হিজাব পরিধান একজন নারীর সাংবিধানিক অধিকার - হাইকোর্ট : ২১ নারীকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার ও ধর্মীয় স্বাধীনতা লঙ্ঘনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট

রাজধানীর মগবাজার এলাকা থেকে ৫৪ ধারায় ২১ পর্দানশিন নারীকে গ্রেফতার ও হিজাব খুলে তাদের আদালতে হাজিরের ঘটনার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করা হয়েছে। বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার ও বিচারপতি মুহাম্মদ খুরশীদ আলম সরকার সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চে গতকাল আবেদনের ওপর দীর্ঘ শুনানি হয়। শুনানি শেষে আদালত বিষয়টি স্ট্যান্ড ওভার রেখে আবেদনটি সংশোধন করে নিয়ে আসতে বলেছে। আবেদনে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার হওয়া মহিলাদের রিমান্ডে নেয়ার বৈধতাকেও চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। একই সঙ্গে দোষী পুলিশ সদস্যদের শাস্তির আর্জি জানানো হয়েছে। শুনানির একপর্যায়ে আদালত বলেছে, রিমান্ডের ব্যাপারে আমরা কোনো কথা বলব না। আপনি আবেদনটি সংশোধন করে নিয়ে আসেন তারপর দেখা যাক। আগামী মঙ্গলবার আবেদনের ওপর আবার শুনানি হবে বলে জানিয়েছেন রিটকারী আইনজীবী। আদালতে আবেদনের পক্ষে রিটাকারী আইনজীবী ফাহিমা নাসরিন মুন্নি নিজেই শুনানি করেন। তার সঙ্গে ছিলেন অ্যাডভোকেট এবিএম ওয়ালিউর রহমান খান, অ্যাডভোকেট মাহমুদা খাতুন, আনোয়ারা বেগম, চেমন আক্তার প্রমুখ। শুনানিতে অংশ নিয়ে ফাহিমা নাসরিন মুন্নি বলেন, নারীদের হিজাব পরিধান একটি ধর্মীয় রীতি। একজন মানুষকে ধর্মীয় রীতিনীতি পালনের অধিকার সংবিধান দিয়েছে, কিন্তু পর্দানশিন ২০ নারীর হিজাব খুলে আদালতে হাজির করা হয়েছে। কোনো অভিযোগ ছাড়াই তাদের গ্রেফতারের সময় অশোভন আচরণ করেছে পুলিশ। এতে তাদের সামাজিক মর্যাদা ও ব্যক্তিগত অধিকার ক্ষুণ্ন হয়েছে। হিজাব খোলার মধ্য দিয়ে তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতাকে লঙ্ঘন করা হয়েছে। এ সময় তিনি কানাডায় এক পর্দানশিন মহিলার হিজাব ধরে টান দেয়ার অপরাধে আরেক মহিলার সাজাভোগের উদাহরণ টানেন। পুলিশের এমন আচরণে ধর্মীয় স্বাধীনতা চরমভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। আবেদনকারী আইনজীবী বলেন, ২১ মহিলাকে যেভাবে পুরুষ পুলিশ গ্রেফতার করেছে ও তাদের আদালতে হাজির করেছে, এটা আমাদের সাংবিধানিক অধিকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। আইনশৃঙ্খলা রক্ষকারী বাহিনীর উচিত সংবিধানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া। তখন আদালত বলেছে, কেন আপনারা ওই কোর্টে এসব ব্যাপারে লিখিত আবেদন দিলেন না। আপনারা কোর্টকে ব্যাপারটা জানান। আদালত বলেছে, হিজাব পরাটা তাদের (২১ নারীর) ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ব্যাপার। মানুষের স্বাধীনভাবে ধর্ম পালনের অধিকার রয়েছে। এটা কেন কোর্টকে (রিমান্ড মঞ্জুরকারী চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত) জানাচ্ছেন না। কোর্ট তা রক্ষায় পদেক্ষপ না নিলে তারপর আমাদের কাছে আসেন। এটা তো তাদের সাংবিধানিক অধিকার। জবাবে আইনজীবী বলেন, বিষয়টি দেশের মিডিয়ায় এসেছে। আমরা কোর্টকে মৌখিকভাবে জানিয়েছি, কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। তাদের একটা রাজনৈতিক দলের কর্মী হিসেবে ধরা হচ্ছে। আর পুলিশের এভাবে গ্রেফতার চলতে থাকলে এক সময় সামাজিক বিপর্যয় শুরু হবে। একপর্যায়ে আদালত বলেছে, ধর্মীয় স্বাধীনতা সবার আছে। তা কেউ ক্ষুণ্ন করতে পারে না। রাজনীতি হচ্ছে আরেকটা ব্যাপার। নিচে শুনানির অংশবিশেষ তুলে ধরা হলো
আদালত : ধরেন আমরা একটা অর্ডার দিলাম। এটা বাস্তবায়ন হচ্ছে না, কী করবেন।
আইনজীবী : মাইলর্ড এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ আমাদের জন্য।
আদালত : আমরা কী গিয়ে বাস্তবায়ন করে দিয়ে আসব।
আপনি যদি সেখানে (রিমান্ড মঞ্জুরকারী নিম্ন আদালত) বলে আসতেন, তাহলে বলতাম।
আইনজীবী : মৌখিকভাবে এ সাবমিশন দেয়া হয়েছে। আর ব্যাপারটা সব মিডিয়ায় এসেছে। সবাই জানে।
আদালত : মিডিয়ায় আসা আর আদালতকে জানানো এক কথা নয়। ব্যাপারটাতে আদালতের কনসার্ন নাও থাকতে পারে।
আইনজীবী : ব্যাপারটাকে আসলে পলিটিক্যালি দেখা হচ্ছে মাইলর্ড।
আদালত : এখানে ব্যাপারটা পলিটিক্যাল নয়। এখানে একজন নারীকে ‘রিলেজিয়াস হ্যারাজমেন্ট’ করা হয়েছে। পলিটিক্স টেনে আনছেন কেন।
আদালত ওই আইনজীবীকে উদ্দেশ করে বলেছে, এদেশে কি এমন নারী নেই, যারা পলিটিক্স করে না। কিন্তু হিজাব পরে, এমন পুরুষও তো আছে, যারা রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নয়, কিন্তু দাড়ি রাখে, টুপি পরে। তারা কী তাহলে এসব করতে পারবে না।
আইনজীবী : মাইলর্ড এমন মানুষ আছে, কিন্তু হয়রানি করা হচ্ছে।
আদালত : আপনারা সেখানে (বিচারাধীন সিএমএম আদালত) একটা লিখিত আবেদন করেন, যদি রেসপন্স না করে, তবে আমাদের কাছে আসেন, আমরা দেখব।
আইনজীবী : তারা রেসপন্স করবে না, মাইলর্ড।
আদালত : ওখানে আবেদন না করে কীভাবে আপনি বললেন রেসপন্স করবে না। আগে যান।
আইনজীবী : মাইলর্ড, এখানে ধর্মীয় স্বাধীনতা লঙ্ঘন একটা ব্যাপার। কিন্তু একজন মানুষের মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন করা হয়েছে। একজন মানুষের স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার অধিকার আছে, তাকে মত প্রকাশের স্বাধীনতা সংবিধান দিয়েছে।
আদালত : অফকোর্স, আছে। সে জন্যই তো বলছি আগে সেখানে যান।
আইনজীবী : আমরা লিখিত দিইনি, কিন্তু মুখে সাবমিশন দিয়েছি মাইলর্ড। তারা শুনেনি। মাইলর্ড আমরা আবেদনের সঙ্গে কতগুলো ছবি দিয়েছি। ছবিগুলো দেখেন কীভাবে টেনেহিঁচড়ে তাদের পুলিশের গড়িতে তোলা হয়েছে। মুখের নেকাব খুলতে বাধ্য করা হয়েছে।
এ সময় ফাহিমা নাসরিন মুন্নির পক্ষে অ্যাডভোকেট ওয়ালিউর রহমান খান শুনানির অনুমতি চাইলে আদালত তা মঞ্জুর করে।
ওই আইনজীবী বলেন, মাইলর্ড সম্প্রতি ভারতের দিল্লিতে যে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, সে ঘটনা মিডিয়ায় আসার পর সে দেশের হাইকোর্ট সুয়োমোটো রুল জারি করেছে। আপনারা তো অন্তত সুয়োমোটো (স্বপ্রণোদিত হয়ে) রুল জারি করতে পারেন।
আদালত : সুয়োমোটো জারি করলে আপনারা আবেদন নিয়ে এসেছেন কেন।
আদালত বলেছে, এখানে দুটি ব্যাপার। একটা হচ্ছে তাদের পুলিশ ‘রিলেজিয়াস হ্যারাজ’ করেছে। আরেকটা হচ্ছে সে হ্যারাজমেন্ট এখনও করা হচ্ছে কি-না। আপনারা এ ব্যাপারে আদালতে গিয়ে প্রতিকার কেন চাচ্ছেন না। ওখান থেকে একটা অর্ডার নেন।
আইনজীবী : মাইলর্ড এখানে একটা মানুষের সাংবিধানিক অধিকার ক্ষুণ্নের ঘটনা ঘটেছে। আপনারা তো চাইলে রুল দিতে পারেন।
আদালত : এটা বিচারাধীন বিষয়। আমরা কীভাবে আদেশ দেব।
আইনজীবী : আমরা তো নিম্ন আদালতের কোনো আদেশের বিরুদ্ধে আসিনি।
আদালত : আমরা তা বলছি না। তবে আপনারা কেন সেখানে তাদের ধর্মীয় রীতিনীতি পালনের সুযোগ দেয়ার আবেদন করছেন না। কোর্ট তো আপনাদের আবেদন শুনেছে।
এ পর্যায়ে অ্যাডভোকেট ফাহিমা নাসরিন মুন্নি আবার শুনানি করেন। তিনি বলেন, মাইলর্ড একদল পুরুষ পুলিশ তাদের যেভাবে টেনেহিঁচড়ে গ্রেফতার করেছে তা একজন নারীর জন্য চরম অবমাননাকর। আদালত : তাহলে পুলিশের অ্যাকটিভিটিজের ওপর কেন রুল চাচ্ছে না। পুলিশ তাদের কীভাবে অ্যারেস্ট করেছে, কীভাবে আদালতে এনেছে, কেমন আচরণ করেছে—এসবের প্রতিকার চান।
আইনজীবী : মাইলর্ড পুলিশের অ্যাকটিভিটিজের বিরুদ্ধে আমরা প্রতিকার চাচ্ছি
আদালত : কই চাইলেন, আপনারা তো দেখি রিমান্ডের আদেশকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। আমরা রিমান্ডের ব্যাপারটা দেখব না। পুলিশের ব্যাপারটা নিয়ে আবেদন করেন।
আইনজীবী : মাইলর্ড পরের প্রেয়ারটা দেখেন আমরা পুলিশের এমন আচরণের প্রতিকার চেয়েছি।
আদালত : খালি আবেদন করলে তো হবে না। আমরা বিবেচনা করব কি-না চিন্তা করব।
আইনজীবী : মাইলর্ড ৫৪ ধারায় কীভাবে তাদের গ্রেফতার করা হলো। তারপর রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে।
শুনানির এ পর্যায়ে জুনিয়র বিচারপতি বলেন, রাস্তা থেকে ২১ পর্দানশিন নারীকে ধরে নিয়ে যাওয়া আর তাদের ধরে নিয়ে যাওয়া কিন্তু এক নয়।
আইনজীবী : কেন, মাইলর্ড। তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। ৫৪ ধারায় অ্যারেস্ট করে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে।
আদালত : তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট মামলা আছে তো।
আইনজীবী : কোনো মামলা নেই মাইলর্ড। তাদের ৫৪ ধারায় অ্যারেস্ট করে এতদিন আটক রাখা হয়েছে।
আদালত : পরে তাদের নামে মামলা দেয়া হয়েছে।
আইনজীবী : আপনি দেখেন মাইলর্ড কোনো মামলা নেই। শুধু একটি জিডির ভিত্তিতে এসব করা হচ্ছে। আদালত সেসব দেখেও তাদের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে।
আইনজীবী বলেন, মাইলর্ড ২১ জন পর্দানশিন নারীকে পুরুষ পুলিশ টানাহিঁচড়া করে গ্রেফতার করল। এর প্রতিকার কী।
আদালত : তাদের তো নারী পুলিশ গ্রেফতার করেছে।
আইনজীবী : মাইলর্ড, ২১ জন নারীকে গ্রেফতারের সময় দু’জন নারী পুলিশ উপস্থিত ছিল। ২১ জন নারীকে কখনও দু’জন নারী গ্রেফতার করতে পারে না। এমনটা করতে হলে ওই দু’নারীকে হয় বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী হতে হবে, নয় তো তাদের একেকজনের ২০টি করে হাত থাকতে হবে।
আইনজীবী বলেন, এ ঘটনা থেকেই বোঝা যায় মাইলর্ড আমরা শ্রদ্ধা ও সম্মান ভুলে গেছি। এমন অবস্থায়ও তাদের জামিন হয় না। কোনো কিছুতেই আমাদের আর বাধে না।
একপর্যায়ে আদালত বলেছে, আপনার আবেদনটি সংশোধন করে নিয়ে আসেন। আইনজীবী আবেদনটি তাত্ক্ষণিক সংশোধন করে (সাপ্লিমেন্টারি) আবার জমা দিতে চাইলে আদালত বলেছে, সাপ্লিমেন্টারি দিলে হবে না নতুন করে আবেদন করতে হবে। আমরা মেটারটাকে স্ট্যান্ডওভার রেখে দিলাম।
তখন দু’দিনের সময় চাইলে আদালত সময় মঞ্জুর করে। আগামী মঙ্গলবার বিষয়টির ওপর আবার শুনানি হতে পারে বলে জানান অ্যাডভোকেট ফাহিমা নাসরিন মুন্নি।
প্রসঙ্গত, গত ১৭ ডিসেম্বর মগবাজারের একটি বাসা থেকে ২১ নারীকে ধরে নিয়ে আসে রমনা থানা পুলিশ। পরে তাদের ছাত্রী সংস্থার কর্মী সন্দেহে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে হাজির করা হয়। এ সময় তাদের মুখের নেকাব খুলতে বাধ্য করে পুলিশ। আদালত সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়াই ১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। এসব কাজের বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করে ৮ জানুয়ারি সুপ্রিমকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় রিট আবেদনটি জমা দেন সুপ্রিমকোর্ট বার সমিতির সাবেক কোষাধ্যক্ষ অ্যাডভোকেট ফাহিমা নাসরিন মুন্নি। গতকাল আবেদনের ওপর তিনি নিজেই শুনানি করেন।

No comments

Powered by Blogger.