আইওয়া থেকে বাংলাদেশ- কৃষির ভবিষ্যৎ গড়ে তুলছে প্রযুক্তি by ড্যান মজিনা

আইওয়ার একটা গরুর খামারে বেড়ে উঠেছি আমি।  আর এই বড় হয়ে ওঠার দিনগুলো কেটেছে আমার গরুর দুধ দুইয়ে, শূকরদের খাইয়ে এবং  ভুট্টা, যব আর বাড়ির গবাদি পশুদের খাওয়ানোর জন্য ঘাস জাতীয় আলফালফা চাষ করতে বাবাকে সাহায্য করে। যদিও আমার বাবার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তেমন ছিল না, কিন্তু তিনি ছিলেন একজন আধুনিকমনস্ক চাষি এবং কিভাবে আরও  ভালভাবে চাষাবাদ করতে হয় সে সংক্রান্ত নতুন নতুন ধ্যান ধারণা গ্রহণ করতে তিনি সব সময়ই উন্মুখ ছিলেন। বাবাকে ধন্যবাদ, তার কারণেই আমার অন্তরে একজন কৃষকের বাস এবং তার মতোই আমি সব সময় নতুন নতুন ধারণা সম্পর্কে জানতে, সেগুলো শিখতে উন্মুখ থাকি যাতে এই বিশ্বকে খাদ্য যোগান দেয়া যায়, নিরাপদে। আর তাই যখন আমি জানতে পারলাম যে বাংলাদেশ “কোলিতাত্ত্বিকভাবে পরিবর্তিত” (জেনেটিক্যালি ইঞ্জিনিয়ার্ড) বেগুনের চাষ অনুমোদন করেছে- যা এমনিতে ‘বিটি ব্রিঞ্জাল’ বা ‘বিটি বেগুন’ নামে পরিচিত- আমি খুবই উৎসুক আর কৌতূহলী হয়ে উঠেছিলাম। আমেরিকাতে আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে আমি জেনেছিলাম যে জৈবপ্রযুক্তির ব্যবহার ক্ষতিকর রাসায়নিকের ব্যবহার নাটকীয়ভাবে কমিয়ে কৃষকদেরকে, ভোক্তাদেরকে এবং পরিবেশকে রক্ষা করতে পারে। যখনই আমি আইওয়াতে ফিরে যাই, বাইসাইকেল চালিয়ে আমি চলে যাই সেই খামারে যেখানে আমি জন্মেছি আর বড় হয়ে উঠেছি। বছর দশেক আগে, এ রকমভাবে যখন আমি একদিন বাইসাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ আমার নজরে এলো আলাদা কিছু। একজন অত্যন্ত উৎসুক পাখি পর্যবেক্ষক আমি, আর ওই সড়কে হঠাৎ করে এমন কিছু পাখি আমার নজরে এলো যা এর আগে আর কখনও দেখিনি।
বাইসাইকেলটা থামিয়ে পুরনো প্রতিবেশী সাই লেহি’র সঙ্গে গল্প জুড়ে দিলাম। তাকে জানালাম ওই পাখিগুলোর কথা। সাই হাসলেন এবং বললেন, কেবলমাত্র ওই পাখিগুলোই যে ফিরে এসেছে তাই নয়, একই সঙ্গে আরও ফিরে এসেছে বুনো টার্কি, হরিণ, টেকো ঈগল, বিভার, কয়োট এবং আরও  অনেক জীবজন্তু। যে আঠারো বছর আমি সেখানে বাস করেছি এই জীবজন্তুগুলো আমাদের খামারে আমি আগে কখনও দেখিনি।
বন্যপ্রাণীর এই পুনরায় ফিরে আসা আমাকে কৌতূহলী করে তুললো। আমাদের প্রদেশের কৃষি বিষয়ক যে এজেন্ট ছিলেন তার সঙ্গে আমি যোগাযোগ করলাম। তিনি আমাকে জানালেন যে,  কৃষকরা বর্তমানে যে ‘কোলিতাত্ত্বিকভাবে পরিবর্তিত’ সয়াবিন  ব্যবহার করছে তাতে তাদের শস্যে কীটনাশক ব্যবহারের হার শূন্যে নেমে এসেছে। আগে তাদেরকে একই শস্যে ছয় থেকে সাতবার কীটনাশক স্প্রে করতে হতো।  ওই এজেন্ট আরও  ব্যাখ্যা করলেন যে এর ফলে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে বহু দশক আগে যে সব বুনো প্রাণী এসব এলাকা থেকে উধাও হয়ে গিয়েছিল সেগুলো আবার ব্যাপক হারে ফিরতে শুরু করেছে।
এই নতুন ধরনের সয়াবিন বীজের প্রচলন উৎপাদন ব্যয় হ্রাস এবং পরিবেশের উন্নয়ন (কীটনাশকের ব্যবহার এবং কীটনাশক প্রয়োগ করার জন্য যে জ্বালানি প্রয়োজন হতো তো বন্ধ করে) উভয় দিকেই কিভাবে ইতিবাচক অবদান রাখছে তা দেখে আমি বিস্মিত হয়েছিলাম আর এসব নাটকীয় পরিবর্তন আমি আমার নিজের চোখেই দেখেছি।
বাংলাদেশের দৃষ্টিকোণ থেকে
আইওয়াতে ‘কোলিতাত্ত্বিকভাবে পরিবর্তিত’ শস্যের ইতিবাচক ফল দেখে বাংলাদেশে এ ধরনের ফসলের বিশেষ করে বিটি বেগুনের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে আরও জানতে আমি আগ্রহী হয়ে উঠি। আর তাই সপ্তাহ দু’য়েক আগে একজন কৃষকের সঙ্গে কথা বলার জন্য পাবনা জেলায় যাই। এই নতুন ‘কোলিতাত্ত্বিকভাবে পরিবর্তিত’ বেগুন চাষের জন্য যে কুড়ি জন চাষি নির্বাচিত হয়েছেন ইনি তাদেরই একজন।
আর কি গল্পটাই না তিনি শোনালেন! তিনি আমাকে জানালেন (এবং সরকারের কৃষি বিষয়ক এজেন্টরা তা নিশ্চিত করলেন) যে সব চাষি প্রচলিত বেগুন চাষ করেন তাদের ফসলে এক মওসুমে তারা ৮০ থেকে ১০০ বার একটি শক্তিশালী কীটনাশক ব্যবহার করেন। আর ওই ফসলের মধ্যে যে সব পোকামাকড় থাকে সেগুলো নির্মূলের প্রচেষ্টা বেশির ভাগ সময়ই ব্যর্থ হয়। আমাকে ব্যাখ্যা করে বলা হলো যে, এসব কীটনাশকের কিছু অংশ ফল বা শস্যের মধ্যে প্রবেশ করে যার অর্থ আমরা অর্থাৎ  ভোক্তারাই এগুলো খেয়ে থাকি। যাই হোক, যে চাষি বিটি বেগুন চাষ করছেন তাকে কীটপতঙ্গ নির্মূল করতে একবারের জন্যও কীটনাশক স্প্রে করতে হয়নি। যেহেতু তার ফসলে কোন  পোকামাকড়ের উপদ্রব হয়নি সেজন্য তাকে কোন কীটনাশকও ব্যবহার করতে হয়নি। এমনিতে এ ধরনের কীট প্রচলিত বেগুনের ফলনের শতকরা ৭০ ভাগ ধ্বংস করে ফেলতে পারে।  তিনি পাতার পোকা নিয়ন্ত্রণের জন্য দুই থেকে তিন বার এক ধরনের প্রচলিত কীটনাশক ব্যবহার করেছিলেন।  এই চাষি তার ফসলের ফলন নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন যা পরিমাণে অনেক বেশি ছিল কারণ কীটপতঙ্গের কারণে তার ফসলের কোনও ক্ষতি হয়নি। এছাড়া, কীটনাশকের জন্য কোন ব্যয় না হওয়াতে তার ফসলের উৎপাদন ব্যয়ও হ্রাস পেয়েছিল। তিনি জানিয়েছেন, তিনি এবং তার পরিবার ওই বেগুন খেয়েছেন এবং উপভোগ করেছেন। এবং একথা অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে যে কীটনাশকের ব্যবহার এড়াতে পেরে পরিবেশ এবং ভোক্তাদের যে উপকার হয়েছে তার কোন তুলনা নেই। আমি এটা দেখে মুগ্ধ হয়েছি।
কম জমি, কম পানি, কম সার এবং আরও কম কীটনাশক ব্যবহার করে এই ক্রমবর্ধমান বিশ্বকে অধিকতর খাদ্য উৎপাদনে সক্ষম করে তুলতে এই ‘কোলিতাত্ত্বিকভাবে পরিবর্তিত’ বীজের আরও উন্নয়ন ও এর ব্যবহার খতিয়ে দেখতে সকলকে উৎসাহিত করার জন্য আমি এই সব কিছু সবার সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই। আমি বিশ্বাস করি যে কৃষিখাতে যে সব পদ্ধতি ব্যবহার করে সবচেয়ে ভাল ফল পাওয়া গেছে তার সঙ্গে সবচেয়ে ভাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সংমিশ্রণ ঘটানোর প্রয়োজন রয়েছে। জৈবপ্রযুক্তি এমন একটি হাতিয়ার যা কৃষকদেরকে কীটপতঙ্গ, খরা ও রোগবালাই-মুক্ত এমন ফসল উৎপাদনে সক্ষম করবে যা  দারিদ্র্য ও ক্ষুধা হ্রাস করবে।
বাংলাদেশ সরকারকে আমি অভিনন্দন জানাই কৃষকদেরকে কম খরচে বেগুন উৎপাদনে সুযোগ করে দেয়ার জন্য যা অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত উভয় দিক থেকেই লাভজনক।  আমি আনন্দিত যে জৈবপ্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর জন্য বাংলাদেশের চাষিদের সামনে এখন একটা সুযোগ রয়েছে; একই সঙ্গে তারা ভোক্তাদেরকেও নিরাপদ খাদ্যশস্য দিতে পারবেন আর এভাবে পরিবেশকেও তারা সাহায্য করছেন নদী-নালা-পুকুরে বিষাক্ত রাসায়নিক প্রবাহের পরিমাণ কমিয়ে যা মাছ, চিংড়ি এবং পাখি, মৌমাছি আর গবাদি পশুর জীবন বিষাক্ত করে তোলে। আর সাই লেহি আইওয়াতে বছর দশেক আগে এই ঘটনাই ঘটতে দেখেছিলেন; আর বাংলাদেশেও এই ঘটনা ঘটতে পারে।
লেখক: বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত

No comments

Powered by Blogger.