সিলেটে বিএনপির সব অংশের নেতারা মাঠে আজ ও কাল হরতাল by ওয়েছ খছরু

গ্রেপ্তার আতঙ্কে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন সিলেট বিএনপি নেতারা। যারা এ আতঙ্ককে ছাপিয়ে মাঠ গরম করে রেখেছিলেন তাদের অনেকেই গ্রেপ্তার হয়ে গেছেন। কেউ কেউ ক্রমাগত হুমকির মুখে আড়ালে থেকে পরিচালনা করছেন কর্মকাণ্ড। স্বস্তিতে নেই মাঠ পর্যায়ের নেতারাও। ধরা পড়লেই সহিংসতার মামলায় ‘অজ্ঞাত আসামি’ হিসেবে আদালতে যেতে হচ্ছে তাদের। একই অবস্থা বিরাজ করছে সিলেটের জামায়াতে ইসলামীতেও। সিনিয়র নেতারা গ্রেপ্তার হয়ে কারাবন্দি। চলতি সহিংসতায় গত ৯ দিনে সিলেটের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে কমপক্ষে ১০টি মামলা করা হয়েছে। আসামি হয়েছেন সহস্রাধিক। সিনিয়র ১০ নেতাসহ গ্রেপ্তার করা হয়েছে শতাধিক নেতা-কর্মী। গাড়ি পোড়ানো, ভাঙচুর মামলা সিলেটে প্রতিদিনই হচ্ছে। এ অবস্থায়ও থেমে নেই সিলেটে মাঠের আন্দোলন। ছাত্রদলের ‘বি-টিম’ বলে পরিচিত বিদ্রোহী অংশের নেতারা এবার নেমেছেন মাঠে। মাঠ ধরে রাখতে মান-অভিমান ভুলে বিএনপির সব অংশের নেতারা মাঠে সক্রিয় রয়েছেন। সিলেট বিএনপির এ মুহূর্তের শীর্ষ নেতা বিএনপির সহসভাপতি শমসের মবিন চৌধুরী। কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এম ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে তিনিই সিলেট বিএনপির কার্যক্রমকে দেখভাল করছেন। কয়েক দিন আগে ঢাকায় গ্রেপ্তার হয়েছেন শমসের মবিন চৌধুরী। এখন শমসের মবিনের অবর্তমানে কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. সাখাওয়াত হোসেন জীবন সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড দেখভাল করছেন। শমসের মবিন চৌধুরী গ্রেপ্তার হওয়ার অনেক আগেই কারাগারে গেছেন সিলেটের মেয়র ও বিএনপি নেতা আরিফুল হক চৌধুরী। সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এস এম কিবরিয়া হত্যা মামলার তৃতীয় দফা দাখিল করা চার্জশিটে আসামি হয়ে কারান্তরীণ হন তিনি। এরপর চলতি অবরোধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নগরীর চৌহাট্টা এলাকা থেকে গ্রেপ্তার হন সিলেট মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক ডা. শাহরিয়ার হোসেন চৌধুরীকে। তার সঙ্গে ছাত্রদলের আরও দুই নেতাকেও গ্রেপ্তার করা হয়। বিএনপি নেতা শমসের মবিন চৌধুরী ও ডা. শাহরিয়ার হোসেন চৌধুরী গ্রেপ্তার হওয়ার প্রতিবাদে গেলো সপ্তাহে সিলেটে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। সিলেট বিএনপির শীর্ষ ওই তিন নেতা গ্রেপ্তারের পাশাপাশি সিলেটে অবরোধ-হরতাল কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে ইতিমধ্যে আরও শতাধিক নেতা-কর্মী গ্রেপ্তার করা হয়েছেন। এরপর মধ্যে সর্বশেষ গত সোমবার সন্ধ্যায় গ্রেপ্তার হয়েছেন সিলেট মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব বদরুজ্জামান চৌধুরী সেলিম। মহানগর আহ্বায়ক গ্রেপ্তারের পর সদস্য সচিব বদরুজ্জামান সেলিম কর্মসূচি পালন করছিলেন। কিন্তু  সোমবার বদরুজ্জামান সেলিম সিলেট মহানগরীর সকল পর্যায়ের নেতাকর্মীকে আহ্বান জানিয়ে একটি বিবৃতি সংবাদপত্রে পাঠানোর পরপরই নগরীর তোপখানা এলাকাস্থ শ্বশুরবাড়ি থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে। এর আগে পুলিশ সিলেট মহানগর বিএনপির সহসভাপতি মাহফুজুল করিম জেহিন ও সিলেট জেলা ছাত্রদলের সভাপতি আহমদ চৌধুরী ফয়েজকে গ্রেপ্তার করে। জেহিনকে তার খাসদবিরস্থ বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হলেও সিলেটের জিন্দাবাজার থেকে ফয়েজকে আটক করা হয়। ওদিকে, জামায়াতে ইসলামীর সিলেট মহানগরের আমীর অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়েরও ছিলেন জেলে। সমপ্রতি তিনি কারাগার থেকে মুক্ত হয়েছেন। গতকাল দুপুরে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করেছে। এর আগে মহানগর জামায়াতের নায়েবে আমীর হাফিজ আবদুল হাই হারুন, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা সোহেল আহমদ গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। এছাড়া শিবিরের অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী এখন জেলে রয়েছেন বলে জামায়াত সূত্র দাবি করেছে। বিএনপি সূত্র জানিয়েছে, গত ৮ দিনের মধ্যে যারা গ্রেপ্তার হয়েছেন তাদের অধিকাংশকেই চলতি সহিংসতার ঘটনায় মামলায় আসামি করা হয়। গ্রেপ্তারের পাশাপাশি জীবন নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন নেতারা। এরই মধ্যে সিলেট জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক, স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি অ্যাডভোকেট শামসুজ্জামান জামানকে ধরে নিয়ে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে। জামানের বিরুদ্ধে রয়েছে বেশ কয়েকটি মামলা। এরপরও প্রতিদিনই সিলেটের রাজপথে সহিংস ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে তার অনুসারীরা। তবে, এডভোকেট শামসুজ্জামান জামান জানিয়েছেন, ধরপাকড় করে কিংবা গুলি চালিয়ে আন্দোলন দমানো যাবে না। এতে করে রাজপথ আরও উত্তপ্ত হচ্ছে। তিনি এজন্য পুলিশ প্রশাসনকে আরও বেশি সংযমী হওয়ার আহ্বান জানান। পুলিশ সংযমী হলে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন হবে বলে জানান তিনি। নেতাকর্মীদের বাসা বাড়িতে তল্লাশির অভিযোগ করেছেন সিলেট বিএনপির নেতারা। গতকাল সিলেট জেলা বিএনপির আরেক যুগ্ম আহ্বায়ক আলী আহমদ জানিয়েছেন, নগরীর জিন্দাবাজারে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে তল্লাশির নামে ভাঙচুর চালিয়েছে পুলিশ। এরপর থেকে তাকে গ্রেপ্তারে পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। পুলিশি ধরপাকড় ও অভিযানের কারণে ইতিমধ্যে আড়ালে চলে গেছেন সিলেট বিএনপির সিনিয়র নেতারা। মামলায় পড়ে গ্রেপ্তার এড়াতে তারা আত্মগোপনে থেকেই অনুসারীদের দিয়ে কর্মসূচি পালন করছেন। সিলেট জেলা বিএনপির সিনিয়র নেতা ও সাবেক এমপি দিলদার হোসেন, মহানগরের সাবেক সভাপতি এম এ হক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুল কাইয়ূম জালালী পংকি, সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি নাসিম হোসাইন, সাবেক যুগ্ম সম্পাদক আজমল বখত সাদেক, জিয়াউল গনি আরেফিন জিল্লুরসহ সিনিয়র নেতারা আড়ালে থেকে কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। এর মধ্যে কেউ কেউ কখনও প্রকাশ্য মাঠে নেমে মিছিল-সমাবেশে অংশ নিচ্ছেন। এ অবস্থায় সিলেট বিএনপির নিষ্ক্রিয় থাকা অংশের নেতারা সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। এ কারণে সিলেটের রাজপথে আন্দোলন স্তিমিত হওয়ার চেয়ে উত্তাপ ছড়াচ্ছে বেশি। গত কয়েক দিন সিলেটে অবাধে গাড়ি ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগসহ নানা ঘটনাবলীর মধ্যে নিষ্ক্রিয় থেকে সক্রিয় হওয়ার প্রমাণ দেখিয়েছেন। আর এর মধ্যে দিয়ে ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে রাজপথ। বৃহস্পতিবার হরতাল ডাকলেন বিদ্রোহীরা: খালেদা জিয়াকে অবরুদ্ধ করে রাখা, তারেক রহমানের নামে মামলা দায়েরের প্রতিবাদে এবং জেলা ছাত্রদলের সিনিয়র সহসভাপতি আহমেদ চৌধুরী ফয়েজ ও মহানগরের সিনিয়র সহসভাপতি মাহফুজুল করিম জেহিনসহ কারান্তরীণ জাতীয় ও স্থানীয় নেতৃবৃন্দের মুক্তির দাবিতে বৃহস্পতিবার সিলেট জেলায় সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছে ছাত্রদল। সিলেট জেলা ও মহানগর ছাত্রদলের কমিটি প্রত্যাখ্যানকারী বিদ্রোহী নেতারা গতকাল এক বিবৃতির মাধ্যমে এ হরতাল আহ্বান করেন। হরতাল আহ্বান করে বিবৃতিদানকারী নেতৃবৃন্দরা হলে, ছাত্রদল সিলেট জেলা শাখার সাবেক সাধারণ সমপাদক সৈয়দ সাফেক মাহবুব, ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় সদস্য ও সিলেট জেলার সাবেক সাংগঠনিক সমপাদক মাহবুবুল হক চৌধুরী, সিলেট জেলা ছাত্রদলের সাবেক সহসাংগঠনিক সমপাদক শাকিল মুরশেদ, মহানগর ছাত্রদলের সাবেক সমাজসেবা সমপাদক রেজাউল করিম নাচন, ছাত্রদল নেতা অর্জুন ঘোষ, সাবেক সাহিত্য ও প্রকাশনা সমপাদক লোকমান আহমদ। ফের গ্রেপ্তার জুবায়ের: সিলেট মহানগর জামায়াতের আমীর অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের ফের গ্রেপ্তার হয়েছে। গতকাল দুপুরে সিলেট নগরীর জিন্দাবাজার এলাকা থেকে কোতোয়ালি থানা পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। সিলেটের কোতোয়ালি থানার ওসি আসাদুজ্জামান জানিয়েছেন, জুবায়েরের বিরুদ্ধে থানায় মামলা থাকায় পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করেছে। এর আগে ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সদস্য জগৎজ্যোতি তালুকদার হত্যা মামলায় কারান্তরিণ হয়েছিলেন অ্যাডভোকেট জুবায়ের। সমপ্রতি তিনি ওই মামলায় জামিনে বের হন। বুধবার হরতাল শিবিরের: সিলেট মহানগর জামায়াতের আমীর অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়েরের মুক্তির দাবিতে সিলেট মহানগরীতে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ঘোষণা করেছে ছাত্রশিবির। গতকাল বিকাল সোয়া ৩টায় সিলেট নগরীর সুবিদবাজারে মিছিল পরবর্তী সমাবেশ থেকে হরতাল ঘোষণা করেন মহানগর ছাত্রশিবিরের সভাপতি আবদুর রাজ্জাক। এহসানুল মাহবুব জুবায়েরকে মুক্তি না দিলে আগামীতে আরও কঠোর কর্মসূচি দেয়ারও হুমকি দেন তিনি। সিলেট মহানগর জামায়াতের সভাপতি অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়েরকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে ও তার মুক্তির দাবিতে মঙ্গলবার দুপুরে সোবহানীঘাট থেকে মিছিল বের করার চেষ্টা করে শিবির। পুলিশের তৎপরতার কারণে সেখানে মিছিল বের করতে ব্যর্থ হয়ে বন্দরবাজার করিমউল্লাহ মার্কেটের সামনে থেকে মিছিলের চেষ্টা করে। কিন্তু তাতেও ব্যর্থ হন নেতাকর্মীরা। সর্বশেষ সুবিদবাজারে ঝটিকা মিছিল করে শিবির। মিছিল-পরবর্তী সমাবেশ থেকে এহসানুল মাহবুব জুবায়েরের মুক্তির দাবিতে মহানগর শিবিরের সভাপতি আবদুর রাজ্জাক আগামীকাল সিলেট মহানগরীতে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ঘোষণা করেন। বিএনপির নিন্দা: সিলেট মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব বদরুজ্জামান সেলিমকে গ্রেপ্তার ও জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক আলী আহমদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে তল্লাশির নিন্দা জানিয়েছেন সিলেট জেলা ও মহানগর বিএনপির শীর্ষ নেতৃবৃন্দ। নেতৃবৃন্দ এক যুক্ত বিবৃতিত বলেন, ‘দেশ আজ ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর চালানো হচ্ছে নির্যাতন নিপীড়ন। বাসাবাড়ি ও অফিসে তল্লাশির নামে চলছে হয়রানি। দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশ গুলি করে বিরোধী দলের নেতা কর্মীদের হত্যার চেষ্টা করছে। বিবৃতিদাতা নেতারা হলেন- সিলেট জেলা বিএনপির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট নুরুল হক, মহানগর বিএনপির সাবেক সভাপতি এম এ হক, জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক সাবেক সংসদ সদস্য দিলদার হোসেন সেলিম, জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট আব্দুল গফ্‌ফার, মহানগর বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুল কাইয়ুম জালালী পংকী, জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক আবদুল কাহের শামীম, আবদুল রাজ্জাক, মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি সদস্য অ্যাডভোকেট নোমান মাহমুদ, নাসিম হোসেন, এডভোকেট হাবিবুর রহমান, আলী আহমদ, অ্যাডভোকেট শামছুজ্জামান জামান, এম এ মান্নান, মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য হুমায়ুন কবির শাহীন, আজমল বক্ত সাদেক, জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ইমরান আহমদ চৌধুরী, মহানগর বিএনপির সদস্য মিফতা সিদ্দিকী, এমদাদ হোসেন চৌধুরী, ওমর আশরাফ ইমন, হাদীয়া চৌধুরী মুন্নী, ডা. মো. নাজমুল ইসলাম, এম এ রহিম, ফয়জুর রহমান জাহেদ, কাউন্সিলর সৈয়দ তৌফিকুল হাদী, কাউন্সিলর মিছবাহ উদ্দিন, মঈন উদ্দিন সুহেল, অহাদুসামাদ, আবদুল জব্বার তুতু, মুফতি বদরুনূর সায়েক, রেজাউল করিম আলো, মুফতি নেহাল, মুকুল মুর্শেদ, আলাউদ্দিন।

No comments

Powered by Blogger.