রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মিয়ানমারে পাঠাতে যুক্তরাষ্ট্র কাজ করছে

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পুনর্বাসনে যুক্তরাষ্ট্র অঙ্গীকারবদ্ধ বলে জানিয়েছেন ঢাকা সফররত মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের জনসংখ্যা, শরণার্থী ও অভিবাসনবিষয়ক সহকারী মন্ত্রী এ্যান সি. রিচার্ড। এ ইস্যুতে আগামী দিনে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের অংশীদারিত্ব আরও জোরদার হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। ‘ইউএস পলিসি অন রিফিউজি, মাইগ্রেশন অ্যান্ড পপুলেশন ডাইনামিকস’ শীর্ষক এক বক্তৃতায় তিনি এসব কথা বলেন। রোহিঙ্গা অধ্যুষিত রাখাইন রাজ্যসহ মিয়ানমারের বিভিন্ন এলাকা সফর করে মঙ্গলবার ঢাকায় এসেছেন তিনি। ওবামা প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ এই প্রতিনিধি এখানে তিন দিন অবস্থান করবেন। রাজনীতিক, প্রশাসনের প্রতিনিধি ও গণমাধ্যমের সঙ্গে সিরিজ মিটিং করবেন। বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের জীবনমান সরজমিন দেখতে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পও পরিদর্শনে যাবেন তিনি। গতকাল পররাষ্ট্র সচিব এম শহীদুল হকের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক সেরেছেন। অবশ্য এর আগে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্যাটেজিক স্টাডিজ (বিস) আয়োজিত এমিনেন্ট পারসন লেকচারে অংশ নেন। ইস্কাটনস্থ প্রতিষ্ঠানের অডিটরিয়ামে অনুষ্ঠিত ওই বক্তৃতায় মার্কিন মন্ত্রী শরণার্থী ইস্যুতে আমেরিকার নীতি বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন। বলেন, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর বিশেষ করে দেশটির আরাকান প্রদেশের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাখাইন সমপ্রদায়ের সঙ্গে দ্বন্দ্বের কারণে বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। তাদের ‘মিয়ানমারের নাগরিক’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, তাদের স্বেচ্ছায় দেশটিতে ফেরত পাঠাতে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র কাজ করছে। বেশির ভাগ রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুত উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ কারণে দেশটির নাগরিকত্ব সংক্রান্ত আইনে এরা ‘এথনিক গ্রুপ’ হিসেবে স্বীকৃতি পাচ্ছে না। আর বাস্তুচ্যুত বলেই এরা নানা রকম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে। দেশটির অভ্যন্তরে  ‘ভাসমান’ হয়ে পড়ার কারণে তারা প্রতিবেশী দেশগুলোর দিকে ছুটে। তাদের উদ্বাস্তু হওয়া ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র কাজ করছে বলেও জানান তিনি। বক্তৃতায় প্রেসিডেন্ট ওবামার উদ্যোগের বিষয়টি স্মরণ করে মার্কিন মন্ত্রী বলেন, ক’বছর আগে আমি মিয়ানমার সফর করি। ঢাকায় আসার আগে যখন দেশটি সফরে যাই তখন দেখি অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে। রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে দেশটির শীর্ষ নেতৃত্বের মনোভাবে অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন দেখেছেন বলেও উল্লেখ করেন মার্কিন ওই প্রতিনিধি। মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের প্রতি দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মূল উৎপাটনে মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এটির স্থায়ী সমাধান জরুরি। এ জন্য সংঘাতময় এলাকায় ‘পারস্পরিক সংলাপ’- চালু করতে হবে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে চলমান যুদ্ধ-বিগ্রহ, ধর্মীয় সংঘাত ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপসহ নানা কারণে শরণার্থীদের বিষয়টি এখন অনেক দেশেই দেখা যায়- এমন মন্তব্য করে মার্কিন মন্ত্রী বলেন, বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায় তখনই যখন এসব শরণার্থী ক্যাম্প  ছেড়ে নগর-বন্দর ও লোকালয়ে ছড়িয়ে পড়ে। তিনি উদ্বাস্তুদের বিশেষ করে উদ্বাস্তু নারী ও শিশুদের অধিকারের ব্যাপারে আরও আন্তরিক হওয়ার আহ্বান জানান। ২০১৪ সালকে একটি কঠিন বছর আখ্যায়িত করে ওবামা প্রশাসনের ওই কর্মকর্তা বলেন, ওই বছরে মানুষ-সৃষ্ট দুর্যোগ সর্বনিম্ন স্তরে  নেমে এসেছিল। এই বছরে বেশ কয়েকটি কুৎসিত যুদ্ধ মানুষ দেখেছে যাতে অনেকেই গৃহহারা হয়েছেন, পরিণত হয়েছেন উদ্বাস্তুতে। উদাহরণস্বরূপ তিনি বলেন, শুধুমাত্র সিরিয়ার যুদ্ধেই ১ কোটি ২ লাখ মানুষ গৃহহারা হয়ে উদ্বাস্তু জীবনযাপনে বাধ্য হয়েছেন। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর-এর বরাত দিয়ে তিনি বলেন, বর্তমানে সারা বিশ্বে ৫ কোটিরও বেশি শরণার্থী রয়েছে যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বেশি। তিনি সামপ্রতিক শরণার্থী পরিস্থিতিকে ভয়াবহ উল্লেখ করে এ জন্য ইরাকে আইএসআইএসের সন্ত্রাসী কর্মকা-, দক্ষিণ ও মধ্য সুদানে গৃহযুদ্ধ, ইউক্রেনে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের যুদ্ধ এবং গাজায় ইহুদি ও হামাসের যুদ্ধকে দায়ী করেছেন। মার্কিন মন্ত্রী গত প্রায় দুই দশক ধরে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের আশ্রয়  দেয়ার জন্য বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানান। যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ওই প্রতিনিধির বক্তৃতার আয়োজনে সভাপতিত্ব করেন বিস-এর চেয়ারম্যান রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমেদ। সমাপনী বক্তব্য রাখেন পররাষ্ট্র সচিব  মো. শহীদুল হক। অনুষ্ঠানের উন্মুক্ত আলোচনায় বক্তারা বলেন, সামপ্রতিক সময়ে শরণার্থী ও অভিবাসন ইস্যু মানবাধিকার ও মানবিক নিরাপত্তার দৃষ্টিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ ও অনুন্নত দেশের পক্ষে অত্যন্ত কঠিন কাজ হলেও এখানে দুই দশক ধরে বিপুল পরিমাণ মিয়ানমার নাগরিক শরণার্থী হিসেবে আশ্রয়ে রয়েছে। পররাষ্ট্র সচিব তার সমাপনী বক্তৃতায় বলেন, রোহিঙ্গা শরণার্থী ও আন ডকুমেন্টেট মিয়ানমার নাগরিকদের নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে দেশটির সরকারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। এ কাজে যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের আরও বেশি সমর্থন ও সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন তিনি।

No comments

Powered by Blogger.