বর্ধমান বিস্ফোরণ নিয়ে রহস্য

বর্ধমানের খাগড়াগড় বিস্ফোরণে নিহত করিম শেখের পরিচয় নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে রহস্য। ওই বিস্ফোরণে নিহত এক যুবককে করিম শেখ হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও প্রকৃতপক্ষে করিম শেখের পিতা জামশেদ তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেছেন, হাসপাতালের মর্গ থেকে লাশ গ্রহণ করতে তাকে চাপ দিয়েছে গোয়েন্দা সংস্থা ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি (এনআইএ)। গ্রামের কেউ লাশ শনাক্ত করতে পারে নি। ফলে প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছে, তাহলে কি নিহত ব্যক্তি করিম শেখ নয়? কেউ বলছেন, এনআইএ’র অনুসন্ধানে রয়েছে ফারাক। এ সব কথা বলা হয়েছে ভারতের প্রভাবশালী ম্যাগাজিন আউটলুক ইন্ডিয়ার প্রচ্ছদ প্রতিবেদনে। ‘দ্যাট হাউজ ইন বর্ধমান’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনের লেখক অজিত সাহি। করিম শেখের পিতা জামশেদের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে রচিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ২রা অক্টোবর বর্ধমান বিস্ফোরণের পর ‘কথিত’ করিম শেখের পরিবার আউটলুক ম্যাগাজিনকে ভিডিওতে ধারণ করা সাক্ষাৎকারে যা বলেছেন তা এনআইএর অনুসন্ধানের প্রতি সংঘাতমূলক। পরিবার যে সাক্ষ্য দিয়েছে তাতে এনআইএর অনুসন্ধানের সততা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে বড় প্রশ্ন। এনআইএ’র বর্ণনায় বলা হয়েছে, খাগড়াগড়ে যে বাসায় বিস্ফোরণ ঘটেছে তার ভেতর থাকা ৫ ব্যক্তির একজন করিম শেখ। মহাত্মা গান্ধীর জন্মবার্ষিকী উদযাপনের দিন দুপুরের ঠিক কিছুটা আগে সেখানে একটি বোমা বিস্ফোরণ হয়। স্থানীয় পুলিশ সেখানে উপস্থিত হয়। তারা ওই ঘরের ভেতর প্রবেশ করে দেখতে পায় এক যুবকের শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে আছে। এক যুবকের অবস্থা আশঙ্কাজনক। আরেকজন মারাত্মক আহত। ওই যুবককে হাসপাতালে নেয়া হলে তিন ঘণ্টা পরে সে মারা যায়। এর এক মাস ১০ দিন পরে এনআইএ বলে, নিহত ওই যুবকের নাম করিম শেখ। ১২ই নভেম্বর বর্ধমান পুলিশের গৌতম হালদার নামে এক কর্মকর্তা সরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে একটি চিঠি লেখে। ৩রা অক্টোবর পোস্টমর্টেমের পর থেকে ওই যুবকের লাশ রাখা ছিল ওই হাসপাতালের মর্গে। তিনি ওই চিঠিতে লেখেন, নিহতের পরিচয় পাওয়া গেছে। তার নাম করিম শেখ। পিতার নাম জামশেদ। মৃতদেহ শনাক্ত করেছেন তার পিতা জামশেদ শেখ। তার হাতে তার সন্তানের লাশ তুলে দেয়া হোক। পরের দিন শোকাহত জামশেদ তার সন্তানের মৃতদেহ নিয়ে যান বাড়িতে। দাফন সম্পন্ন করেন। কিন্তু এখানেই প্রশ্ন উঠেছে। জামশেদ বলছেন, ওই লাশ যে তার ছেলের তা তিনি শনাক্ত করেন নি। তিনি আউটলুককে বলেন, লাশ পচে গিয়েছিল। গ্রামের কেউই তা শনাক্ত করতে পারে নি। আরও বিস্ময়ের বিষয় হলো, জামশেদ বলেছেন যে- তিনি এনআইএ কর্মকর্তাদের বলেছিলেন তিনি লাশ শনাক্ত করতে পারেন নি। তাহলে কেন তিনি এ লাশ গ্রহণ করবেন? তিনি আরও বলেন, এনআইএ কর্মকর্তারা লাশ গ্রহণের জন্য তার ওপর চাপ প্রয়োগ করেছিলেন। জামশেদের মতে, তার ছেলে করিম শেখ ওই ঘটনার দু’মাস আগে নির্মাণকাজের জন্য কেরালায় গিয়েছে। তারপর থেকে সে আর ফোনও দেয় নি, কোন চিঠিও লেখেনি। জামশেদ বলেন, এনআইএ কর্মকর্তারা আমার বাড়ি এলেন। তারা একটি মোবাইল ফোনে আমাকে একটি লাশের ছবি দেখিয়ে বললেন, এ ছবি আমার ছেলের। জবাবে তিনি তাদের জানান, তিনি মোবাইল ফোনের ওই ছবি শনাক্ত করতে পারছেন না। এ সময় তাদের কথায় রাজি করাতে তাকে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে তারা। তিনি বলেন, মোবাইলে যে ছবি দেখানো হয়েছে তাতে নিহতের শরীরে কোন ক্ষতের চিহ্ন ছিল না। জামশেদ ও তার ভাইপো আমিরুল বলেন, যখন তাদের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হলো তখন দেখা গেল তার বুক ও মুখের অংশবিশেষ বিস্ফোরণে উড়ে গেছে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় যে ফারাক ধরা পড়েছে তা হলো- লাশ শনাক্ত করতে তাদের আর কোন চিহ্ন বা উপাদান দেখানো হয় নি। মোবাইলে দেখানো ছবির সঙ্গে বাস্তবে তাদের যে লাশ দেয়া হয়েছে তার কোন মিল নেই। এর ফলে বেশ কিছু প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। যেমন- জামশেদ তার ছেলের লাশ শনাক্ত না করলেও কেন এনআইএ লিখেছে, তিনি লাশ শনাক্ত করেছেন? সরকারিভাবে নিয়োগ দেয়া পুলিশের ফটোগ্রাফারের তোলা ছবি না দেখিয়ে কেন মোবাইল ফোনে তোলা ছবি জামশেদকে দেখিয়েছে এনআইএ? মোবাইল ফোনের ওই ছবির আইনগত বৈধতা কি? জামশেদকে কেন মাত্র একটি ছবি দেখানো হয়েছে? যদি জামশেদ তার ছেলের লাশ শনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়ে থাকেন তাহলে এনআইএ কেন ডিএনএ পরীক্ষা করার কথা বলে নি? অবশ্যই ওই মৃতদেহ হতে পারে করিম শেখের। কিন্তু প্রতিটি ক্ষেত্রে দৃঢ় প্রমাণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, বিস্ফোরণের পর এ নিয়ে যে উত্তেজনা চলছে তাতে রাজনৈতিক অঙ্গনে এক বিপজ্জনক অবস্থা বিরাজ করছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে অভিযুক্ত করে বলেছে, তিনি ইসলামপন্থি জঙ্গিদের মদত দিচ্ছেন। ওদিকে করিম শেখ ও তার সঙ্গীরা যে বাড়িটি ভাড়া নিয়েছিল তার মালিক মোহাম্মদ হাসান চৌধুরীকে বিস্ফোরণের ১৩ দিন পর জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, পুলিশ এবং এনআইএ কেন ওই মৃতদেহ শনাক্ত করতে তাকে ডাকেনি। এনআইএ বলেছে, ওই বিস্ফোরণে নিহত আরেকজনের নাম শাকিল আহমেদ। তার লাশ শনাক্তের ক্ষেত্রে তারা বাড়ির মালিকের সাক্ষ্যকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেছে। ১০ই নভেম্বর আমজাদ শেখ ওরফে কাজল নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর পরই করিম শেখের মৃতদেহ শনাক্ত করে এনআইএ। তারা বলেছে, মৃতদেহ শনাক্ত করেছে কাজল। কারণ, করিম শেখ তার ফুফাতো ভাই। সে আরও স্বীকারোক্তি দিয়েছে যে, বোমা তৈরির সঙ্গে জড়িত করিম শেখ। করিম শেখকে ধরিয়ে দিতে ঘোষণা করা হয়েছিল ১০ লাখ রুপি পুরস্কার। কাজলের পিতা কীর্নাহার শহরের এক মুদি দোকানি শুকুর শেখ। ছেলে যে জিহাদে যোগ দিতে পারে সে বিষয়ে সংশয় রয়েছে তার। তিনি বলেন, কাজল ছিল সিপিআই (এম)-এর স্টুডেন্টস ফেডারেশন অব ইন্ডিয়া’র সক্রিয় কর্মী। তার ছিল শুধু হিন্দু বন্ধু। কাজল কলকাতায় অবস্থান করছিল চার বছর ধরে। এনআইএ তাকে ধরিয়ে দেয়ার জন্য পুরস্কার ঘোষণার পর সে জীবনের মায়ায় পালিয়ে বেড়াচ্ছিল। বর্ধমান বিস্ফোরণের পর এনআইএ’র দেয়া বিবরণ ও বাস্তবের যে ফারাক ধরা পড়েছে তা আলাদাভাবে তুলে ধরেছে আউটলুক। তাতে করিম শেখ সম্পর্কে বলা হয়েছে: এনআইএ’র দাবি করিম শেখের পিতা জামশেদ শেখ। তিনি এনআইএকে বলেছেন, বিস্ফোরণে নিহতের পর ছেলের লাশ তিনি শনাক্ত করেছেন ১২ই নভেম্বর। তবে যে ফারাক ধরা পড়েছে তা হলো- জামশেদ শেখ লাশ শনাক্তের কথা অস্বীকার করেছেন। শাকিল আহমেদ নিহত হলেও বাড়ির মালিক মোহাম্মদ হাসান চৌধুরীকে তার লাশ শনাক্ত করতে ডাকা হয় নি। বিস্ফোরণে বেঁচে গেছে আবদুল হাকিম নামে একজন। বর্তমানে সে এনআইএর হেফাজতে রয়েছে। তাকেও শনাক্ত করতে ডাকা হয় নি হাসান চৌধুরীকে। এমনকি হাকিমের পিতা শাহ জামালকেও ডাকা হয় নি। আমজাদ শেখ ওরফে কাজলের পিতা শুকুর শেখ বলেন, তার ছেলে জঙ্গি কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত নয়। তিনি আরও বলেছেন, এনআইএ তার ছেলেকে গ্রেপ্তার করে নি। উল্টো তিনিই তাকে ধরিয়ে দিয়েছেন।

No comments

Powered by Blogger.