জনপ্রতিনিধিদের অনুপস্থিতি নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর ক্ষোভ by দীন ইসলাম

জ্বালাও-পোড়াওয়ের মধ্যে সরকারি দলের এমপি, উপজেলা চেয়ারম্যানসহ সব জনপ্রতিনিধি জনগণের পাশে না থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি’র বৈঠকে। জনপ্রতিনিধিদের অনুপস্থিতি’র বিষয়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষোভ প্রকাশ করেন বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানরা। বলেন, জনপ্রতিনিধিদের অনুপস্থিতির জন্য অবরোধকারীদের ঠিকভাবে ধরা যায় না। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যায় না। তাই জনপ্রতিনিধিরা ঠিকভাবে এলাকায় বসবাস করলে অবরোধকারীদের দমনের কাজটি সহজ হয়ে যায়। গতকাল সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি’র বিশেষ বৈঠকে এ ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়। সভায় জনপ্রতিনিধিদের উপর ক্ষোভ প্রকাশ ছাড়াও আইনশৃঙ্খলার সার্বিক চিত্র নিয়ে আলোচনা করা হয়। সিদ্ধান্ত হয় প্রশাসনিকভাবে মোকাবিলা করা হবে। মন্ত্রিসভা কমিটি’র একাধিক সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সভায় মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের চেয়ে জোরালো বক্তব্য দেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রধানরা। অবরোধ ও যে কোন ধরনের নাশকতা মোকাবিলায় নিজেদের প্রস্তুতি সম্পর্কে জানান দেন। একই সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে কি ধরনের সমস্যার মুখে পড়ছেন ওই সব কথাও জানানো হয় বৈঠকে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রী মহসীন আলী’র ‘দেখামাত্র গুলি করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে সরকার’- এমন বক্তব্য আলোচিত হয়। বৈঠকে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, বিএনপিসহ ২০ দলের রাজনৈতিক কর্মসূচি মানুষের মনে কোন ধরনের সাড়া ফেলতে পারেনি। অবরোধ মানে সব কিছু স্থবির হয়ে যাবে। কিন্তু সব কিছু কি স্থবির হয়েছে? সব কিছুই এখন স্বাভাবিক অবস্থায় রয়েছে। তিনি বলেন, ২০ দল তাদের আন্দোলনে জনসমর্থন পায়নি বলে চোরাগোপ্তা হামলা শুরু করেছে। এটা ঠেকাতে সবার আগে এমপিসহ সব জনপ্রতিনিধিদের এলাকায় যেতে হবে। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে। সবার আগে পরিস্থিতি প্রশাসনিকভাবে মোকাবিলা করতে হবে। এরপরই রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে হবে। দুই ঘণ্টার এ উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে কমিটি’র অন্য সদস্য-মন্ত্রীরা খুব একটা বক্তব্য দেননি। সভা শেষে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু বলেন, আমরা একটি বিষয় নিয়ে উদ্বিগ্ন। দেশের সকল মানুষের কাছে প্রশ্ন, দেশে আদৌ রাজনীতি থাকবে কি থাকবে না। রাজনীতিকে দেশের অঙ্গন থেকে আমরা বিদায় দিচ্ছি কিনা। কারণ আমরা দেখেছি, দেশে কোন  রাজনৈতিক অ্যাকটিভিটিস (কার্মকা-) নেই।
১৯৭২ সালে আমরা দেখেছি, একটি ব্যাংক ডাকাতি করলে বা ফাঁড়ি লুট করলে সর্বহারার নামে একটা স্লোগান হতো। এখন যারা পেট্রলবোমা মেরে মানুষ হত্যা করছে তারা কিন্তু অবরোধের স্লোগান দেয় না। নীরবে-নিভৃতে তারা পেট্রলবোমা মেরে হত্যাকা- সংঘটিত করে হয় পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়, না হয় ধরা পড়ে। কিন্তু খালেদা জিয়া দাবি করেন, এটা অবরোধ। শিল্পমন্ত্রী বলেন, দেশে রাজনীতিকে বাঁচিয়ে রাখা ও পুনরুজ্জীবিত করার স্বার্থে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত এ কমিটিসহ সবাইকে কঠিন হস্তে এ অপসংস্কৃতির রাজনীতি দমন করতে হবে। আজ যদি এরা প্রাধান্য পায়, সামনে আসে, তবে ভবিষ্যৎ কি হবে? কেউ তা হলে কষ্ট করে রাজনীতি করবে না। কেউ সংগঠন করবে না। পেট্রলবোমা মেরে যদি দাবি আদায় করা যায় তবে ভবিষ্যতে আর রাজনীতি করার প্রয়োজন থাকবে না। তিনি বলেন, সভায় পরিস্থিতি পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবেচনা করে আমরা মোটামুটি সন্তোষ প্রকাশ করার মতো একটি অবস্থায় এসেছি। কারণ ওনাদের (আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী) সর্বাত্মক প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে আমরা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অনেক উন্নতি লক্ষ্য করছি। খালেদা জিয়া কথায় কথায় বলেন, তারা কোন  নাশকতামূলক কাজে জড়িত নন। কিন্তু এ পর্যন্ত  যারা গ্রেপ্তার হয়েছেন তাতে আমরা বলছি, তার তথ্য সঠিক নয়। তিনি যে শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে চান- এটাই আমরা প্রমাণ করে দিচ্ছি। নাশকতার আশঙ্কায় অবরোধের মধ্যে সারা দেশে সাত হাজার ১৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে জানিয়ে শিল্পমন্ত্রী বলেন, ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় ১৫৪ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন। এর মধ্যে বিএনপির ১২৫ জন, জামায়াত-শিবিরের ২৭ ও অন্যান্য দুজন রয়েছেন। এ ছাড়া ঢাকা রেঞ্জে বিএনপির ১৩৪ জন, জামায়াত-শিবিরের ১৮ জন, চট্টগ্রাম রেঞ্জে বিএনপির ১২০ জন, জামায়াত-শিবিরের ২৮  নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হয়েছেন। রাজশাহী রেঞ্জে বিএনপির ৭৬ জন ও জামায়াত-শিবিরের ৩৩ জন, রংপুর রেঞ্জে বিএনপির ৩৮ জন ও জামায়াত-শিবিরের ৬০ জন, খুলনা রেঞ্জে বিএনপির ১১৭ জন ও জামায়াত-শিবিরের ৩৫ জন এবং বরিশাল রেঞ্জে বিএনপির ২২ জন ও জামায়াত-শিবিরের একজন, সিলেট রেঞ্জে বিএনপির ৩৫ জন ও জামায়াত-শিবিরের ১৩ জন, রেলওয়ে রেঞ্জে বিএনপির তিনজন ও জামায়াত-শিবিরের তিন নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হয়েছেন। হাইওয়েতে এখন পর্যন্ত কোন গ্রেপ্তারের খবর পাওয়া যায়নি। নাশকতার সঙ্গে সরাসরি জড়িত থাকা অবস্থায় স্পট এবং এর আশপাশের এলাকা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে দাবি করে শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু ১৬ থেকে ২০শে জানুয়ারি পর্যন্ত ঢাকার সঙ্গে বিভিন্ন জেলার যান চলাচলের সার্বিক চিত্র সাংবাদিকদের সামনে উপস্থাপন করে বলেন, এ সময় সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ১৭ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৬৬ হাজার গাড়ি (বাস, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, অয়েল ট্যাঙ্কার, জিপ) হাইওয়ে দিয়ে ঢাকায় এসেছে এবং ঢাকা থেকে বিভিন্ন স্থানে ছেড়ে গেছে। সংবাদকর্মীদের উদ্দেশে আমু প্রশ্ন রেখে বলেন, আপনারা এদেশের সন্তান। প্রতিদিন ৩৫ হাজার গাড়ি যাতায়াত করে। কোথায় একটি গাড়িতে আগুন দেয় সেই খবর দুই বা তিন দিন ধরে দেখান। অথচ গাড়ি যাতায়াতের খবর একটু  দেখিয়ে আর দেখান না। এটা কেন? এটা কি সন্ত্রাসীদের উৎসাহিত করা হচ্ছে না?
কমিটি’র প্রধান শিল্পমন্ত্রী বলেন, খালেদা জিয়ার কি মনে নেই আমরা অবরোধ করেছিলাম, তখন ইয়াজউদ্দিনের বঙ্গভবন থেকে শুরু করে হাইওয়ে, জেলা-উপজেলার সড়কে লাখ লাখ লোক বসে অবরোধ করেছিল। ওটা হলো অবরোধ। এখন যারা পেট্রলবোমায় মানুষ মেরে অবরোধ করে, তারা দেশ থেকে রাজনীতি বিদায় করতে চায়। নকশালবাদীদের মতো একটা দল তারা গঠন করতে চায়। সন্ত্রাসী কার্যকলাপের জন্য বিএনপি মানুষের কাছে পরিত্যক্ত হয়েছে দাবি করে বর্ষীয়ান এ রাজনীতিবিদ বলেন, মানুষের ধারণা তাদের রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তাদের রাজনীতি মানুষ গ্রহণ করছে না। তাই মানুষের প্রতি আস্থা হারিয়ে তারা প্রতিহিংসামূলক হত্যাকা-  ঘটাচ্ছে। মানুষ হত্যা করার এ রাজনীতি সফল হতে পারে না, পারে না, পারে না। এটা আমরা অনুধাবন করেছি। সেভাবেই আমাদের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে, ভবিষ্যতেও হবে।
আমির হোসেন আমু বলেন, ডিসি (জেলা প্রশাসক), এসপিসহ (পুলিশ সুপার) বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিদের নিয়ে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে আমাদের আইনশৃঙ্খলা কমিটি রয়েছে। সকল নির্বাচিত প্রতিনিধি, গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল ও মুক্তিযুদ্ধের সকল পক্ষকে যুক্ত করে এ কমিটি আরও শক্তিশালী করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এর বাইরে কিছু এলিট ব্যক্তিকে এ কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে শান্তি স্থাপনের জন্য নির্দেশ দেয়া হচ্ছে। প্রেস ব্রিফিংয়ের শুরুতে আমির হোসেন আমু জানান, এ সভায় বাণিজ্যমন্ত্রী  তোফায়েল আহমেদ, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, পানিসম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু, পুলিশের মহাপরিদর্শক একেএম শহীদুল হক, র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ, বিজিবি মহাপরিচালক  মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ এবং ডিজিএফআই, এনএসআই, এসবি, কোস্টগার্ড ও আনসারের প্রধানসহ কমিটির সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত ছিলেন।

No comments

Powered by Blogger.