স্বৈরশাসন বেশিদিন টেকে না by শিমুল বিশ্বাস

বাংলাদেশে এখন চলছে একদলীয় স্বৈরশাসন। ২০০৯ সাল থেকে ২০১৩ সালের ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত তবুও এটাকে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক স্বৈরাচার বলা যেত; কিন্তু ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন একদলীয় অবৈধ নির্বাচনের পর এটাকে অবৈধ একদলীয় স্বৈরশাসন ছাড়া আর কিছুই বলা যাচ্ছে না। একটি অনির্বাচিত অগণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় চেপে বসলে দেশের জনগণকে যেসব সমস্যা মোকাবেলা করতে হয় সেগুলো মোকাবেলা করতে করতে মানুষ এখন সরকারকে এতটাই অবিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে, শাহজাহানপুরে শিশু জিহাদের মৃত্যুর কঠিন বাস্তবতাকেও অনেকেই রেশমা নাটকের মতো সরকারের বিভিন্ন এজেন্সির সাজানো নাটক মনে করেছিল। জনগণ এই সরকারকে ভোট দেয়নি, জনগণ তাদের সমর্থন করে না, জনগণ তাদের ক্ষমতায়ও দেখতে চায় না। কিন্তু তারপরও এই সরকার জোরপূর্বক অবৈধভাবে ক্ষমতায় টিকে আছে।
সরকারের এই টিকে থাকাটা এখন শুধু আওয়ামী লীগ ও তাদের দোসরদের অস্তিত্বের প্রয়োজনে। তারা গত ছয় বছরে যত খুন, গুম, দুর্নীতি, অত্যাচার করেছে, তাতে ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার পর গণরোষ থেকে তাদের বাঁচার কোনো উপায় তারা নিজেরাই দেখতে পারছে না। ঠিক বাঘের পিঠে চেপে বসার মতো, জোর করে বসে না থেকে কোনো উপায় নেই, কারণ পিঠ থেকে নামলেই বাঘের হাতে নিশ্চিত মৃত্যু।
তারপরও সাধারণ মানুষ আশা করেন বিএনপি এবং অন্য বিরোধী দলগুলো আন্দোলন করে এই সরকারের পতন ঘটাবে। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক আন্দোলনকে সম্মান করে রাষ্ট্র ক্ষমতা ত্যাগ করাটা একটি গণতান্ত্রিক আচরণ। আগেই বলেছি যেহেতু এই সরকার মোটেও গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না, তাই গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক আন্দোলন এরা যে কোনো উপায়ে দমন-পীড়নের মাধ্যমে প্রতিহত করবেই। এটাই অগণতান্ত্রিক স্বৈরাচারী একনায়কদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, এমনকি এই ভূখণ্ডেও অগণতান্ত্রিক স্বৈরাচারী একনায়কের পতন হয়েছে গণআন্দোলন এবং গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে, দাবিও আদায় করা হয়েছে গণআন্দোলনের মাধ্যমেই।
রাজনৈতিক নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন আর গণআন্দোলনে বিস্তর তফাৎ। রাজনৈতিক আন্দোলন হয় রাজনৈতিক দলের নীতিনির্ধারিত পন্থায় রাজনৈতিক নেতাদের নেতৃত্বে। আর গণআন্দোলন থেকে গণঅভ্যুত্থান হয় গণমানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে সাধারণ জনগণের নেতৃত্বে। রাজনৈতিক নেতারা পরে সেই আন্দোলনে সম্পৃক্ত হন, সেটাও ওই গণমানুষের চাপেই।
পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মুখের ভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য যে আন্দোলন, সেটার সূত্রপাত কোনো রাজনৈতিক দল বা নেতার মাধ্যমে হয়নি। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্র“য়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার পক্ষে মতামত দিয়েছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগের নেতারা। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের নিয়ে ভাষা মতিনের নেতৃত্বে ওই দিন ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হয়, বাকিটা ইতিহাস।
স্বৈরাচারী আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে যখন চূড়ান্ত আন্দোলন শুরু হয়, আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা তখন জেলে। ঊনসত্তরের সেই উত্তাল গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্বও দিয়েছিল ছাত্র-জনতা, এককথায় গণমানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের চাপেই রাজনৈতিক নেতারা আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন। আইয়ুব খানের পতন হয়েছিল।
একই ঘটনা ঘটেছিল ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে। সেই সময় শীর্ষ রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতা স্বাধীনতার কোনো ঘোষণা না দিয়ে পাকিস্তানিদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন আর বাকি নেতারা গিয়েছিলেন আত্মগোপনে। গণমানুষকে নিয়ে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন সেনাবাহিনী-ইপিআর-পুলিশ ও সর্বস্তরের সাধারণ জনতা। গণমানুষের নেতৃত্বে যুদ্ধ শুরুর কারণেই মুক্তিযুদ্ধকে বলা হয় ‘গণযুদ্ধ’। শহীদ জিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণার পর দেশের বিভিন্ন স্থানে গণযোদ্ধাদের প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরই রাজনৈতিক নেতারা চাপে পড়ে এই যুদ্ধের নেতৃত্ব দিতে বাধ্য হয়েছিলেন।
আবার যদি ’৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের কথা চিন্তা করা যায়, সেখানেও একই ঘটনা ঘটেছে। এরশাদের প্রতি দেশের মানুষের আস্থা এবং সমর্থন না থাকলেও আওয়ামী লীগের সঙ্গে আঁতাতের নির্বাচন করে ’৮৬ সালে সে একটা বৈধতা নেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু জনগণের বৈধতা সেটা ছিল না। বিএনপিসহ অন্যান্য সমমনা রাজনৈতিক দল আগাগোড়াই এরশাদবিরোধী আন্দোলন করে গেলেও ’৮৩ থেকে এরশাদবিরোধী আন্দোলন করে আসা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাই ’৯০ সালে ডা. মিলন হত্যার পর এরশাদবিরোধী চূড়ান্ত আন্দোলন গড়ে তোলে। সেই আন্দোলনের তীব্রতা ছড়িয়ে পড়ার পর অন্যান্য রাজনৈতিক দল আন্দোলনে সম্পৃক্ত হতে এগিয়ে আসে। বর্তমান স্বৈরাচারের মতো এরশাদেরও কৌশল ছিল রাজনৈতিক দলের নেতাদের হত্যা, দমন, নির্যাতন ও ভয়ভীতি দেখিয়ে বাগে রেখে আন্দোলনমুক্ত থাকা। যে কারণে গণআন্দোলনেই তাকে বিদায় নিতে হয়েছে।
এই অবৈধ সরকারের বিদায়ের জন্যও গণঅভ্যুত্থানমুখী গণআন্দোলন গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই। আমরা সবাই জানি একটি মধ্যপন্থী গণতান্ত্রিক দল হিসেবে বিএনপির বর্ষীয়ান ও সিনিয়র নেতারা ভদ্র প্রকৃতির। তবে অনেককেই সমালোচনা করতে শোনা যায়, হয়তো জেল-জুলুমের ভয়ে বা সহায়-সম্পত্তি হারানোর দুশ্চিন্তায় নেতারা কঠোর আন্দোলনে সম্পৃক্ত হতে দ্বিধা করছেন। অবশ্য স্বৈরাচারী হাসিনা সরকার যেভাবে পুলিশ-বিজিবি-র‌্যাব ব্যবহার করে সামান্য মৌন মিছিলেও বডিলাইনে গুলি করে মানুষ খুন করে, সারা দেশে প্রায় দশ লাখ রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের নামে পাইকারি হারে মামলা দিয়ে, একদিকে পুলিশ লেলিয়ে দিয়ে অন্যদিকে আদালতে দলীয় প্রভাব খাটিয়ে লক্ষাধিক রাজনৈতিক নেতাকর্মী জেলে পাঠিয়ে নির্যাতন করছে, তাতে রাজনৈতিক নেতাদের ভীত হওয়াটা কোনো অস্বাভাবিক বিষয় নয়।
তবে এ কথা সত্য, রাজনৈতিক দলের আন্দোলনকারীরাই এই সরকারের প্রতিরোধ ক্ষমতা অত্যন্ত দুর্বল করে দিয়েছে। গত বছর এই সময় যখন সরকারবিরোধী আন্দোলন চলছিল, তখনও এরা ১৪৪ ধারা জারি করেনি। কিন্তু এখন তারা বিরোধী দলের সভা-সমাবেশে ১৪৪ ধারা জারি করে সরকারবিরোধী গণতান্ত্রিক ও নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক আন্দোলন ঠেকাতে বাধ্য হচ্ছে। এর সহজ-সরল অর্থ হচ্ছে, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও পুলিশ লীগের সম্মিলিত শক্তি দিয়ে এখন আর সরকারবিরোধীদের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন মোকাবেলা করা যাচ্ছে না। আওয়ামী লীগ সরকার এখন ১৪৪ ধারার আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছে।
একটা কথা ভুলে গেলে চলবে না যে- ১৯৫২, ৬২, ৬৯, ৭১ এবং ৯০ সালেও আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছিল এবং সেই প্রতিটি আন্দোলনের শেষ সাফল্য কিন্তু এসেছিল ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেই। ব্রিটিশদের ১৪৪ ধারা, আইয়ুব খানের ১৪৪ ধারা, ইয়াহিয়ার ১৪৪ ধারা, এরশাদের ১৪৪ ধারা আর হাসিনার ১৪৪ ধারার মধ্যে কোনো পার্থক্যই নেই। তাই আন্দোলনে সফল হতে হলে এই ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করারও কোনো বিকল্প নেই। দেশের নিরংকুশ মানুষ এখন আওয়ামী লীগ সরকারের পতন দেখতে চায় এবং বিএনপিকে আন্দোলনের অগ্রভাগে দেখতে চায়। সাধারণ মানুষের ক্ষোভ যে পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, আন্দোলন সেই পর্যায়ে না দেখে ব্যাপক সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেছে জনগণের পাশাপাশি সাধারণ কর্মী ও সমর্থকরা। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সময়ের দাবিতে অতীতে বারবার সাধারণ কর্মী ও সমর্থকরা জনগণকে সঙ্গে নিয়ে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলেছে এবং স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়েছে। এবারের আন্দোলনও গণঅভ্যুত্থানে রূপ নিতে বাধ্য। অতীতের চেনা পথে সরকারের আন্দোলন দমনের চেষ্টা অব্যাহত থাকলে সময়ের প্রয়োজনে নতুন পথেই এবারের আন্দোলনে সাফল্য আসবেই বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।
যারা এই ক্রান্তিকালে সরকারবিরোধী দুর্বার আন্দোলন না করার কারণে বিএনপির সিনিয়র নেতাদের তীব্র সমালোচনা করছেন এবং বিরূপ মন্তব্য করছেন, তারাও এখন গণআন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে গণঅভ্যুত্থান ঘটাতে এগিয়ে আসতে পারেন। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে এগিয়ে আসতে পারেন বর্ষীয়ান রাজনৈতিক নেতাদের সামনে অতীতের দৃষ্টান্ত নতুন করে তুলে ধরতে। ’৫২ থেকে ’৯০ পর্যন্ত গণঅভ্যুত্থানের আলোতে জাতির বুকে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসা এই অবৈধ স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারকে সরানোর কাণ্ডারি হিসেবে পবিত্র দায়িত্ব পালন করতে। আন্দোলনের পথেই সব দ্বিধা, সংশয়, সন্দেহ, অবিশ্বাস পরাজিত হবে। দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বেই গণতন্ত্রের সংগ্রামে জাতি আবার বিজয়ী হবে ইনশাআল্লাহ।
শিমুল বিশ্বাস : বিএনপি চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী

No comments

Powered by Blogger.