জাতির মেরুদণ্ড শিক্ষা আজ চূর্ণ-বিচূর্ণ by ড. মাহবুব উল্লাহ্

১৯৯৮ সালে ওয়াশিংটন ডিসিতে অনুষ্ঠিত বিশ্বব্যাংক আয়োজিত ABCDE কনফারেন্সে যোগ দেয়ার সুযোগ আমার হয়েছিল। পাঠক নিশ্চয়ই ABCDE শব্দ সংক্ষেপটি শুনে কিছুটা কৌতূহল বোধ করতে পারেন। ABCDE-র সম্প্রসারিত রূপটি হল Annual Bank Conference on Development Economics। প্রতিবছরই বিশ্বব্যাংকের উদ্যোগে এ সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের প্রতিনিধিরা মিলিত হয়ে উন্নয়ন অর্থনীতির একটি নির্ধারিত থিমের ওপর আলোচনা করেন। সম্মেলনে বিশ্বের নামজাদা অর্থনীতিবিদরা বড় বড় গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। এদের মধ্যে কেউ কেউ আবার নোবেল লরিয়েট। সে বছরের সম্মেলনে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ জেম্স টবিনও প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছিলেন। তারা অনেকে নিজ নিজ গবেষণার ক্ষেত্রে বিশেষ ব্যুৎপত্তিসম্পন্ন পণ্ডিত হওয়া সত্ত্বেও উপস্থাপনায় তেমন সাবলীল হন না। ফলে অনেকের উপস্থাপনাই অবোধগম্য থেকে যায়। এছাড়া অর্থনীতি শাস্ত্রের জটিল কনসেপ্টগুলো উপস্থাপনাকে আরও অবোধগম্য করে তোলে। সেবারের কনফারেন্সের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ‘Knowledge of Development’। এ থিমটি নির্ধারণ করেছিলেন বিশ্বব্যাংকের তৎকালীন চিফ ইকোনমিস্ট প্রফেসর যোসেফ ই স্টিগলিৎজ। স্টিগলিৎজ তখনও নোবেল প্রাইজ পাননি। তদসত্ত্বেও তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল বিশ্বময়। তিনি ছিলেন কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিনান্সিয়াল ইকোনমিক্সের অধ্যাপক। এছাড়াও তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্টের অর্থনৈতিক উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ১৯৮০-র দশকে বিশ্বব্যাংকের দর্শনে যে নিও লিবারেল ধারার সূচনা হয়, তিনি ছিলেন তার কঠোর সমালোচক। তার মতো ব্যক্তির বিশ্বব্যাংকের চিফ ইকোনমিস্ট হিসেবে নিযুক্তি লাভকে বিশ্বব্যাংকের দর্শনে একটি পরিবর্তন হিসেবে ধারণা করা হয়েছিল। কিন্তু তাদের সেই ধারণা ধরে রাখা সম্ভব ছিল না। স্টিগলিৎজকে বিশ্বব্যাংক ত্যাগ করতে হয়েছিল মতপার্থক্যের কারণে। স্টিগলিৎজ বিশ্বব্যাংকের কর্মকাণ্ডে একটি মানবিক ধারার সূচনা চেয়েছিলেন। এ কারণে উন্নয়নের ক্ষেত্রে জ্ঞানের ভূমিকাকে তিনি সামনে নিয়ে এসেছিলেন। তার দৃষ্টিতে জ্ঞান কোনো ব্যক্তিবিশেষের সম্পদ নয়। এটি সমগ্র মানবজাতির যৌথ সম্পদ। কারণ জ্ঞানের বিশাল ভাণ্ডারে জীবন সংগ্রামে লিপ্ত প্রতিটি মানুষই প্রতি মুহূর্তে অবদান রেখে চলেছে। জ্ঞান কখনও হয় চিন্তার প্রকাশযোগ্য ক্ষমতা, আবার কখনও হয় চিন্তার অপ্রকাশযোগ্য ক্ষমতা। সাধারণ মানুষ কাজ করতে গিয়ে কাজের নতুন নতুন হিকমত বা কৌশল আবিষ্কার করে। কিন্তু সে ব্যাখ্যা করে বলতে পারে না কাজটি কীভাবে সম্পাদিত হল, কেন হল? এভাবে প্রকাশযোগ্য ও অপ্রকাশযোগ্য জ্ঞানরাশি সঞ্চিত হয়ে মানবজাতির জ্ঞান ভাণ্ডার সৃষ্টি হয়। এর ওপর কারোর ব্যক্তিমালিকানা দাবির সুযোগ নেই। কারণ বর্তমানে চিন্তারাশি অতীতের চিন্তারাশির দ্বারা প্রভাবিত হয়। একইভাবে একজন ব্যক্তির চিন্তাও অন্যসব ব্যক্তির চিন্তাকে ভিত্তি করে অগ্রসর হয়। সুতরাং কোনো মানুষই এককভাবে দাবি করতে পারে না কোনো একটি বিশেষ চিন্তা বা কর্ম প্রক্রিয়া কিংবা প্রযুক্তি তার নিজস্ব অবদান। এ যুক্তিতে নতুন আবিষ্কারকে যতই নতুন বলা হোক না কেন, এর ভিত্তি অন্তর্নিহিত আছে অতীতে উদ্ভাবিত আবিষ্ক্রিয়ার মধ্যে। একজন ব্যক্তিবিশেষকে পেটেন্ট রাইট দেয়া যুক্তিসঙ্গত নয়। অথচ নিও লিবারেল অর্থনীতির ক্ষেত্রে ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস বা মেধাস্বত্ব অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। এ মতবাদের ধারক-বাহকরা মনে করেন, মেধাস্বত্ব অধিকার সুরক্ষিত না হলে নতুন আবিষ্কারের প্রক্রিয়া থেমে যাবে। কারণ যিনি গবেষণা করে আবিষ্কার করতে চান, তিনি পুরস্কৃত হবেন না ভেবে নিরুৎসাহিত হন। স্টিগলিৎজের সুস্পষ্ট বক্তব্য হল, মানুষ লাভের আশায় জ্ঞান সাধনা করেন না। সক্রেটিস কোন লাভের জন্য দর্শনের চর্চা করেছিলেন? কার্ল মার্কস বিশাল জ্ঞান সাধক হওয়া সত্ত্বেও চরম দারিদ্র্যের মধ্যে দিনাতিপাত করেছেন। একই রকম জীবনযাপন করেছেন আরও অনেক জ্ঞান সাধক। জ্ঞান সাধকরা জ্ঞানের চর্চা করেন সৃষ্টি সুখের উল্লাসে। কারও তিরস্কারের ভয়ে কিংবা কারোর দ্বারা পুরস্কৃত হওয়ার লোভে নয়। যিনি প্রথম পলিওর টিকা আবিষ্কার করেছিলেন, তিনি তার আবিষ্কারকে পেটেন্ট করেননি। যদি পেটেন্ট করা হতো তাহলে তিনি ব্যক্তিগতভাবে লাখ লাখ ডলার পেতেন, কিন্তু দুনিয়ার লাখ লাখ মানুষকে পলিওর হাত থেকে বাঁচার জন্য পলিওর টিকা কিনতে হতো অনেক অর্থ ব্যয় করে। টিকাটি পেটেন্ট করা হয়নি বলে আজ বিশ্বের কোটি কোটি শিশুকে পলিওর টিকা দিয়ে পলিওমুক্ত রাখা সম্ভব হচ্ছে। কত মহান ব্যক্তি ছিলেন পলিওর টিকা আবিষ্কারক মানুষটি!
Knowledge for Development কোনো নতুন প্রথা নয়। শত শত বছর ধরে আমরা জানি, জ্ঞানই শক্তি। আমরা আরও জানি, অসির চেয়ে মসী অনেক বেশি শক্তিশালী। একটি অনুন্নত দেশের উন্নয়নে জ্ঞানের ভূমিকাকে খাটো করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। আমি যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করছিলাম তখন আমাদের ডরমিটরিতে এসেছিলেন অর্থনীতিবিদ প্রফেসর নুরুল ইসলাম। তার আগমন উপলক্ষে আমার এক বন্ধু ড. সাইফুল হক নৈশভোজের আয়োজন করেছিলেন। ওই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের তৎকালীন স্বরাষ্ট্র সচিব মঞ্জুরুল করিমও ছিলেন। এছাড়াও ছিলেন তখন হার্ভার্ডে অধ্যয়নরত বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-এলাহি চৌধুরী। এছাড়া জাতীয় অধ্যাপক প্রফেসর আবদুর রাজ্জাকও উপস্থিত ছিলেন। ভোজপর্ব শেষ হওয়ার পর গল্প-গুজবের মধ্যে বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রসঙ্গও আলোচিত হল। প্রফেসর রাজ্জাক শিক্ষার গুরুত্বের কথা তুলে ধরলেন। ড. তৌফিক-ই-এলাহি চৌধুরী বিষয়টিকে আরও বোধগম্য করে তোলার জন্য বললেন, ‘রাষ্ট্রের দায়িত্ব হওয়া উচিত সব নাগরিককে শিক্ষিত করে তোলা। প্রত্যেকটি নাগরিক যখন শিক্ষার আলোকে আলোকিত হবে, তখন সে নিজেই তার উন্নতির পথ সঠিকভাবে নির্ধারণ করতে সক্ষম হবে। এভাবে সফল নাগরিকের সজ্ঞান প্রয়াস দেশটিকে সুখী-সমৃদ্ধ করে তুলবে।’ ভোজসভায় উপস্থিত সবাই ছিলেন জ্ঞানের উচ্চতম স্তরে অধ্যয়নরত। কেউ এ অভিমত সম্পর্কে দ্বিমত প্রকাশ করেননি। আজ এত বছর পরও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ প্রজ্ঞার কোনো পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হয় না।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতির সূচকে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ২৮ দেশের মধ্যে সার্বিকভাবে বাংলাদেশের অবস্থান ২৭তম, শিক্ষায় ২৫তম, উদ্ভাবনে ২৭তম, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিতে ২৬তম। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শিক্ষায় বাংলাদেশের নিচে আছে দুটি দেশ : নেপাল ও পাকিস্তান। উদ্ভাবন ও তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) খাতে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশই রয়েছে সবার নিচে। উল্লেখ্য, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, শিক্ষা, উদ্ভাবন ও তথ্যপ্রযুক্তিতে অগ্রগতির ওপর নির্ভর করে কোনো দেশের জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে ওঠে। আর এ গাঁথুনিগুলোতেও বাংলাদেশ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। সামগ্রিকভাবে বলা যায়, যে ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের উন্নয়ন এগিয়ে যাবে, সেই ভিত্তিটিই এখনও তৈরি হয়নি। এ বিচারে বাংলাদেশের উন্নয়ন মোটেও টেকসই নয়।
কথায় বলে শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। মেরুদণ্ড শক্ত হলে একজন মানুষ যেমন দৃঢ় ও ঋজু ভঙ্গিতে দাঁড়াতে পারে, ঠিক তেমনি শিক্ষার বলে বলীয়ান একটি জাতিও দৃঢ়তার সঙ্গে নিজ পায়ের ওপর দাঁড়াতে পারে। গত ৪৩ বছরে শিক্ষার ক্ষেত্রে যে নীতি অনুসৃত হয়েছে, তাতে জাতির মেরুদণ্ড দৃঢ় হওয়া তো দূরের কথা বরং এটিকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয়া হয়েছে। স্বাধীনতার পর মুক্তিযুদ্ধের দোহাই দিয়ে ১০০ নম্বরের জায়গায় ৫০ নম্বরের পাবলিক পরীক্ষা নেয়া হয়েছে। গ্রাম-গ্রামান্তরে দেখা গেল যারা সেভেন-এইট পর্যন্ত পড়েছে, তারাও নকলের মহোৎসবের মধ্য দিয়ে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় পাস করেছে। পরবর্তীকালে এদের মধ্যে যারা স্কুল শিক্ষক হলেন তাদের বিদ্যার দৌড় সহজেই অনুমেয়। তারা ছাত্রছাত্রীদের কী শেখাবেন বা কেমনভাবে শেখাবেন, সে ব্যাপারে ছিলেন বলতে গেলে অজ্ঞ। তারপর একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবীর পক্ষ থেকে দাবি উঠল, মাতৃভাষার মাধ্যমে উচ্চশিক্ষা প্রদান করতে হবে। আমার মতো মানুষ যে প্রজন্মের, সে প্রজন্মে হাইস্কুলের চৌহদ্দি পার হওয়ার পর কলেজে এসে ইংরেজি ভাষার মাধ্যমেই পড়তে হতো। কলেজের অধ্যাপকরাও বাংলা সাহিত্য ব্যতিরেকে অন্য বিষয়গুলোর ওপর আগাগোড়া ইংরেজিতে লেকচার দিতেন। পাঠ্যবইগুলোও ছিল ইংরেজিতে রচিত। এমনকি পাশ্চাত্য দেশ থেকে প্রকাশিত পাঠ্যবইও আমরা পড়েছি। স্যামুয়েলসনের ইকোনমিক্সের ষষ্ঠ সংস্করণ আমাদের পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত ছিল। এছাড়াও ছিল স্টোনিয়ের ও হেগের বই। ভূগোলের জন্য পড়েছি ওর্চেস্টারের জিওমর্ফলোজি, মংক হাউসের ও ফিলিথ লেকের ফিজিক্যাল জিওগ্রাফি। এছাড়াও ছিল কেন্ড্রুর ক্লাইমেটলোজি। এছাড়া অর্থনৈতিক ভূগোলের জন্য পড়েছি ওএইচকে স্পেইট, এল ডাডলিস্টাম্প ও ড. নাফিস আহমেদের বই। ইংরেজি সাহিত্যের সহায়ক গ্রন্থ হিসেবে পড়েছি অক্সফোর্ড কম্পেনিয়ন টু ইংলিশ লিটারেচার। বাংলা সাহিত্যের সহায়ক গ্রন্থ ছিল অনেকগুলো। স্কুল জীবনেও ইতিহাসের জন্য জওহরলাল নেহেরুর ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া, ভিনসেন্ট স্মিথের হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া, খুদা বক্সের বই, হিট্টির বই, লেইন কুলের বই এবং গিবনের বই। এছাড়াও ছিল আমির আলীর স্পিরিট অব ইসলাম।
আমাদের ইতিহাস শিক্ষা ভারতবর্ষের বৈদিক যুগ থেকে আধুনিককাল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এর ফলে আমরা দেশ ও জাতি সম্পর্কে একটা সম্যক ধারণা লাভ করতে পেরেছিলাম। আজকাল বিশ্বব্যিালয়ে পড়ুয়া একজন ছাত্রকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয় পলাশীর যুদ্ধ কখন হয়েছিল, অধিকাংশ ছাত্রই তখন থাকে নিরুত্তর। স্কুলে আমরা যেসব শিক্ষকের কাছে পড়েছি, তাদের মান ইদানীংকালের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের তুলনায় উন্নত ছিল। এ কারণে তাদের প্রতি আজও গভীর শ্রদ্ধা অনুভব করি। এর একটা সামাজিক-ঐতিহাসিক কারণও ছিল। ১৯৩০-এর দশকে যে মুষ্টিমেয় মুসলিম ছাত্র উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করত, তাদের কপালে কোনো ভালো সরকারি চাকরি জুটত না। ফলে তারা হাইস্কুলের শিক্ষক হতেন। জীবনের কাক্সিক্ষত উচ্চ স্তরে পৌঁছতে না পারলেও তারা হতেন নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক। তাদের ক্লাস নিয়মিত করলে প্রাইভেট টিউটরের কাছে যেতে হতো না। আমরা ইংরেজি ও বাংলা ভাষায় সমান দক্ষতা অর্জন করেছিলাম। ইংরেজিতে ভালো দখল থাকায় বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এসে ইংরেজি ভাষায় রচিত কোনো রেফারেন্স বই পড়তে ও বুঝতে কষ্ট হতো না। আজকাল বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অনেক ছাত্রছাত্রী শুদ্ধ ভাষায় নিজেকে প্রকাশ করতে পারে না, রেফারেন্স বই পড়া তো দূরের কথা। ফলে তাদের জ্ঞান হয় অত্যন্ত সীমিত। এভাবে ক্রম-পুঞ্জীভূতহারে শিক্ষার মানে ধস নেমেছে। এর পাশে যখন যোগ হল নকলের মচ্ছব, তখন অনেকেই পড়াশোনা শিখে পরীক্ষার হলে যাওয়ার উৎসাহ হারিয়ে ফেলল। কী করে নকল করা যায় সেটাই হল সর্বাত্মক প্রচেষ্টা। দৈনিক ইত্তেফাকে একটি ছবি প্রকাশিত হয়েছিল। ছবিতে দেখা গেল স্কুলের টিনের চাল খুলে নকল সরবরাহ করা হচ্ছে। কী ভয়াবহ অবস্থা! পরীক্ষা পাসের সনদ মিললেও বিদ্যাটা রয়ে গেল অধরা। হাল আমলে প্রাইমারি ও জুনিয়র স্তরে পাবলিক পরীক্ষা চালু হয়েছে। এসব পরীক্ষারও প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে বেশুমার। এই যদি হয় অবস্থা তাহলে কোমলমতি ছাত্রছাত্রীরা লেখাপড়া করবে কেন? যারা বছরজুড়ে লেখাপড়া করেছে, তারাও এখন ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় বলছে, আমার কষ্ট করে লেখাপড়া করার সার্থকতা কোথায়? অন্যরা তো লেখাপড়া না করেই আগের রাতে প্রশ্ন পেয়ে সেটুকু মুখস্থ করে আমার চেয়ে ভালা করবে। প্রতিযোগিতার কোনো মূল্য থাকবে না।
একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ তখনই সৃষ্টি হয়, যখন জ্ঞান আহরণের জন্য প্রতিযোগিতা থাকে। শিক্ষার সর্বস্তরে রাজনীতিকরণ ঘটার ফলে এখন শিক্ষক রিক্রুট হচ্ছে না, রিক্রুট হচ্ছে দলীয় ক্যাডার। এরা শিক্ষাব্যবস্থায় পচন ধরিয়ে দিয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দায়িত্ব পালনের চেয়ে এরা শিক্ষাবহির্ভূত কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত হয়ে টাকা-পয়সা রোজগার করাকেই জীবনের মোক্ষ হিসেবে ধরে নিয়েছে। এরা কী নীতি-নৈতিকতার শিক্ষা দেবে? এদের হাত দিয়েই গড়ে উঠছে নৈতিকতাবর্জিত, আদর্শহীন, লক্ষ্যহীন, সৃজনশীলতাহীন একটি প্রজন্ম। এ প্রজন্ম পরবর্তী প্রজন্মকে সব দিক থেকে প্রতিবন্ধী করে ফেলবে। সমাজে জ্ঞান ও শিক্ষার কোনো মর্যাদা থাকবে না। বলা হচ্ছে, ফাঁস করা প্রশ্নপত্র যারা ফেসবুকে দিচ্ছে তাদের আইটি অপরাধে অভিযুক্ত করতে হবে। আসল ফাঁসকারীকে চিহ্নিত না করে যারা ফেসবুকে প্রশ্ন প্রচার করে উত্তেজনা বোধ করে, তারা এক অর্থে ভালো কাজই করছে। কারণ এর ফলে ব্যাপক জনগণের কাছে ফাঁসের ব্যাপারটি উন্মোচিত হয়ে যাচ্ছে। আধুনিক প্রযুক্তির একটি ভালো দিক হল অনেক অপকর্মকেই এটি জনসমক্ষে স্বচ্ছ করে দেয়। অবশ্য এদের বিরুদ্ধে যে কথাটি বলা যায় সেটা হল, এরা শতসহস্র ছাত্রছাত্রীকে স্বেচ্ছা মৃত্যুবরণে উৎসাহিত করে। এদিক থেকে তারা দ্বিতীয় পর্যায়ের দোষী। কিন্তু মূল দোষীদের সম্পর্কে কিছুই করা হচ্ছে না। আমি জানি না, আর কী করলে জাতির মেরুদণ্ড বলে পরিচিত শিক্ষার আর কতটুকু অবশিষ্ট থাকবে। সর্বোপরি দুঃখজনক হলেও অনেকে বলে থাকেন, পরীক্ষকদেরও বেশি নম্বর দেয়ার জন্য উপরের মহল থেকে চাপ দেয়া হয়। বেশি নম্বর কেন দিতে হবে পরীক্ষার্থীকে? যে নম্বর প্রাপ্য সেটাই প্রদান করতে হবে। পাসের হার বেশি দেখানোর মধ্যে আত্মপ্রসাদ থাকতে পারে, কিন্তু তার চেয়েও বেশি আছে আত্মপ্রবঞ্চনা। যারা ব্যাংকের টাকা মেরে দিচ্ছে, শেয়ারবাজার থেকে অর্থ লুট করছে কিংবা উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের মান-এ ঘাটতি সৃষ্টি করে অর্থবিত্তের মালিক হচ্ছে, যারা মাদকের ব্যবসা করে তরুণ সমাজকে বিপথগামী করছে, তারা নিঃসন্দেহে জাতির শত্রু। কিন্তু যারা জাতির মেরুদণ্ড শিক্ষাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে জাতিকে চিরতরে পঙ্গু করে ফেলছে, জাতির আত্ম-উন্নতির পথকে কণ্টকাকীর্ণ করছে, তারাও লুটেরা শ্রেণীর চেয়ে কম পাপে পাপী নয়। এ পাপ মহাপাপ। এ পাপ দুর্নীতির মধ্যে ঘৃণ্যতম দুর্নীতি। শিক্ষার মান ও গুণে উন্নতি ঘটলে একদিন না একদিন
জাতির সত্যিকার মুক্তির একটি সম্ভাবনা থাকে। সেটিকেও যখন চরমভাবে অধঃপতিত করা হয়, তখন আর কোনো আশার আলোক দেখা যায় না।
আশা করব, সব বিবেকবান মানুষ শিক্ষাব্যবস্থাকে এভাবে ধ্বংস করার ঘৃণ্য প্রয়াসের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবেন। এতে দল ও মতের কোনো প্রশ্ন নেই। একটি অধঃপতিত শিক্ষাব্যবস্থা জাতিকে যখন গ্রাস করে, তখন সব মত ও পথের অনুসারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হন। ক্ষতিগ্রস্ত হন তাদের ভবিষ্যৎ বংশধররাও। সম্পদে অপ্রতুল বাংলাদেশকে সুখী-সমৃদ্ধ করার একটি মাত্র পথ খোলা আছে। সেটি হল শিক্ষা, শিক্ষা, আরও শিক্ষা; জ্ঞান, জ্ঞান ও আরও জ্ঞান। জ্ঞান থেকে জাত অভিজ্ঞানই আমাদের একমাত্র মুক্তির পথ।
ড. মাহবুব উল্লাহ : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.