সুন্দরবনে ছড়িয়ে পড়ছে তেল- এ বছরে তিন জাহাজডুবি

(পূর্ব সুন্দরবনের জয়মনির ঘোল এলাকায় শ্যালা নদীতে গতকাল ভোরে ডুবে যায় তেলবাহী জাহাজ ওটি সাউদার্ন স্টার-৭। এতে নদীতে ছড়িয়ে পড়ে তেল (ইনসেটে) l ছবি: প্রথম আলো) পূর্ব সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে জ্বালানি তেলবাহী একটি জাহাজ ডুবে গেছে। এতে জাহাজটি থেকে সাড়ে তিন লাখ লিটারের বেশি ফার্নেস তেল সুন্দরবনে ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে। গতকাল মঙ্গলবার ভোরে নদীটির তীরের কাছাকাছি নোঙর করা ওই জাহাজটিকে অন্য একটি পণ্যবাহী জাহাজ ধাক্কা দিলে এ দুর্ঘটনা ঘটে। ঘটনাস্থলটি মংলা বন্দরের জেটি থেকে নয় নটিক্যাল মাইল দূরে। ছড়িয়ে পড়া তেলে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ার আশঙ্কা করছে বন বিভাগ। গতকাল রাতে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত জাহাজটি উদ্ধার এবং তেল ছড়িয়ে পড়া নিয়ন্ত্রণে সরকারি কোনো সংস্থা উদ্যোগ নেয়নি। তেলবাহী জাহাজটির মালিকানা প্রতিষ্ঠান মেসার্স হারুন অ্যান্ড কোম্পানির ব্যবস্থাপক গিয়াস উদ্দিন জানান, খুলনার পদ্মা অয়েল থেকে তেলবাহী জাহাজ ওটি সাউদার্ন স্টার-৭ তিন লাখ ৫৭ হাজার ৬৬৪ লিটার জ্বালানি তেল নিয়ে সোমবার বিকেলে গোপালগঞ্জ বিদ্যুৎকেন্দ্রের উদ্দেশে যাত্রা করে। রাতে কুয়াশার কারণে জাহাজটি সুন্দরবনের শ্যালা নদীর তীরের কাছাকাছি জয়মনি ঘোল এলাকায় নোঙর করে। ভোর চারটার দিকে বিপরীত দিক থেকে আসা এম টি টোটাল নামে একটি পণ্যবাহী জাহাজ ওটি সাউদার্ন স্টার–৭কে ধাক্কা দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই তেলবাহী জাহাজটি ডুবে যায়। দুর্ঘটনায় জাহাজটির চালক (মাস্টার) মোখলেসুর রহমান নিখোঁজ হন। জাহাজের অপর ছয় কর্মচারী সাঁতরে তীরে ওঠেন। গিয়াস উদ্দিন বলেন, ‘এ ঘটনায় আমাদের দুই কোটি ৩৪ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। চালকের সন্ধানে তল্লাশি চলছে।’
মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের হারবার মাস্টার কমান্ডার খান মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান ঘটনাটি নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, জাহাজটির চার ভাগের তিন ভাগ ডুবে গেছে। যে স্থানে জাহাজটি ডুবেছে, সেটি বন্দর চ্যানেলের বাইরে। ফলে বন্দর চ্যানেল ঝুঁকিমুক্ত রয়েছে।
ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আমীর হোসাইন চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে জানান, গতকাল বিকেল পর্যন্ত তেল সুন্দরবনের জয়মনি, নন্দবালা, আন্ধারমানিক, মৃগমারী এলাকার প্রায় ২০ কিলোমিটারজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। জোয়ার-ভাটার টানে দ্রুত এই এলাকা বাড়তে থাকবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, সুন্দরবন পূর্ব বিভাগ, মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরগুলোর কাছে পানিতে ভেসে থাকা এই জ্বালানি তেল অপসারণ বা নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে।
আমীর হোসাইন চৌধুরী আরও বলেন, ‘জোয়ারের সময় বনের ভেতর এই দূষিত পানি ঢুকে যাচ্ছে। এতে বিভিন্ন প্রাণীসহ বনজ সম্পদও ক্ষতির সম্মুখীন হবে। আমরা কর্তৃপক্ষকে অবিলম্বে জাহাজটি উত্তোলনের কথা বলেছি।’ জাহাজটির উদ্ধারকাজ শুরু করা নিয়ে এর মালিকপক্ষ সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলেননি।
তবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নৌবাহিনীর জাহাজ বিএনএস শহীদ রুহুল আমিনকে কাজে লাগানোর পরামর্শ দিয়েছেন মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান কমোডর হাবিবুর রহমান খান। তিনি বলেন, ভাসমান তেলের আস্তরণকে ভারী ও একত্র করার মতো রাসায়নিক দ্রব্য নৌবাহিনীর কাছে থাকার কথা। এই দ্রব্য ব্যবহার করে ক্ষতি কিছুটা কমানো যেতে পারে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান অনুষদের অধ্যাপক ড. দিলীপ কুমার দত্ত বিকেলে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, এত তেল পানিতে ভেসে থাকায় উপকূলীয় প্রাণবৈচিত্র্যের ওপর এর মারাত্মক ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে। সুন্দরবনের মতো শ্বাসমূলীয় বনের গাছপালা শ্বাসমূল দিয়ে শ্বাস নেয়। এই তেলের আস্তরণ জোয়ারের সময় মাটির ওপরে বিস্তৃত হয়ে গাছের শ্বাস-প্রশ্বাস বাধাগ্রস্ত করবে। ফলে গাছ মারা যাবে। পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ কমিয়ে দেবে এবং মাছসহ জলজ প্রাণীও অক্সিজেন সংকটে ভুগবে।
সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আমীর হোসাইন চৌধুরী বলেন, তেল দূষণের কারণে মৃগমারী-নন্দবালা-আন্ধারমানিক ডলফিন অভয়াশ্রম মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়েছে। এখান থেকে ডলফিনের বসতি সরে যেতে পারে।
ভারত-বাংলাদেশ নৌ প্রটোকল রুট ও দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে দেশের নৌবাণিজ্য যোগাযোগ পথ হিসেবে ব্যবহৃত ঘষিয়াখালী চ্যানেল মংলা নালা ও রামপালের কুমার নদ ভরাট হয়ে প্রায় তিন বছর ধরে বন্ধ রয়েছে। তখন থেকে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে শ্যালা নদীকে বিকল্প পথ হিসেবে ব্যবহার করছে বিআইডব্লিউটিএ।
এর আগে গত ৩০ সেপ্টেম্বর ৬০০ মেট্রিক টন সিমেন্টের কাঁচামাল নিয়ে এম ভি নয়ন শ্রি-৩ নামে একটি জাহাজ পশুর চ্যানেলের জয়মনির ঘোল এলাকায় ডুবে যায়। একই মাসের ১২ তারিখে পশুর চ্যানেলের হাড়বাড়িয়া এলাকায় প্রায় ৬৩০ মেট্রিক টন সিমেন্টের কাঁচামাল নিয়ে এম ভি হাজেরা-২ নামের আরও একটি মালবাহী জাহাজ ডুবে যায়। ওই জাহাজ দুটি এখনো উদ্ধার করা যায়নি।

No comments

Powered by Blogger.