সিগারেট বিস্কুট চানাচুর বিক্রি করে সংসার চলে পাহাড়ি-বীরকন্যা লাম্রাসং’র by আজহার হীরা

জীবন যেখানে যেমন। ’৭১ হলেন নির্যাতিত। পরে স্বামীহারা। আর এখন নির্মম পরিস্থিতির শিকার। ৫ পেকেট স্টার সিগারেট আর কয়েক প্যাকেট চানাচুর-বিস্কুট বিক্রি করেই চলে তার জীবন। তিনি লাম্রাসং মারমা। বাড়ি মহালছড়ির বাবুপাড়ায়। ’৭১-এর যুদ্ধে হারিয়েছেন সম্ভ্রম। আর এখন বাঁচার জন্যই করছেন যুদ্ধ। বয়স ৭০ বছর। পাননি বয়স্ক ভাতা। স্বামী বেঁচে নেই। পাননি বিধবা ভাতা। সরকারি তেমন কোন সাহায্যও জোটেনি কপালে। খাগড়াছড়ির মহালছড়িও ছিল মুক্তিযুদ্ধের সময় উত্তাল। যুদ্ধে বাঙালিদের পাশাপাশি পাহাড়ের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীরও অবদান কম ছিল না। মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করায় বাড়িতে পুরুষদের না পেলে নারীদের ধরে নিয়ে পাশবিক নির্যাতন চালাতো পাকিস্তানিরা। এমনই নির্যাতনের শিকার মহালছড়ির থলীপাড়ার চাইন্দাউ মারমা, বাবুপাড়ার লাম্রাসং মারমা ও ম্রছাইন্দা মারমা (৬৮)। ভাঙা ভাঙা বাংলায় মুক্তিযুদ্ধের বহু স্মৃতিই জানা গেল তাদের কাছে। জানা গেল পাকবাহিনীর বিভিন্ন অপকর্মের কাহিনী। অথচ স্বাধীনতার ৪৩ বছরেও বীরাঙ্গনা পাহাড়ি নারীদের খবর কেউ রাখেননি। মহালছড়ির এমন দু’জন আর গুইমারায় আরও একজন বীরাঙ্গনা আজও চরম দুঃসহ যন্ত্রণা নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। বীরাঙ্গনা লাম্রাসং মারমা (৭০), স্বামী মৃত বিলা মারমা, মহালছড়ির বাবুপাড়া গ্রামে বসবাস। ‘৭১-এ নিজ ঘর থেকেই তাকে তুলে নিয়ে যায় পাকিস্তানি বাহিনীর দোসররা। দিনভর চালায় পাশবিক নির্যাতন। গভীর রাতে ছেড়ে দেয়। কান্না করতে করতে ঘরে ফিরে আসেন তিনি। বাড়িতে আসার পর স্বামীর গলা জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন। স্বামীও কান্না করেন তার সঙ্গে। পাকিস্তানিদের ভয়ে কেউ এগিয়ে আসেনি সেদিন। পরে স্বামী মারা যায়। দ্বিতীয়বার ইন্দ্র চাকমাকে বিয়ে করেন তিনি। তখনকার দিনগুলো ভালই চলছিল। কিন্তু ভাগ্যই যার দিকে ফিরে তাকায় না তার আবার সুখ কিসের। দ্বিতীয় স্বামীও মারা গেলেন। লাম্রাসং মারমার আগের স্বামীর ঘরে এক মেয়ে, এক ছেলে ও নাতি-নাতনি আছে। দ্বিতীয় বিয়ে করার পর তাদের থেকেও দূরে চলে আসেন তিনি। অবশ্য তারাও দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছেন। বড় মেয়ে পংছেইন্দা মারমা (৪০)। তারও দুই মেয়ে রয়েছে। ছেলে মংসাজাই মারমা (৩৮), দিনমজুরি করে। দুই ছেলে ও ৩ মেয়েকে নিয়ে কোন রকমে সংসার চালান। লাম্রাসং মারমা থাকেন দ্বিতীয় স্বামীর রেখে যাওয়া একটি ঘরে। সে ঘরেরই এক পাশে কয়েকটি পাত্রে চানাচুর, বিস্কুট ও সিগারেট বিক্রি করে দু’বেলা দু’মুঠো খাবার জোগাড় করেন তিনি। পুঁজি না থাকায় ৫ পেকেট সিগারেট নিয়ে আসেন দুই কিলোমিটার দূর থেকে। সেগুলো বিক্রি হয়ে গেলে আবার ছোটেন সিগারেট, চানাচুর ও বিস্কুট আনতে। সুন্দরভাবে কথাও বলতে পারেন না। সহজ সরল অপলক চোখের চাহনি দিয়ে বুঝিয়ে দেন তার অসহায়ত্বের কথা। উত্তর দেন মাথা নেড়ে। অসহায় এই বীরাঙ্গনাদের স্বীকৃতি ও পুনর্বাসনের জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী। এ ব্যাপারে খাগড়াছড়ি জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ইউনিট কমান্ডার মংসাথোয়াই চৌধুরী (মারমা সম্প্রদায়) জানিয়েছেন, এখন পর্যন্ত এসব বীরাঙ্গনাকে সরকারি কোন সহায়তা দেয়া হয়নি। সীমাবদ্ধতার কারণে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ থেকেও কোন সহায়তা পাচ্ছে না তারা। এরা সবাই মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এসব বীরাঙ্গনাকে নিজ এলাকাতেই পুনর্বাসনে সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মংসাথোয়াই চৌধুরী।

No comments

Powered by Blogger.