মৃত্যুফাঁদ রাজধানীর রাস্তা- ঢাকায় একদিনে বাসচাপায় নিহত ২ by মোল্লাহ রাশিম ও মির্জা মাহমুদ

যাতায়াত ও পারাপার কোন ক্ষেত্রেই নিরাপদ নয় ঢাকার রাস্তা। পরিবহন ও যাত্রীদের আইন না মানার প্রতিয়োগিতার কারণে প্রতিদিনই দুর্ঘটনায় ঝরছে প্রাণ। মর্মান্তিক সব মৃত্যুতে পথে বসছে একেকটি পরিবার। মেগাসিটি ঢাকায় রাস্তার পরিমাণ যেমন কম তেমনি নেই সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনাও। আলোচিত কোন দুর্ঘটনার পর ট্রাফিক বিভাগ নতুন নতুন উদ্যোগ নিলেও পরে তা আর কার্যকর থাকে না। বিপুল জনগোষ্ঠীর জন্য নগরীতে নেই পর্যাপ্ত গণপরিবহন। এ কারণে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলতে হয় সাধারণ মানুষকে। আর রাস্তা পারাপারে নগরজুড়ে রয়েছে নৈরাজ্যকর অবস্থা। এমন অবস্থার মধ্যেই প্রতীকীভাবে অবৈধ রাস্তা পারাপারকারী বিরুদ্ধে জেল-জরিমানার উদ্যোগ নিয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ। ডিএমপির হিসাবেই প্রতিবছর দেড় থেকে দু’শতাধিক প্রাণ যায় ঢাকার রাস্তায়। তাদের হিসাবে চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত ঢাকার রাস্তায় মারা গেছেন ১৩৪ জন। গত বছর মৃত্যু হয় ১৮৬ জনের। ২০১২ সালে এ সংখ্যা ছিল ২৩২। এর আগের বছর এ সংখ্যা ছিল ২১৪। প্রায় আড়াই কোটি মানুষের জন্য মাত্র ৯১টি ফুটওভারব্রিজ রয়েছে ঢাকার রাস্তায়। এর মধ্যে আবার ৬০টিরও বেশি ব্রিজ ব্যবহারের অযোগ্য। ঢাকার তিনটি আন্ডারপাসের মধ্যে মাত্র একটি ব্যবহার উপযোগী। নেই প্রয়োজনীয় জেব্রা ক্রসিং। বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি বড় নগরীর জন্য ২০ ভাগ রাস্তা প্রয়োজন থাকলেও ঢাকায় আছে মাত্র ৮ ভাগ। এর মধ্যে ২ ভাগের বেশি রাস্তা ব্যবহারের অনুপযোগী।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)-এর সূত্র জানায়, রাজধানীর ৯১টি ফুট ওভারব্রিজের মধ্যে ৫৩টি ডিএনসিসির, ২৮টি ডিএসসিসির। বাকি ১০টি সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের। কুড়িল বিশ্বরোডে উড়াল সড়কসংলগ্ন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) নিয়ন্ত্রণাধীন একটি ফুট ওভারব্রিজ আছে। সরেজমিন রাজধানীর বেশ কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে সেখানকার ফুটওভারব্রিজ ও আন্ডারপাসগুলো পথচারীবান্ধব নয়। এ পরিস্থিতির মধ্যেই হোটেল সোনারগাঁও মোড় থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত চতুর্থ দিনের মতো শেষ হয়েছে ডিএমপির সচেতনতামূলক অভিযান। চারদিনের অভিযানে ডিএমপি জরিমানা করেছে ৭৮৯ জনকে এবং ১ জনকে দিয়েছে এক মাসের জেল।
ফার্মগেটের চৌরঙ্গী মার্কেট সংলগ্ন দ্বিমুখী ফুটওভারব্রিজে পথচারীদের প্রচণ্ড ভিড়। অভিযান উপলক্ষে ব্রিজটি হকারমুক্ত করা হলেও ফুটওভারব্রিজের কয়েক স্থানে ঢালাই উঠে গেছে। এ ব্রিজটি বেশ ঝুঁকিপূর্ণ বলে অভিযোগ করেছেন ব্যবহারকারীরা। শাহবাগের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন ফুটওভার ব্রিজের সিঁড়ির পাটাতনে মরিচা পড়ে ক্ষয় হয়ে গেছে। পথচারীরা পা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেবে যাচ্ছে সিঁড়ি। মাঝের পাটাতনে বিভিন্ন জায়গায় ক্ষয় হয়ে যাওয়ায় ফুটো দিয়ে নিচের সড়ক দেখা যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যালে চিকিৎসা নিতে আসা হালিমা (৫৮) জানালেন, এ বয়সে সিঁড়ি ভেঙে ওভারব্রিজে উঠতে কষ্ট হয়। সিঁড়িগুলোর ধাপ নিচু হলে ভাল হতো বলে জানান তিনি। পরিবাগের ফুটওভারব্রিজটি কিছুটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন দেখা যায়। তবে পথচারীরা দিনের বেলা স্বচ্ছন্দে ফুটওভারব্রিজটি ব্যবহার করতে পারলেও রাত নামার সঙ্গে সঙ্গে কেউ ওই ফুটওভারব্রিজটি ব্যবহারের সাহস করেন না। কারণ রাত নামার সঙ্গে সঙ্গেই ব্রিজটি ছিনতাইকারী আর ভ্রাম্যমাণ পতিতাদের দখলে চলে যায়। ডিএমপির অভিযানের পর বাংলামোটর ফুটওভারব্রিজে পথচারীর লাইন ধরে উঠছেন। কিন্তু ব্রিজটির প্রবেশপথ সরু হওয়ায় উঠতে গিয়ে জটলার সৃষ্টি হচ্ছে। ডিএমপির অভিযানের পর কাওরান বাজার আন্ডারপাসে পথচারী চলাচল বেড়েছে, সে সঙ্গে বেড়েছে ধূলা। পথচারীরা অনেকেই নাকে রুমাল চেপে কিংবা নাকে হাত চেপে আন্ডারপাস দিয়ে পারাপার হচ্ছেন। সিঁড়ির বিভিন্ন জায়গায় প্লাস্টার উঠে গিয়ে উঁচু-নিচু হয়ে আছে। ফার্মগেট এলাকার ডেইলি স্টার পত্রিকাসংলগ্ন ফুটওভারব্রিজের এক পাশ সংস্কার কাজের জন্য দীর্ঘদিন বন্ধ আছে। ফার্মগেটের তেজগাঁও সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়সংলগ্ন ফুটওভার ব্রিজটি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় অনেক দিন ধরেই   কাঁটাতার দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে। তিতাস গ্যাসের কর্মকর্তা সৈয়দ মোকাররম হোসেন জানালেন, সারা দিন অফিস করে এমনিতেই অনেক ক্লান্ত থাকে। তার ওপর খাড়া সিঁড়ি বেয়ে ফুটওভারব্রিজে উঠতে হয় বলে অনেকেই নিচ দিয়ে রাস্তা পার হন। ব্রিজগুলোতে চলন্ত সিঁড়ির ব্যবস্থা করা হলে এবং হকার ও ভিক্ষুকমুক্ত করা হলে পথচারীরা ফুটওভারব্রিজ ব্যবহারে আগ্রহী হবেন।
শাহবাগ মোড়ে সাবেক পুলিশ কন্ট্রোল রুমসংলগ্ন ফুটওভার ব্রিজটি অপরিচ্ছন্ন ও দুর্গন্ধে ভরা। ওই ফুটওভার ব্রিজটিতে আবাস গড়েছে ছিন্নমূল মানুষ ও মাদকসেবীরা। একই অবস্থা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন সংলগ্ন ফুটওভারব্রিজটিতে। প্রস্রাবের উৎকট গন্ধ আর ময়লা-আর্বজনার কারণে কেউ ব্রিজটি ব্যবহার করতে চান না। দীর্ঘদিন রক্ষণাবেক্ষণ না হওয়ায় ব্রিজের বিভিন্ন স্থানে ঢালাই ও রঙ উঠে গেছে। আজিমপুর গার্লস স্কুল, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি সুফিয়া কামাল হল, প্রেস ক্লাবসংলগ্ন ফুটওভারব্রিজেও দেখা গেছে একই চিত্র। প্রেস ক্লাবসংলগ্ন চা দোকানি খালেক মিয়া জানান, রাতে ব্রিজটি ব্যবহারকারীদের জন্য মোটেও নিরাপদ না। রাত বাড়লেই ব্রিজটিতে ছিনতাইকারী আর ভাসমান পতিতাদের আনাগোনা বেড়ে যায়। পথচারীদের পারাপারের সুবিধার কথা মাথায় রেখে গুলিস্তান আন্ডারপাস নির্মাণ করা হলেও সেটি এখন পরিচিত দেশের বৃহত্তম মোবাইল ফোনের যন্ত্রাংশের মার্কেট হিসেবে। সরজমিন গুলিস্তান আন্ডারপাস ঘুরে দেখা গেছে মার্কেটের দোকানিরা আন্ডারপাসের চলাচলের রাস্তায় শোকেস বসিয়ে যাতায়াতের পথটি সঙ্কুচিত করে ফেলেছে। টাইলস উঠে গিয়ে উঁচু-নিচু হয়ে আছে। কাজ করছে না শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। সিঁড়িতে ও আন্ডারপাসের ভিতরে পড়ে আছে ময়লা, সেই সঙ্গে আছে হকারের উৎপাত আর কর্মচারীদের হাঁকডাক। আন্ডারপাসের নিরাপত্তা কর্মী আবু সুফিয়ান জানালেন আন্ডারপাস মার্কেটটি অন্য মার্কেটের মতো রাত ৮টা পর্যন্ত খোলা থাকে। এরপরে পথচারীরা ঝুঁকি নিয়েই রাস্তা পার হন।
নগর ভবন থেকে গুলিস্তান যাওয়ার রাস্তায় কোন জেব্রা ক্রসিং বা ফুটওভারব্রিজ না থাকায় পথচারীরা ঝুঁকি নিয়েই ওই সড়কটি পার হন। এছাড়াও পুরানা পল্টন মোড়ে কোন জেব্রা ক্রসিং বা ফুটওভারব্রিজ না থাকায় এলোপাতাড়ি সড়কটি পার হচ্ছেন পথচারীরা। রাজধানীর ব্যস্ততম নিউ মার্কেট এলাকায় দু’টি ফুটওভারব্রিজ আছে। গাউছিয়া থেকে নিউ মার্কেটগামী ফুটওভারব্রিজটির প্রবেশপথে হকাররা দোকান বসিয়ে ব্রিজে ওঠার পথটি সঙ্কুচিত করে ফেলেছে। অতি সমপ্রতি ব্রিজটি থেকে হকার উচ্ছেদ করা হলেও বীভৎস চেহারার ভিক্ষুকরা সেখানে বসে ভিক্ষা চাইছে। নীলক্ষেত থেকে নিউ মার্কেটগামী অপর ফুটওভারব্রিজটিতে হকার আর ভিক্ষুকের উৎপাত লক্ষ্য করা যায়। নিউ মার্কেটে শপিং করতে আসা সুমনা বলেন, আমরা তো ফুটওভারব্রিজ ব্যবহার করেই পথ চলতে চাই। কিন্তু ব্রিজগুলোতে বীভৎস চেহারার ভিক্ষুকদের দেখলে বাচ্চারা রাতে ভয় পায়।
এদিকে গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ি-রায়েরবাগ এলাকার পথচারীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়েই রাস্তা পারাপার হচ্ছেন। রাস্তা পারাপার হতে গিয়ে প্রায়ই দুর্ঘটনায় পড়তে হচ্ছে পথচারীদের। গত সেপ্টেম্বর মাসে দয়াগঞ্জ এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় ২ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। আর এ কারণে এলাকাবাসীর আন্দোলনে ১৩ নম্বর পরিবহন চলাচলে বন্ধ রয়েছে। যাত্রাবাড়ি থানা সূত্রে জানা যায়, যাত্রাবাড়ি মোড় থেকে রায়েরবাগ পর্যন্ত চলতি বছরের ১০ মাসে ২২ জন নিহত এবং পাঁচজন আহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। তবে আহত হওয়ার ঘটনা আরও বেশি বলে পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। সড়ক দুর্ঘটনায় আহত বেশির ভাগ পথচারী নিজেরাই রফাদফা করেন। এ ব্যাপারে যাত্রাবাড়ি থানার ওসি অবনী শংকর কর বলেন, শনির আখড়া ও রায়েরবাগ এলাকায় বেশি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। এসব এলাকায় দ্রুত আন্ডারপাস নির্মাণ করা প্রয়োজন। যাত্রাবাড়ি মোড়ে পাঁচটি রাস্তার সংযোগস্থল হওয়ায় এখানকার পথচারীরা ঝুঁকি নিয়েই রাস্তা পারাপার হচ্ছেন। ফ্লাইওভার নির্মাণের আগে এখানে পথচারীদের জন্য ওভারব্রিজ ছিল।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)-এর এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকা শহরে হেঁটে যাতায়াত করেন ৩৭ ভাগ মানুষ। হাঁটার নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্যময় পরিবেশ না থাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ও আহতদের মধ্যে পথচারীর সংখ্যাই বেশি। অপর্যাপ্ত, নিম্নমানের হাঁটার অনুপযোগী ফুটপাথ এবং রাস্তা পারাপারের তেমন কোন ব্যবস্থা না থাকাই এর অন্যতম কারণ। সংগঠনের চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, পথচারীদের  তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিক মনে করার কারণে সরকার যাতায়াত পরিকল্পনায় তাদের অগ্রাধিকার দেয় না।
রাজধানীতে প্রাণ গেল আরও ২ জনের: রাজধানীর পৃথক স্থানে সড়ক দুর্ঘটনায় এক শিক্ষার্থী ও এক অজ্ঞাত যুবক নিহত হয়েছেন। দুর্ঘটনার জন্য দায়ী দুটি বাস ও রাসেল নামে এক চালককে আটক করেছে পুলিশ। পুলিশ নিহতের লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠিয়েছে। গতকাল এ ঘটনা ঘটে। সূত্র জানায়, সকাল সাড়ে ৮টায় শাহজাহানপুর থানাধীন মালিবাগ রেলগেটে পাশের রাস্তায় বলাকা পরিবহনের একটি বাস থেকে নামছিলেন কাঞ্চন। এ সময় পেছন দিক থেকে আসা দ্রুতগতির একটি বাস তাকে ধাক্কা দেয়। এতে তার মাথা ও পিঠে আঘাত লাগে। মুমূর্ষু অবস্থায় সঞ্জয় নামের এক পথচারী তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে জরুরি বিভাগের চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
নিহতের বোনজামাই ব্যবসায়ী আলমগীর হোসেন জানান, কাঞ্চন ঢাকার ধানমন্ডিতে অবস্থিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইআইইউসি (ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটি চট্টগ্রাম) ঢাকা ক্যাম্পাস থেকে বিবিএ করছিলেন। রামপুরার বনশ্রীর সি ব্লকের ৫ নম্বর রোডের ২৫ নম্বর বাড়িতে পরিবারের সঙ্গে থাকতেন তিনি।
এদিকে সকাল ৮টায় মিরপুর থানাধীন কল্যাণপুর বিআরটিসির বাসস্ট্যান্ডের সামনে একটি যাত্রীবাহী বাস অজ্ঞাত যুবককে ধাক্কা দেয়। এতে ওই যুবক ঘটনাস্থলেই নিহত হন। খবর পেয়ে পুলিশ নিহতের লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠায়। মিরপুর থানার এসআই মো. মোকতারুজ্জামান জানান, নিহতের পরনে ছিল জিন্সপ্যান্ট ও টিশার্ট। তার মাথায় আঘাতের চিহ্ন ছিল। তার পরিচয় উদঘাটনের পাশাপাশি দুর্ঘটনার জন্য দায়ী বাস ও চালককে আটকের জন্য চেষ্টা চলছে। এ ঘটনায় থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা দায়ের করা হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.