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশেই নাশকতার মামলাগুলো সন্ত্রাসবিরোধী আইনে নেয়ার জন্য অনুমোদন দেয়া হয়েছে। দ্রুত বিচার সম্পন্ন করার উদ্দেশ্যেই মামলাগুলো এই আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। এতে বিচার ব্যবস্থার ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা আরও বাড়বে। আরেক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, নাশকতা দমনে আইনশৃংখলা বাহিনীর অভিযান অব্যাহত আছে এবং প্রয়োজনে তা আরও জোরদার করা হবে। দল ও জোটের অবস্থান স্পষ্ট করতে শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে খালেদা জিয়ার দেয়া বক্তব্যে সংকট নিরসনে ছাড় দেয়ার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। তিনি বলেছেন, সমস্যা সমাধানের চাবিকাঠি ক্ষমতাসীনদের হাতে। সংকট নিরসনের মাধ্যমে সরকার জাতীয় ঐক্যের পথ খুলে দিতে পারে। তাহলেই আমরা সংকটমুক্ত হয়ে সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে ৪৫তম স্বাধীনতা দিবস পালন করতে পারব। পাশাপাশি তিনি সংলাপেরও আহ্বান জানান।
শনিবার পেশাজীবীদের মহাসমাবেশে প্রধান অতিথির ভাষণে খালেদা জিয়ার বক্তব্যের জবাব দেন প্রধানমন্ত্রী। সংকট নিরসনে খালেদা জিয়ার সংলাপের প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, যিনি খুনি, যার হাতে মানুষ পোড়ার গন্ধ, যিনি মানুষকে মানুষ হিসেবে গণ্য করেন না- তার সঙ্গে কিসের সংলাপ? জঙ্গিনেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে সংলাপ কে করবে? মানুষ হত্যাকারীর সঙ্গে কোনো সংলাপ হতে পারে না। গ্রেফতারি পরোয়ানা মেনে আদালতে আত্মসমর্পণের জন্য খালেদা জিয়ার প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, তার বিরুদ্ধে সমন হয়েছে। তিনি যেন আদালতে গিয়ে সারেন্ডার করেন। ওটাই তার জায়গা। সারেন্ডার করলে তার জন্য ভালো হবে। না করলে সরকার আদালতের নির্দেশ পালনে বাধ্য হবে। আন্দোলনের নামে খালেদা জিয়া মানুষকে যে কষ্ট দিচ্ছেন, তা তাড়াতাড়ি শেষ করতে যা যা করার তাও আমরা করব।
খালেদা জিয়া শর্তসাপেক্ষে কর্মসূচি প্রত্যাহারের কথা বলেছেন, এখন সরকার কি করবে? এমন প্রশ্নের উত্তরে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ এমপি রোববার যুগান্তরকে বলেন, শুধু এটাই শেষ কথা নয়। তিনি যে পেট্রলবোমা ও আগুন দিয়ে মানুষ হত্যা করলেন, তার জন্য তাকে শাস্তি পেতে হবে। তারপর অন্য কথা। একই অপরাধে লন্ডন প্রবাসী তারেক রহমানেরও বিচার হওয়া উচিত বলে তিনি মনে করেন।
সরকার-সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, অবরোধ ও হরতালে মানুষ হত্যার দায়ে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়েছে। তার ছেলে লন্ডন প্রবাসী তারেক রহমানের বিরুদ্ধেও একই ধরনের মামলা দায়ের করে মা-ছেলেকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর প্রস্তুতি চলছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই অন্য মামলার পাশাপাশি এই সংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তি করতে চায় সরকার। সেক্ষেত্রে অভিযোগ প্রমাণিত হলে দুজনই নির্বাচন করার অযোগ্য হতে পারেন বলে সরকারের নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন।
বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি দুর্নীতি ইস্যুতে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলায় হাইকোর্টের আদেশ দাখিলের জন্য আগামী ১৩ এপ্রিল দিন ধার্য করা হয়েছে। কারাগারে থাকা এ মামলার তিন আসামি ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে ওইদিন আদালতে হাজির করার নির্দেশ দেয়া হয়। সোমবার ঢাকার দুই নম্বর বিশেষ জজ আদালতে এ মামলায় হাইকোর্টের আদেশ দাখিলের জন্য দিন ধার্য ছিল। এছাড়া ড্যান্ডি ডায়িংয়ের ঋণখেলাপির মামলায় প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোর ওয়ারিশ হিসেবে তার মা বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ কোকোর স্ত্রী-মেয়েদের পক্ষভুক্ত করা হয়েছে। দেওয়ানি কার্যবিধি আইনের ২২ আদেশের নিয়ম ৪ অনুসারে কোকো মারা যাওয়ায় তার সম্পদের ওয়ারিশরা বিবাদীভুক্ত হবেন। এছাড়া বাংলাদেশে শরিয়াহ আইনের বিধান মোতাবেক মৃত ব্যক্তির সম্পত্তি বণ্টন হয়। তাই ওয়ারিশ হিসেবে খালেদা জিয়া, স্ত্রী শর্মিলা রহমান এবং দুই মেয়ে জাফিয়া রহমান ও জাহিয়া রহমানকে বিবাদীভুক্ত করার আবেদন করা হয়। ওই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সোমবার ঢাকার প্রথম যুগ্ম জেলা জজ ও অর্থঋণ আদালতের ভারপ্রাপ্ত বিচারক রোকসানা আক্তার হ্যাপি এ আদেশ দেন। একই সঙ্গে আগামী ১২ এপ্রিল ইস্যু (বিচার্য বিষয়) গঠনের দিন ধার্য করেন।
সরকারের নীতিনির্ধারণী সূত্রে জানা গেছে, বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলনের এ পর্যায়ে শনিবার রাতে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একান্তে দলের সাধারণ সম্পাদক এবং স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। গণভবন-সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, এ সময় অন্য কারও প্রবেশের সুযোগ ছিল না। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে আলাদা কথা বলেছেন। এসব হিসাব-নিকাশ বিবেচনায় নিয়ে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে সরকার। সে লক্ষ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়-সংশ্লিষ্টদের প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে। এ নিয়ে দেনদরবারের জন্য ঢাকায় ব্রিটিশ হাইকমিশন এবং সে দেশটির সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ হচ্ছে। তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে এনে কী উপায়ে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যায়, সে নিয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে খোঁজখবর নেয়া হয়েছে। ক্ষতিয়ে দেখা হচ্ছে বিদ্যমান ব্রিটিশ আইনও।
এ অবস্থায় আওয়ামী লীগের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপ-কমিটিকে আরও সক্রিয় করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সাবেক রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ জমিরের নেতৃত্বাধীন এই উপ-কমিটির সদস্যদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র বিভাগের আদলে দায়িত্ব সুনির্দিষ্টভাবে বণ্টনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। সদস্যরা কে কোনো দেশের পররাষ্ট্র বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবেন তা খুব শিগগির চূড়ান্ত করে দায়িত্ব অর্পণ করা হবে।
বিদেশী কূটনীতিকদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ও যোগাযোগ রক্ষার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের মধ্যে দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের সুনাম রয়েছে। পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে লন্ডনে পাড়ি জমানো সৈয়দ আশরাফ তিন দশকেরও বেশি সময় দেশটিতে বসবাস করেছেন। বর্তমানে লন্ডনে তার স্ত্রী-কন্যা বসবাস করছেন।
সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে ঢাকায় নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট গিবসনের সঙ্গে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের পূর্বপরিচয় এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। লন্ডনে পাশাপাশি বাড়িতে বসবাসের সূত্রে দুজনের সঙ্গে বন্ধুত্ব তৈরি হয়। ওই সময় গিবসন যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র বিভাগের একজন জুনিয়র অফিসার ছিলেন। ঢাকায় আসার পর পুরনো দুই বন্ধুর যোগাযোগ আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।
আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড এসব বিষয়ে অবহিত। তাই সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে দিয়ে লবিং করিয়ে ফেরারি আসামি, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ আরও জোরদার করতে চায় দলের হাইকমান্ড। পাশাপাশি বিএনপির চলমান আন্দোলনকে সর্বাত্মকভাবে ব্যর্থ করতে সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করবে সরকার। এজন্য খালেদা জিয়া নমনীয় হলেও সরকার ওই পথে না হেঁটে অবরোধ ও হরতাল দমনে আরও কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছে।

No comments

Powered by Blogger.