মৌচাকে দুই বাসের পাল্লা মাঝে পড়ে শিক্ষার্থী নিহত

নোয়াখালীর সেনবাগের হোসেন মাস্টার ক’দিন আগে তার সহধর্মিণী নুরুন্নাহারকে বলছিলেন, ‘ও যে কবে বিদেশ যাবে। কবে যে স্বপ্ন পূরণ করবে, সেই অপেক্ষায় আছি। ওকে নিয়ে আমার বুক ভরা আশা। আমি সেই আশায় আছি।’ অবসরে যাওয়া মাস্টারের এ আশার গল্প শুনে স্ত্রী তখন বলেছিলেন, ‘কাঞ্চন তো আমাদের রত্ন। সেই পারবে আলো ছড়াতে।’ মা-বাবার এত স্বপ্নের কাঞ্চন রোববার রাজধানীতে রাস্তা পার হওয়ার সময় দুটি বাসের মাঝখানে চাপা পড়েন। পাঁচ থেকে সাত মিনিট তিনি সেখানে আটকে থাকেন। পরে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। সকাল ৯টার দিকে মৌচাক এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। তার পুরো নাম মোজাম্মেল হোসেন কাঞ্চন (২৩)। ফেসবুকে নাম মোজাম্মেল কাঞ্চন। তিনি আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (আইআইইউসি) ঢাকা ক্যাম্পাস থেকে বিবিএ শেষ করেছিলেন। কাঞ্চন তার ফেসুবক একাউন্টে শেষ পোস্টে লিখেছিলেন, ‘কষ্ট দেই বলে সরি মা।’ দুই বাসের ফাঁকে আটকা পড়ে জ্ঞান হারানোর আগেও শেষ শব্দ ছিল ‘মা’। প্রত্যক্ষদর্শী যুবক সঞ্জয় বলেন, হঠাৎ ওই যুবকের দুই পাশে গাড়ি দেখে আমি চিৎকার করছিলাম, ওই গাড়ি আস্তে চালা, ছেলেটা চাপা পড়ে যাচ্ছে। বলতে বলতেই তিনি দুই বাসের ফাঁকে আটকা পড়েন। তখনও কেউ তার নাম জানে না।
বাস দুটির নাম দিবানিশি ও ফাল্গুনী বলে সঞ্জয় জানান। তিনি বলেন, বাস দুটির পাল্লার কারণে ওই যুবক ৫ থেকে ৭ মিনিট ফাঁকে আটকা পড়ে থাকেন। একবার শুধু তাকে বলতে শুনি, ‘মা’ ডাক। মা বলেই আর কিছু বলার ক্ষমতা হারায়।
প্রত্যক্ষদর্শী সঞ্জয়ই উদ্ধার করে কাঞ্চনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেন। চিকিৎসক সকাল ১০টার দিকে তাকে মৃত ঘোষণা করেন। সঞ্জয় জানান, কাঞ্চনের মোবাইল ফোনের ডায়াল কলে দেখতে পান বাবা নামে একটি নম্বর সেভ করা। তিনি ফোন করেন, ‘ওপাশ থেকে লোকটি বলেন, বাবা কাঞ্চন বল। তখন সঞ্জয় বলেন, ‘আমি কাঞ্চন নই। আপনার ছেলে দুর্ঘটনায় পতিত হয়েছে’। সঞ্জয় বলেন, এরপর লোকটি ফোন কেটে দেন। মিনিটের মধ্যে কাঞ্চনের ফোনে কল করেন আরেক ব্যক্তি। তিনি পরিচয় দেন কাঞ্চনের দুলাভাই আলমগীর হিসেবে। তিনি বলেন, ‘ভাই দ্রুত হাসপাতালে নেন, আমি আসছি।’ আলমগীর হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ‘আমি হাসপাতালে গিয়ে দেখি, আমাদের কাঞ্চন আর কথা বলছে না।’ তিনি জানান, কাঞ্চন বিবিএ শেষ করে রাজধানীর বাড্ডায় উত্তরা ব্যাংকের শাখায় ইন্টার্নি করছিলেন। তিন ভাই দুই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন চতুর্থ।
রামপুরার বনশ্রীতে বোন লাকি আক্তারের বাসায় থাকতেন কাঞ্চন। লাকি আক্তার বলেন, সকালে নাস্তা খেয়ে বাসা থেকে বের হয় কাঞ্চন। এরপরই মৌচাকে অ্যাপেক্স শোরুমের সামনে দুর্ঘটনার শিকার হয়। খবর শুনে বিশ্বাসই হয় না, এ কী শুনছি? নোয়াখালীর সেনবাগের মাইজীদিতে আছেন বাবা মোহাম্মদ হোসেন মাস্টার। টেলিফোনে তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। ইন্টার্নি শেষ হলে এমবিএ করতে সে জাপানের টোকিও যেত। টাকা পয়সা আর যাওয়ার সব বন্দোবস্ত হচ্ছিল’। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, এত দুর্ঘটনা ঘটে সরকার কি ব্যবস্থা নেয়? আজ আমার ছেলে গেল, কাল অন্যের ছেলে যাবে। এভাবে স্বপ্ন মাটির সঙ্গে মিশে যাবে মানুষের।
এর স্থায়ী প্রতিকার দাবি করেন কাঞ্চনের বাবা। নিহতের ভাই মিজানুর রহমান বলেন, কী করে কাঁধে নেব তার মরদেহ? বাবা-মা তাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখত। আমরাও এ স্বপ্নের অংশীদার ছিলাম। কিন্তু আমাদের স্বপ্ন পূরণ হল না। নিহতের দুলাভাই আলমগীর জানান, নোয়াখালীর সিলেনিয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও এমএ হাশেম কলেজ থেকে কাঞ্চন এইচএসসি পাস করে ভার্সিটিতে ভর্তি হয়। সে খুব মেধাবী ছিল।
শাহজাহানপুর থানার এসআই খোদা নেওয়াজ বলেন, বাস দুটি আটক করা হয়েছে। এ ঘটনায় মামলাও হয়েছে। ফাল্গ–নী বাসের চালককে গ্রেফতার করা হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.