চট্টগ্রাম বন্দর চ্যানেলে বালু উত্তোলনের নামে নৈরাজ্য

কর্ণফুলী নদীর চট্টগ্রাম বন্দর চ্যানেলের নাব্যতা রক্ষায় বালু উত্তোলনের নামে চলছে ভয়াবহ নৈরাজ্য। চ্যানেলের বাইরে গিয়ে উপকূলের কাছাকাছি যত্রতত্র ড্রেজার বসিয়ে কখনও দিনের বেলায় আবার কখনও রাতের আঁধারে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। অপরিকল্পিতভাবে লাখ লাখ সিএফটি বালু উত্তোলন করায় হুমকির মুখে পড়েছে আনোয়ারার গহিরা-বার আউলিয়া উপকূল এবং সম্ভাবনাময় পারকি সমুদ্র সৈকত। এই উপকূল এবং সৈকতে থাকা বন বিভাগের বনায়নের শত শত গাছ, ঝাউ বাগান ও প্যারাবন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। ভাঙনের কবলে পড়ে সংকুচিত হয়ে আসছে সৈকত। অভিযোগ আছে, বিনা টেন্ডারে নামধারী কিছু প্রতিষ্ঠানকে বালু উত্তোলনের অনুমতি দিয়ে প্রকারান্তরে বন্দর কর্তৃপক্ষ এই নৈরাজ্যের সৃষ্টি করেছে। এসব প্রতিষ্ঠান মান্ধাতার আমলের ড্রেজার দিয়ে নির্ধারিত স্থানের পরিবর্তে কখনও কখনও উপকূলের কাছাকাছি গিয়ে বালু উত্তোলন করায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। বন্দরের হারবার মেরিন ও হাইড্রোগ্রাফি বিভাগের উচ্চপদস্থ কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশে ঠিকাদাররা নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে বালু উত্তোলন করছেন। বন্দরের অধীনে কর্ণফুলী নদীর ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের নামে যে মহাচুরির ঘটনা ঘটেছে তাও এরই ধারাবাহিকতায় হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো মনে করছে।
ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের কাজের নামে শত কোটি টাকা হাতিয়ে মাঝপথে কাজ ফেলে সপরিবারে কানাডা পাড়ি জমিয়েছেন মেরিন প্যাসিফিক নামে একটি প্রতিষ্ঠানের ঠিকাদার আবু জাফর ওরফে বালু জাফর। মূলত বন্দর কর্তৃপক্ষের অদূরদর্শিতা, অদক্ষতা সর্বোপরি অসাধু কর্মকর্তাদের অনৈতিক আর্থিক লেনদেনের কারণেই এভাবে ড্রেজিংয়ের নামে কর্ণফুলী ও বন্দর মোহনাজুড়ে ভয়াবহ নৈরাজ্য চলছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের হারবার মেম্বার কমডোর শাহজাহান যুগান্তরকে বলেন, উপকূলের কাছাকাছি কোনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে বালু তোলার অনুমতি দেয়া হয়নি। যদি কেউ তুলে থাকে তা চুরি করে তুলছে। তাছাড়া হাইড্রোগ্রাফি বিভাগের তত্ত্বাবধানে তাদের অনুমোদিত ৭-৮টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম বন্দরের আউটার বারে চ্যানেল ঠিক রাখতে নিয়মিত ড্রেজার বসিয়ে বালু তুলছে।
এক সময় নাব্যতা রক্ষায় ড্রেজিংয়ের নামে বন্দরের কোটি কোটি টাকা লোপাট করা হলেও বর্তমানে চ্যানেলে ড্রেজিংয়ের ক্ষেত্রে কোনো টাকা খরচ হয় না। এই কর্মকর্তা আরও বলেন, বোর্ড মিটিংয়ে পাস করেই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে চ্যানেলের বালু তোলা বা ড্রেজিংয়ের কাজ দেয়া হয়েছে।
আনোয়ারার পারকি এলাকার বাসিন্দা নুরুল আনোয়ার ও আবদুর রশিদ যুগান্তরকে অভিযোগ করে বলেন, দিনে-রাতে বিভিন্ন সময়ে আউটারে বালু তোলার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকা বন্দরের ড্রেজার উপকূলের কাছাকাছি এসে বালু তোলে। এতে করে প্রচণ্ড স্রোতে বালুর স্তর নিচে নেমে গিয়ে উপকূলে ভাঙনের সৃষ্টি হচ্ছে। পারকি সৈকত সংকুচিত হয়ে পড়ছে। বিলীন হচ্ছে বন বিভাগের লাগানো ঝাউ বাগান ও প্যারাবন। পশ্চিমকূলে ব্লক বসিয়ে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করে উপকূল রক্ষা করা হলেও আনোয়ারা উপকূল অরক্ষিত হয়ে পড়েছে।
বর্তমানে স্মার্ট ট্রেডিং, রীমা কর্পোরেশন, বোয়ালিয়া এন্টারপ্রাইজ, তাবাসসুম এন্টারপ্রাইজসহ ৭-৮টি প্রতিষ্ঠান বন্দর চ্যানেলে ড্রেজিং পরিচালনা করছে। এর মধ্যে তাবাসসুম এন্টারপ্রাইজ নগর আওয়ামী লীগের এক শীর্ষ নেতার পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে। সিটি এন্টারপ্রাইজ দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের এক শীর্ষ নেতার আত্মীয়ের প্রতিষ্ঠান। মূলত এসব প্রতিষ্ঠান ‘বিনা পয়সায় ড্রেজিংয়ের নামে কর্ণফুলী থেকে লাখ লাখ সিএফটি বালু তুলে তা বাইরে বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এই টাকার একটি মোটা অঙ্ক যাচ্ছে বন্দরের হারবার ও হাইড্রোগ্রাফি বিভাগের অসাধু কর্মকর্তাদের পকেটে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চট্টগ্রাম বন্দরের একাধিক সূত্র অভিযোগ করেছে, বন্দরের নিজস্ব অত্যাধুনিক খনক ড্রেজার পরে মেরামত করা হলেও সেটিকে ড্রেজিংয়ে ফিরিয়ে আনা হয়নি। সরকারদলীয় নেতাদের স্বজন এবং অসাধু ঠিকাদারদের পরিচালিত এসব প্রতিষ্ঠানকে টিকিয়ে রেখে ব্যবসা পরিচালনা করার জন্যই এই কৌশলের আশ্রয় নেয়া হয়। সূত্র অভিযোগ করেছে, বন্দরের সংশ্লিষ্ট বিভাগের আশ্রয়-প্রশয় ও আন্ডারহ্যান্ড ডিলিং থাকার কারণেই আউটার বার ফেলে উপকূলের কাছাকাছি ড্রেজার বসানো হচ্ছে। আবার নির্দ্দিষ্ট স্থান থেকেও অপরিকল্পিতভাবে বালু তুলছে ঠিকাদার। যার বলি হচ্ছে আনোয়ারা উপকূল ও পারকি সৈকত। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বন্দর চ্যানেলও।

No comments

Powered by Blogger.