‘ছাত্ররাজনীতি ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থনির্ভর হয়ে পড়েছে’ -প্রেসিডেন্ট

প্রেসিডেন্ট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর মো. আবদুল হামিদ বলেছেন, ষাটের দশকে যারা ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলাম তাদের সকলেরই আদর্শ ছিল। সেখানে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী স্বার্থের কোন স্থান ছিল না। বর্তমানে ছাত্র রাজনীতিতে অনেক ক্ষেত্রে সে আদর্শের অনুপস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় ছাত্র রাজনীতি এখন কিছু কিছু ক্ষেত্রে আদর্শের পরিবর্তে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীস্বার্থ নির্ভর হয়ে পড়েছে। আদর্শের অনুপস্থিতি আমাকে বেদনাহত করে। গতকাল সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৯তম সমাবর্তনে সভাপতির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জন্ম দিয়েছে অনেক বরেণ্য রাজনীতিবিদ। তারা স্বাধীনতা  যুদ্ধসহ জাতীয় উন্নয়নে বিপুল অবদান রেখেছেন। মূলত ছাত্র রাজনীতির পথ বেয়েই তাদের উত্থান ঘটেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ছাত্র রাজনীতির রয়েছে বিশাল সংযোগ। তাই ছাত্র রাজনীতিকে জাতির বৃহত্তর কল্যাণে আদর্শিক ও গণমুখী করে তুলতে সকলের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। আবদুল হামিদ বলেন, সমাবর্তন বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা সমাপনী অনুষ্ঠান। এর মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীরা একদিকে যেমন তাদের একাডেমিক অর্জনের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি লাভ করে তেমনি তারা এর মধ্য দিয়েই সচেতন হয়ে উঠে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে। শিক্ষার মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ‘অনুকরণীয়’ দৃষ্টান্ত রাখতে সক্ষম হয়েছে উল্লেখ করে প্রেসিডেন্ট বলেন, বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর প্রায় অর্ধেকই ছাত্রী। নিঃসন্দেহে এটি আশাব্যঞ্জক। তিনি বলেন, নারীরা আজ দেশের শিক্ষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতিসহ শিক্ষা কার্যক্রমে সমভাবে অবদান রেখে চলেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ‘সমাজের বিবেক’ ও ‘বাতিঘর’ হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাতিঘরে এসে আলোকিত হয়েছেন অসংখ্য শিক্ষার্থী। তারা আলোকিত মানুষ হিসেবে দেশে ও বিদেশে ছড়াচ্ছেন আলোকচ্ছটা। শিক্ষাগুরুর রোপিত জ্ঞানের বীজ থেকে বেরিয়ে আসা অঙ্কুরগুলো আজ বিরাট মহীরূহ হয়ে দেশ ও জাতির সম্মান বৃদ্ধিতে অসামান্য অবদান রাখছেন। শিক্ষকদের উদ্দেশে বলেন, গণতান্ত্রিক সমাজে আপনাদের জ্ঞানগর্ভ আলোচনা, সূচিন্তিত মতামত ও দিক-নির্দেশনা জাতিকে সঠিক পথ দেখাবে।  প্রেসিডেন্ট আরও বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই বিশ্বের একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় যেটি মাতৃভাষার অধিকার আদায়, স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা অর্জনে সঠিক ও বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দিয়েছে। গণতন্ত্র রক্ষা ও চর্চায় এ বিশ্ববিদ্যালয়ের জুড়ি নেই। গ্র্যাজুয়েটদের উদ্দেশ্য করে চ্যান্সেলর মো. আবদুল হামিদ বলেন, সমকালীন বিশ্বে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে হলে নিজেকে অধিক যোগ্য করে তুলতে হবে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতিটি ক্ষেত্রে মোকাবিলায় সবসময় সাহসী ও উদ্যোগী হতে হবে। ভুললে চলবে না তোমাদের সামান্যতম নেতিবাচক কর্মকাণ্ডও বিশাল অর্জনকে ম্লান করে দিতে পারে। জীবনে চলার পথে কখনও হতাশ হবে না। লেখাপড়ার পাশাপাশি সমাজ উন্নয়নমূলক কাজে অংশ নিবে। অনুষ্ঠানে সমাবর্তন বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জেনেভাভিত্তিক মেধাস্বত্ব সংগঠন ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি অর্গানাইজেশন (ডব্লিউআইপিও)’র মহাপরিচালক ড. ফ্রান্সিস গেরি। তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি (ডক্টর অব লজ) প্রদান করা হয়। আরও উপস্থিত ছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. ফারজানা ইসলাম, সংসদ সদস্যবৃন্দ, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি (শিক্ষা) ড. নাসরীন আহমাদ, প্রো-ভিসি (প্রশাসন) ড. সহিদ আখতার হুসাইন, কোষাধ্যক্ষ, সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্যবৃন্দ, একাডেমিক পরিষদের সদস্যবৃন্দ, শিক্ষকবৃন্দ। সমাবর্তন বক্তা হিসেবে ড. ফ্রান্সিস গেরি বলেন, মেধাস্বত্বের সঙ্গে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির সংমিশ্রণ ঘটাতে হবে। আর এই প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে দেশের কৃষি, শিল্পসহ সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখার জন্য গ্র্যাজুয়েটদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি। তিনি বলেন, নতুন জ্ঞান সৃষ্টি এবং সমাজে এই জ্ঞান বিতরণের কাজে গ্র্যাজুয়েটদের সম্পৃক্ত হতে হবে। ড. ফ্রান্সিস গেরি আরও বলেন, আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে আধুনিক শিক্ষা ও জ্ঞানের কোন বিকল্প নেই। সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা, শুভবাদী দর্শন এবং আধুুনিক প্রযুক্তি সংবলিত শিক্ষার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন তিনি। এক্ষেত্রে তিনি মেধাস্বত্বকে ধনসম্পদের চেয়ে মূল্যবান বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, জ্ঞান হচ্ছে উৎপাদনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। তবে এ জ্ঞান হতে হবে প্রযুক্তির জ্ঞান। এর আগে সকাল ১১টা ৫৫ মিনিটে কার্জন হল থেকে চ্যান্সেলরের নেতৃত্বে সমাবর্তন শোভাযাত্রা বের করা হয়। শোভাযাত্রাটি অনুষ্ঠানস্থলে প্রবেশের পরপরই উপস্থিত শিক্ষার্থীরা তাদের করতালি দিয়ে স্বাগত জানায়। এরপর জাতীয় সংগীতের মধ্য দিয়ে সমাবর্তনের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন প্রেসিডেন্ট ও চ্যান্সেলর আবদুল হামিদ। পরে পর্যায়ক্রমে অনুষদের ডীন, অধিভুক্ত কলেজের অধ্যক্ষদের সুপারিশে পিএইচডি, এমফিল, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি প্রদান করেন  প্রেসিডেন্ট। এ সময় শিক্ষার্থীরা করতালি দিয়ে তাদের ডিগ্রি গ্রহণ করে। এছাড়া কৃতী ২৯জন শিক্ষার্থীকে স্বর্ণপদক প্রদান করা হয়। ভিসি অধ্যাপক ড. আরেফিন সিদ্দিক তার বক্তব্যে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার নিজস্ব ধরন ও পদ্ধতি রয়েছে। এ শিক্ষার সঙ্গে অন্য কোন শিক্ষাব্যবস্থার বা শিখন পদ্ধতির তুলনা চলে না। এ শিক্ষা পাঠ্যপুস্তকে কখনও আবদ্ধ নয়। তিনি গ্র্যাজুয়েটদের উদ্দেশে বলেন, তোমরা শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিত্ব করো না। তোমাদের জাগ্রত সত্তায় এই বোধ যেন সবসময় সজাগ থাকে যে, তোমরা এ দেশের সম্পদ। জাতীয় গৌরব বৃদ্ধিই তোমাদের প্রতিজ্ঞা। সৎ ও মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার জন্য তিনি গ্র্যাজুয়েটদের প্রতি আহ্বান জানান। জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়। এদিকে সমাবর্তনকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয়ে উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে। কালো গাউন, সমাবর্তন টুপি পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ দিনটিকে স্মৃতিতে ধরে রাখতে ঝলক দিয়ে উঠছে ক্যামেরার ক্লিক ক্লিক শব্দ। নেচে-গেয়ে আনন্দ- উল্লাস করেছে শিক্ষার্থীরা। উল্লেখ্য, এ বছর ৬ হাজার ১০৪ জন শিক্ষার্থী সমাবর্তনে অংশ নেয়।
সাদা দলের বর্জন: এদিকে দেশের চলমান সঙ্কট, বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, বিশ্ববিদ্যালয়ে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের অনুপস্থিতি এবং বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় কর্তৃপক্ষের নানা অনিয়ম ও একদলীয় মনোভাবের অভিযোগ এনে সমাবর্তন বর্জন করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপি-জামায়াতপন্থি সাদাদলের শিক্ষকরা।
কলা ভবন থেকে ককটেল উদ্ধার: সমাবর্তন চলার সময়ে দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের ভেতর থেকে ৪টি ককটেল উদ্ধার করেছে পুলিশ। তবে কে বা কারা ককটেলগুলো রেখে গেছে তা শনাক্ত করা যায়নি। কলা ভবনের নিচ তলার রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের বাথরুম থেকে এ ককটেলগুলো উদ্ধার করা হয় বলে নিশ্চিত করেছেন শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সিরাজুল ইসলাম।

No comments

Powered by Blogger.