অর্জন ও লংঘন by কাজী ফারুক আহমেদ

আজ সর্বজনীন মানবাধিকার দিবস। ১৯৪৮ সালে ৩০টি ধারা সংবলিত ঘোষণা প্রকাশের পর ১৯৫০ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে মানবাধিকার দিবস উদ্যাপনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সেই থেকে প্রতিবছর দিনটি বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে। জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন দিবসটি উপলক্ষে প্রদত্ত বার্তায় বলেছেন : ‘আমরা ঘোষণা করছি যে, যে যেখানেই থাকি না কেন, আমাদের শ্রেণী ও মতামত, জেন্ডার পরিচয় যাই হোক না কেন, মানবাধিকার সবার জন্য। প্রত্যেকেই অবিচার, অসহিষ্ণুতা ও চরমপন্থার বিরদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে পারেন। মানবাধিকার লংঘন ব্যক্তিগত দুঃখ-বেদনাকে অতিক্রম করে। বৃহত্তর সংকটের সতর্কবার্তা দেয়। আমি সব রাষ্ট্রের প্রতি বছরের প্রতিদিন মানবাধিকার রক্ষার দায়বোধ থেকে দায়িত্ব পালনের আহবান জানাই। জনগণকে আহ্বান জানাই তাদের নিজ নিজ সরকারকে দায়বদ্ধ করতে।’ জাতিসংঘ মহাসচিবের এ বার্তার মধ্য দিয়ে বিশ্বের সব অঞ্চলের সব জনগোষ্ঠীর মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠার আকাক্সক্ষা ও মূল্যবোধ প্রতিফলিত হয়েছে।
এটা সত্য, পৃথিবীর উন্নত-অনুন্নত কোনো দেশে মানবাধিকার পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, বিশ্বজুড়ে প্রায় ২ কোটি ১০ লাখ মানুষ ক্রীতদাস হিসেবে কাজ করছে। এ খাত থেকে বছরে প্রায় ১৫ হাজার কোটি মার্কিন ডলার অবৈধ মুনাফা অর্জিত হচ্ছে। ‘প্রফিট অ্যান্ড পোভারটি : দি ইকোনমিক্স অব ফোর্সড লেবার’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘জোরপূর্বক শ্রমের মাধ্যমে অর্জিত আনুমানিক ১৫ হাজার কোটি মার্কিন ডলার অবৈধ মুনাফার দুই-তৃতীয়াংশ যৌন ব্যবসা থেকে এবং ৫ হাজার ১০০ কোটি মার্কিন ডলার গৃহস্থালি কাজ, কৃষি, শ্রম ও অন্য খাতের শ্রম শোষণের মাধ্যমে অর্জিত হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, যাদের ওপর জোর করে শ্রম শোষণ করা হয়, তাদের অর্ধেকের বেশি নারী ও কিশোরী। এদের দিয়ে প্রধানত জোরপূর্বক যৌন ব্যবসা ও বাসাবাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করানো হয়। অন্যদিকে পুরুষ ও কিশোরদের দিয়ে জোরপূর্বক কৃষি, নির্মাণ ও খনি শ্রমিক হিসেবে অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করানো হয়।’ অন্য এক জরিপ প্রতিবেদনে পাকিস্তানে সংখ্যালঘু নির্যাতনে জড়িত থাকার দায়ে রাষ্ট্রকে দোষারোপ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, বিভিন্ন সময়ে ওই দেশের সরকারগুলো ধর্মীয় সহিংসতা রোধ করতে এবং বিতর্কিত ব্লাসফেমি আইন সংশোধন করতে কেবল ব্যর্থই হয়নি, অনেক রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাও ঘৃণা ছড়ানোর অপরাধে জড়িত আছেন। ইসলামাবাদভিত্তিক এক গবেষণা সংস্থা পরিচালিত জরিপে এ কথা বলা হয়। সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ধর্ষণ ও খুনের অপরাধে ৩০ বছর কারাবাসের পর সে দেশের দু’জন নাগরিক ডিএনএ পরীক্ষায় নিরপরাধ প্রমাণিত হওয়ার পর মুক্তি পেয়েছেন। একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে জাপানে। ৪৬ বছর পর এক ব্যক্তির মামলা আবার শুনানির নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
তৃতীয় বিশ্বের দেশে দেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি সন্তোষজনক এ কথা বলা যাবে না। আমাদের সমাজেও নানাবিধ বৈপরীত্য বিরাজ করছে। ইতিবাচক উদাহরণ যেমন আছে, একই সঙ্গে আছে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ। সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন থাকা সত্ত্বেও জাতীয় মানবাধিকার কমিশন সক্রিয়। পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ ও সুরক্ষা আইন প্রণীত হয়েছে। নারীনীতি অনুমোদিত হয়েছে। হিজড়াদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি মিলেছে। সংশোধিত শিশুনীতি অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। উচ্চ আদালত ফতোয়াকে আইনবহির্ভূত হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। একটি গ্রহণযোগ্য জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণীত হওয়ার পর ধীরগতিতে হলেও তা কার্যকরের প্রক্রিয়ায় এবং আদালতের নির্দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের শারীরিক শাস্তিদান নিষিদ্ধ হয়েছে। যদিও শিক্ষক নামধারী একশ্রেণীর শিক্ষকের অশিক্ষকসুলভ আচরণের জন্য তা পুরো বন্ধ হয়নি। এসব শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেয়া দরকার। আবার বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের (বিএসএএফ) তথ্যে জানা যায়, ২০১৩ সালে সারা দেশে ৫০০ শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১৫০ জন, হত্যাকাণ্ডের শিকার ১৮০ শিশু এবং ১৭০ শিশু শিক্ষাঙ্গনে নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এ ছাড়া ৪২ শিশু অপহরণ, ২৫ শিশু নিখোঁজ ও ১৪৯ শিশু দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে।
বাংলাদেশে এবারের মানবাধিকার দিবসটি পালিত হচ্ছে নারী-পুরুষের সমঅধিকারসহ নানা অধিকার প্রতিষ্ঠার আকাক্সক্ষাকে প্রধান উপজীব্য করে। এর মধ্যে আছে শিক্ষা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মসংস্থান, সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রতিবন্ধীদের অধিকার। পাঁচ কোটি কর্মহীন তরুণের কর্মসংস্থান, উৎপাদিত ফসলের জন্য কৃষকের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি ও দলিত জনগোষ্ঠী হরিজনদের মানবিক অধিকার। পাবর্ত্য জনগোষ্ঠীর সম্পত্তির ওপর ন্যায্য অধিকার। চা শ্রমিক ও নারী শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি প্রাপ্তির অধিকার। দরিদ্র মানুষের সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা লাভের অধিকার। ভেজালবিহীন ওষুধ, সুপেয় পানির অধিকার, ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার। প্রাপ্য নাগরিক সুবিধা লাভের অধিকার। পুষ্টিবঞ্চিত মা ও শিশুর প্রয়োজনীয় পুষ্টির উপকরণ প্রাপ্তির অধিকার। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশুর আনন্দের মাধ্যমে অনুকূল পরিবেশে শিক্ষা লাভের অধিকার। খালি পেটে না থেকে দুপুরের খাবার খেয়ে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষা লাভের অধিকার। পরিবেশবাদীদের কাছে আজকের দিনটির বিশেষ তাৎপর্য হল শিল্পোন্নত দেশগুলোর কার্বন গ্যাস নিঃসরণের প্রতিক্রিয়ায় প্রাকৃতিক পরিবেশ, ভাটির দেশের মানুষ হিসেবে বর্ষায় বন্যার হাত থেকে ও খরায় শুষ্ক মৌসুমে ন্যায্য পানির হিস্যা পাওয়ার অধিকার সুরক্ষা। বছরে পর বছর বিনা বেতনে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষক-কর্মচারীদের প্রাপ্য বেতন ভাতা/এমপিও প্রাপ্তির অধিকার। তবে একাত্তরে শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী হত্যাকারী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু এবং বিচারের রায় ও তা কার্যকরের মধ্য দিয়ে এবারের মানবাধিকার দিবসটি বাংলাদেশের মানুষের কাছে প্রাসঙ্গিকতায় ও ঘটনার পারম্পর্যে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় পরিচালিত হবে; উগ্রপন্থী, মৌলবাদ ও অধিকারহীনতা দেশটিকে গ্রাস করতে পারবে না- এ আশাবাদ ও প্রত্যয়ে তারা নতুন করে আজকের দিনে উজ্জীবিত হবে।
আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও অধিকারের সীমা ও পরিধি নিয়ে আলোচনায় নতুন বিষয়বস্তু যুক্ত হচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর বর্তমান বিশ্বে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুবিধাকে অন্যতম মানবাধিকার হিসেবে অন্তর্ভুক্তির পক্ষে জনমত গড়ে উঠছে। এ মাধ্যমকে ব্যবহার করে বাধাহীনভাবে মত প্রকাশের সুযোগ যাতে সীমিত হয়ে না যায়, সে জন্য ইন্টারনেটের নিয়ন্ত্রণ একক কোনো দেশ কিংবা প্রতিষ্ঠানের কাছে থাকা উচিত নয় বলে মনে করছেন ব্যবহারকারীরা। অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, কানাডা, চীন, মিসর, ফ্রান্স, জার্মানি, গ্রেট ব্রিটেন, হংকং, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ইতালি, জাপান, পোল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, দক্ষিণ কোরিয়া, সুইডেন ও যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের ওপর ৭ অক্টোবর থেকে ১২ নভেম্বরের মধ্যে চালানো এ জরিপে এ তথ্য জানা যায়।
আমাদের উপমহাদেশে শিশু ও তরুণদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে এ বছর শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তালেবান হামলায় বেঁচে যাওয়া পাকিস্তানি কিশোরী মালালা ইউসুফজাই এবং ভারতের শিশু অধিকার কর্মী কৈলাশ সত্যার্থী। ১৭ বছর বয়সী মালালা নোবেল পুরস্কারের ইতিহাসে সবচেয়ে কম বয়সে শান্তি পুরস্কার পেলেন। তিনি তালেবান হামলায় বেঁচে যাওয়ার পর নারী শিক্ষার উন্নয়নে কাজ করছেন। আর ৬০ বছর বয়সী কৈলাস দু’দশকেরও বেশি সময় ধরে ভারতে শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে আসছেন। গড়ে তুলেছেন ‘বচপন বাঁচাও’ আন্দোলন। গ্লোবাল ক্যাম্পেইন ফর এডুকেশনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা এবং সেই সুবাদে রাশেদা কে চৌধুরীর মাধ্যমে কৈলাস আমার পরিচিত। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর তাকে পাঠানো আমার অভিনন্দন বার্তার জবাবও তিনি দিয়েছেন।
মানুষের অধিকারের প্রশ্নে, মূল্যবোধ প্রসঙ্গে পূর্ব-পশ্চিমে, উত্তর-দক্ষিণ মিল-অমিল দুটিই আছে। একেকটি সমাজ ও সংস্কৃতির উপকরণ বৈচিত্র্যপূর্ণ ও ভিন্ন হতে পারে। পাশ্চাত্যের সমকামিতার স্বীকৃতির দাবি সর্বত্র অধিকারের তালিকাভুক্ত নয়। সে জন্য সাধারণভাবে স্বীকৃত ও গ্রাহ্য অধিকারগুলো নিয়েই সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধকে সুসংরক্ষণ করে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম নতুন শক্তি ও সাহসে বিকাশ লাভ করেছে। খাদ্য নিরাপত্তা, শিক্ষার অধিকার, চিকিৎসা লাভের অধিকার, নারী-পুরুষ, গ্রাম-শহর বৈষম্য, কর্মবৈষম্য, লিঙ্গবৈষম্য, সামাজিক বৈষম্য নিরসন, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধকারী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি সেজন্য দেশে মানবাধিকার আন্দোলনের প্রধান উপজীব্য।
অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ : ইনিশিয়েটিভ ফর হিউম্যান ডেভেলপমেন্টের চেয়ারম্যান, শিক্ষাবিদ

No comments

Powered by Blogger.