দক্ষিণ এশিয়ার জলবিদ্যুৎ রাজনীতি

বিশাল হিমালয় পর্বতমালার বুক চিরে বের হওয়া নদীগুলো বিদ্যুৎ উৎপাদনে অনন্ত সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। হিমবাহ আর মৌসুমি বৃষ্টিপাতের আশীর্বাদে পুষ্ট এসব নদী। এগুলোর জলরাশিকে কাজে লাগিয়ে সম্প্রতি একের পর তৈরি হচ্ছে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। জ্বালানিসংকটের শিকার দক্ষিণ এশিয়ায় আশার আলো জ্বালিয়েছে এসব প্রকল্প। এই অঞ্চলের রাজনীতিতে জ্বালানি ক্রমশই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হিসেবে প্রাধান্য পাচ্ছে। হিমালয়-দুহিতা নেপালে একাধারে তৈরি হচ্ছে চারটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। ভারতের জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রতিষ্ঠান জিএমআর ১২০ কোটি ডলার ব্যয়ে নেপালের মারসিয়াংদি নদীতে ৬০০ মেগাওয়াটের একটি জলবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র তৈরির কাজ করছে। এটি শেষ করতে লাগবে পাঁচ বছর। মারসিয়াংদির একটু ভাটির দিকে চীনের সিনোহাইড্রো নির্মাণ করছে ৫০ মেগাওয়াটের একটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। এর কাছেই জার্মানির নির্মিত আরেক বিদ্যুৎ প্রকল্প আছে। নদীর উজানে ভারতের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান আরও জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা করছে। উদ্দেশ্য, জ্বালানিসংকটে ভোগা ভারতের কয়েকটি নগরে বিদ্যুৎ সরবরাহ। ভারতীয় জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরির প্রতিষ্ঠান জিএমআরের দৃষ্টি নিবদ্ধ আরেক দিকে। পশ্চিম নেপালের আপার কারনালি নদীতে ৯০০ মেগাওয়াটের জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করবে প্রতিষ্ঠানটি। গত সেপ্টেম্বরে নেপাল সরকারের সঙ্গে জিএমআর ১৪০ কোটি ডলারের একটি চুক্তি করে। এটি নেপালের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বেসরকারি বিনিয়োগ। আপার কারনালি প্রকল্পে ১২ শতাংশ বিদ্যুৎ নেপালকে বিনা পয়সায় দেবে জিএমআর। পুরো প্রকল্পে নেপালের অংশ থাকছে ২৭ শতাংশ। ২৫ বছর পর পুরো প্রকল্পের মালিক হবে দেশটি। ২৬ থেকে ২৭ নভেম্বর নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে অনুষ্ঠিত সার্ক সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের শীতল সম্পর্ক আলোচিত বিষয় হিসেবে প্রাধান্য পেয়েছে। তবে এরই মধ্যে ২৫ নভেম্বর আরেক বড় ভারতীয় জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ প্রতিষ্ঠান ৯০০ মেগাওয়াটের একটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরির জন্য নেপাল সরকারের সঙ্গে চুক্তি করে।
প্রকল্পটির নাম অরুণ-৩। যুক্তরাজ্যের আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা ডিএফআইডির গবেষণা বলছে, চারটি প্রকল্প থেকে নেপাল আগামী ৩০ বছরে এক হাজার ৭০০ কোটি ডলার আয় করতে পারে। গত বছর নেপালের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আকার ছিল এক হাজার ৯০০ কোটি ডলার। পাহাড়ি দেশ নেপালের সব কটি নদী যদি জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজে লাগানো যায়, তবে ৪০ গিগাওয়াট (এক হাজার মেগাওয়াটে এক গিগাওয়াট) বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। ভারতের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতার এটি এক-ষষ্ঠাংশ। এর সঙ্গে যোগ হতে পারে পাকিস্তান, ভুটান এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের নদীগুলো। ভুটান ইতিমধ্যে তিন গিগাওয়াটের জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে হাত দিয়েছে। হিমালয়ের দেশগুলোর মধ্যে আন্তদেশীয় জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের এমন রমরমা কেন এখন? এর প্রথম কারণ, দেশগুলোর মধ্যে বোঝাপড়া আগের চেয়ে বেড়েছে। স্থানীয় রাজনীতির কারণে এসব প্রকল্পের কাজ বন্ধ ছিল। নেপালে এক দশক ধরে চলেছে গৃহযুদ্ধ। ২০০৬ সালে এ যুদ্ধ শেষ হয়। তাই ভারত-নেপাল সম্পর্কের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে উন্নতি হয়েছে বিদ্যুৎ-রাজনীতিরও। বিদ্যুৎ খাতে ভারতের অভ্যন্তরীণ বাজারের ব্যাপক সংস্কার এর দ্বিতীয় কারণ বলে মনে করেন বিশ্বব্যাংকের নিয়ন্ত্রণাধীন ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশনের রঘুবীর শর্মা। তাঁর মতে, ভারতের সরকার আন্তদেশীয় বিদ্যুৎ-সংযোগের বিষয়ে বেশ আগ্রহী। এর একটি কারণ অবশ্যই কূটনীতি। ইতিমধ্যে পাকিস্তানে এক গিগাওয়াট বিদ্যুৎ রপ্তানির কথা বলা হয়েছিল। তবে দুই দেশের সম্পর্কের টানাপোড়েন সেই স্বপ্নকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। ভারতের বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, দক্ষিণ এশিয়াকে আগামী ২০ বছরে জ্বালানি উৎপাদন তিন গুণ বাড়াতে হবে। আন্তদেশীয় বিদ্যুৎ-সংযোগ এবং আন্তর্জাতিক বিদ্যুৎ-বাণিজ্য এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। গ্রীষ্মকালে নেপাল ভারতে বিদ্যুৎ রপ্তানি করতে পারে। আবার শীতকালে নেপালের নদীগুলো শুকিয়ে গেলে ভারত সেখানে বিদ্যুৎ দিতে পারে। সূত্র: দি ইকোনমিস্ট

No comments

Powered by Blogger.