নিজস্ব সংস্কৃতি চর্চায় জোর দিতে হবে : প্রধানমন্ত্রী

নিজস্ব সংস্কৃতি চর্চায় জোর দেয়ার পরামর্শ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আজকে জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। ধর্মের নামে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে। ধর্মের লেবাসধারীরা ধর্মীয় উপাসনালয়ে হামলা করছে। আমরা গত বছর দেখেছি, কিভাবে বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের চত্বরে পবিত্র কোরআন শরীফে আগুন দেয়া হয়। জাতীয় মসজিদ তছনছ করা হয়। একমাত্র আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যই পারে মানুষের এসব অমানবিক আচরণের পরিবর্তন আনতে। আমাদের শিল্পী-সাহিত্যিক, সংস্কৃতিসেবীদের এব্যাপারে আরও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। মানুষের মননে মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত করতে হবে। গতকাল বিকালে রাজধানীতে জাতীয় জাদুঘর মিলনায়তনে জাতীয় পর্যায়ে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে দেশের প্রতিটি মানুষ বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে বাঙালির চিরায়ত ঐতিহ্য অনুযায়ী পহেলা বৈশাখ উদযাপন করে আসছে। অন্যদিকে সকল ধর্মের মানুষ একসঙ্গে তাদের ধর্মীয় উৎসব পালন করে আসছে। এটি একটি ঐক্যবদ্ধ আস্থার প্রমাণ। বাঙালি জাতি এটি সম্ভব করে তুলেছে এবং বিশ্বে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। বছরব্যাপী শিল্পাচার্যের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের অংশ হিসেবে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার এবং শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের সহধর্মিণী জাহানারা আবেদীনও বক্তৃতা করেন। এতে জয়নুল আবেদিন স্মারক বক্তব্য রাখেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর। স্বাগত বক্তব্য দেন সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব রঞ্জিত কুমার বিশ্বাস। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাঙালি সংস্কৃতির প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অসাম্প্রদায়িকতা। ধর্ম-বর্ণ ভেদাভেদ ভুলে মানুষে মানুষে মিলন হবে-এটাই বাঙালি সংস্কৃতির মূল কথা। আজকে মাঝে মধ্যে নিজের মনেই প্রশ্ন জাগে, বাঙালি জাতি কি তার সংস্কৃতির মূলধারা থেকে বিচ্যুত হচ্ছে। তিনি বলেন, সকল শিল্পকর্মই যে লোক ঐতিহ্যের ধারায় প্রবাহিত হয় তার বাস্তব রূপায়নই আজকের ঐতিহাসিক সোনারগাঁয়ের বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন। জয়নুল আবেদিন ছিলেন সাধারণ আটপৌরে মানুষের শিল্পী। সাধারণ মানুষের জীবনচিত্র, দুঃখবেদনা ছিল এই মহান শিল্পীর ছবির উপজীব্য। তিনি একাধারে ছিলেন নিঃসর্গ প্রেমিক, অন্যদিকে তার রঙ-তুলিতে ফুটে উঠেছে দ্রোহের ভাষা। প্রধানমন্ত্রী বলেন, কাকতালীয় হলেও আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবনের সঙ্গে শিল্পী জয়নুল আবেদিনের অনেক মিল খুঁজে পাই আমরা। দুজনেরই জন্ম গ্রামে। ছাত্রাবস্থার একটা সময় তাদের কেটেছে ময়মনসিংহে। আমাদের জাতীয় কবি এবং শিল্পাচার্য তৎকালীন পিজি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় একই বছর অর্থাৎ ১৯৭৬ সালে মারা যান। দুজনকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে সমাহিত করা হয়। তিনি বলেন, একজন শব্দের কারুকার্যের মাধ্যমে অন্যায়-অবিচারের প্রতিবাদ করেছেন। অন্যজন রঙ-তুলির আঁচড়ে সামাজিক-অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং বঞ্চনাকে তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন, শিল্পাচার্যের ৪৩’র দুর্ভিক্ষের ছবিগুলো মানুষের অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশা তুলে ধরার পাশাপাশি তৎকালীন বৃটিশ রাজের এদেশের মানুষের প্রতি চরম অবহেলা এবং মানুষের দুর্দশা লাঘবের ব্যর্থতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল। তিনি বলেন, একইভাবে ১৯৭০ সালে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে মহাপ্রলয়ের পর বঙ্গবন্ধু যেমন ছুটে গিয়েছিলেন দুর্গত মানুষের পাশে, শিল্পী জয়নুল আবেদিনও সেদিন ঘরে বসে থাকতে পারেননি। তিনিও ত্রাণসামগ্রী নিয়ে দুর্গত এলাকায় ঘুরে বেড়িয়েছেন। সেখান থেকে ফিরে শিল্পী আঁকলেন তার বিখ্যাত ছবি ‘মনপুরা-৭০’। ৩০ ফুট দীর্ঘ এই শিল্পকর্মে শিল্পী সাইক্লোনের ভয়াবহতা ফুটিয়ে তোলার পাশাপাশি বাঙালির ঘুরে দাঁড়ানোর দৃঢ়চিত্তের ইঙ্গিতও তুলে ধরেন।

No comments

Powered by Blogger.