জিহাদ ট্রাজেডি by ড. মাহবুব উল্লাহ্

অপঘাতে মৃত্যু যেন এ দেশের মানুষের নিয়তি হয়ে গেছে। প্রখ্যাত সাংবাদিক নির্মল সেন বাংলাদেশ সৃষ্টির অব্যবহিত পর লিখেছিলেন, স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই। কিন্তু স্বাধীনতার ৪৩ বছরেও স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি হয়নি। স্বাভাবিক মৃত্যুর পাশাপাশি অস্বাভাবিক মৃত্যুও বেড়ে চলেছে। এরকম মৃত্যু হয় কখনও ক্রসফায়ারে, কখনও গুম হওয়ার মধ্য দিয়ে, কখনও পুলিশি হেফাজতে, কখনও মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায়, কখনও লঞ্চডুবিতে, আবার কখনও রাজনৈতিক সহিংসতা ও দুর্বৃত্তপনায়। দেশে আইনের শাসন থাকলে এমন মর্মান্তিক মৃত্যু একেবারে নিশ্চিহ্ন না হয়ে গেলেও প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে আসত। আমরা স্বাধীন রাষ্ট্র পেয়েছি। কিন্তু সুশাসন পাইনি। পাইনি মানবাধিকার তো দূরের কথা, তিনটি স্বাভাবিক অধিকার। এই স্বাভাবিক অধিকারগুলো হল- আইন ও বিচারবহির্ভূত হত্যা থেকে বেঁচে থাকার অধিকার, বৈধ পন্থায় অর্জিত সহায়-সম্পদ রক্ষার অধিকার এবং স্বাধীন নাগরিকের মৌলিক অধিকার। এ অধিকারগুলোকেই সংক্ষেপে লাইফ, লিবার্টি অ্যান্ড প্রোপার্টি বলে চিহ্নিত করেছিলেন পাশ্চাত্যের এক দার্শনিক।
এগুলো শুধু পাশ্চাত্য দর্শনের কথাই নয়, এগুলো আমাদের ধর্মীয় বিধিবিধানেরও অবিচ্ছেদ্য অংশ। এসব অধিকার না থাকলে মনুষ্যত্বে ও পশুত্বে কোনো পার্থক্য থাকে না। দাস সমাজে মানুষকে ভারবাহী পশুর মতোই গণ্য করা হতো। আফসোস, আজও আমরা দাস যুগের বর্বরতা থেকে মুক্ত হতে পারিনি। এ জন্যই কি আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম? এজন্যই কি শতপ্রাণ বলিদান করেছিল? ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে আমাদের রাজনৈতিক নেতারা জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে গিয়ে বলতেন, কোনো শাসক স্বেচ্ছায় মানুষকে অধিকার দেয় না, অধিকার ছিনিয়ে আনতে হয়। এর জন্য প্রয়োজন হয় বিপুল আত্মত্যাগের। ব্রিটিশ শাসনের অন্তিমলগ্নে ভারতব্যাপী বিক্ষুব্ধ মানুষের অশান্ত উত্তাল ঢেউয়ের গর্জন শুনে কবি কিশোর সুকান্ত লিখেছিলেন, অবাক পৃথিবী অবাক করলে তুমি / জন্মেই দেখি ক্ষুব্ধ স্বদেশভূমি / অবাক পৃথিবী অবাক যে বারবার / দেখি এই দেশে মৃত্যুরই কারবার। সুকান্তের এই কবিতা বঙ্গদেশে বহু কণ্ঠে আবৃত্ত হয়েছে। কবিতাটি গান হিসেবেও পরিবেশিত হয়েছে। ইংরেজ গেল, পাকিস্তানিরাও গেল, এখন তো আমরাই আমাদের দেশ চালাই। কিন্তু অবাক হওয়ার পালা শেষ হল না। একে কী বলব? এটা কি আমাদের জাতীয় দুর্ভাগ্য! রবিঠাকুর লিখেছিলেন, হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাহাদের তুমি করিয়াছো অপমান / অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান। আমরা উত্তরোত্তর অপমানের শিকার হচ্ছি। কিন্তু যারা আমাদের অপমান করছে তারা অপমানিতদের কাতারে এসে দাঁড়িয়েছে এমনটি ঘটতে কদাচই দেখা যায়। অন্যায়, অপমান, দুরাচার, নিষ্ঠুরতা ও নির্যাতন আমাদের নিত্য সঙ্গী হয়ে পড়েছে। আমরা প্রতিবাদে কুণ্ঠিত। আমাদের শোধ-বোধও নেই। নির্বাক, নিরুত্তর থাকাতেই আমরা নিরাপদ বোধ করি। আমরা যে এসব বুঝি না তা নয়। কিন্তু আমাদের উপলব্ধির চেতনা থেকেও আত্মসংরক্ষণের চেতনা অনেক বেশি প্রখর। আমরা এখন বিশ্রী রকমের স্বার্থপর হয়ে গেছি। চাচা আপন প্রাণ বাঁচা- এটাই আমাদের টিকে থাকার কৌশলে পরিণত হয়েছে। তা না হলে অজস্র অন্যায় ও অবিচারের মধ্যেও আমরা কীভাবে কিছু হয়নি, কিছু ঘটেনি এমন ভাব করতে পারি। আমরা সবাই যেন আধমরা হয়ে গেছি। কিন্তু এ আধমরাদের ঘা মেরে বাঁচানোর জন্য তরুণরা কই? আমার এই অনুভূতির সঙ্গে অনেকেই হয়তো একমত হবেন না। তারা বলবেন, খণ্ড বিচ্ছিন্নভাবে প্রতিবাদ তো হচ্ছে। যেমনটি হয়েছে নারায়ণগঞ্জে। এ সপ্তাহে হল শাহজাহানপুর রেলওয়ে কলোনিতে। এ ধরনের প্রতিবাদ প্রদীপের দপ করে জ্বলে ওঠার পর নিভে যাওয়ার সঙ্গেই তুলনীয়। তাই এসব থেকে স্থায়ী ফল আসে না। সমগ্র দেশবাসী এক প্রাণ একাট্টা হয়ে যদি প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠত, তাহলে কিছু ফল পাওয়া যেত। কিন্তু তা তো হচ্ছে না। অনেকেই বলবেন, এরকম বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত প্রতিবাদ থেকে বৃহত্তর প্রতিবাদের জন্ম হবে। জনগণের পুঞ্জীভূত ক্রোধ, হতাশা এবং বেপরোয়া মনোভাব হয়তো একদিন একটি বড় বিক্ষোভের জন্ম দেবে। কিন্তু এরকম কিছু ঘটা সম্ভব নাও হতে পারে। ইতিহাসে এমন দৃষ্টান্তও বিরল নয়। ফিলিপাইনের মার্কোস, ইন্দোনেশিয়ার সুহার্তো, চিলির পিনোশে, স্পেন ও পর্তুগালের ফ্রাংকো ও সালাজারের শাসন মানুষ চোখ বুজে বহু বছর সহ্য করেছে। মনে হয়, রাতের অন্ধকার মাত্র নেমেছে। প্রভাতি সূর্যের জন্য দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। এমন হতাশা প্রকাশ ছাড়া কি-ই বা করার আছে! তারুণ্যে দুঃসাহসী প্রতিবাদী ছিলাম। পাকিস্তানি শাসনের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে আমার কণ্ঠ থেকে আগুন ঝরত। স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলার কর্মসূচি (২২ ফেব্র“য়ারি ১৯৭০) উত্থাপন করার অপরাধে সামরিক আদালতে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে আমার বিচার হয়েছিল। সামরিক আদালত আমাকে সশ্রম কারাদণ্ড এবং ১৫ বেত্রদণ্ডের সাজা দিয়েছিল। কোর্ট দারোগা এ শাস্তির কথা শুনে আমাকে ক্ষমা ভিক্ষার জন্য পরামর্শ দিয়েছিলেন। আমি ঘৃণা ভরে সেই পরামর্শ প্রত্যাখ্যান করেছিলাম। তখন তিনি আমাকে বলেছিলেন, আপনি কি বোঝেন বেত্রদণ্ডের পরিণতি কী? আমি বলেছিলাম, পরিণতি সম্পর্কে আমার জানা আছে। ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসনের পর ময়মনসিংহের কমরেড কাজী আবদুল বারীকে বেত্রদণ্ড দেয়া হয়েছিল। এর ফলে তিনি চিরজীবনের জন্য শ্রবণশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন। কারোর কারোর ক্ষেত্রে পরিণতি আরও ভয়াবহ হয়। যেমন কিডনি বিকল হয়ে যাওয়া কিংবা পঙ্গু হয়ে যাওয়া। পাকিস্তানে জিয়াউল হকের সামরিক শাসনামলে শত শত ব্যক্তির বিরুদ্ধে বেত্রদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল। এসব বেত্রদণ্ড দেয়া হতো খোলা মাঠে। জনসমক্ষে। মানুষকে ভীতসন্ত্রস্ত করে তোলাই ছিল এর উদ্দেশ্য।
আমি আমার নিজের কথা বলছিলাম। জীবনের অনেকগুলো বছর পার হয়ে এসে মনে হয় আমার সত্তারও পরিবর্তন হয়েছে। আমি আর ষাটের দশকের মতো প্রতিবাদী নই। বয়স, রোগ-শোক ও পারিবারিক দুর্যোগে হতাশা আমাকে ঘিরে ধরেছে। আরও হতাশ হই এ কথা ভেবে, সব পরিবর্তনই শুভ নয়। কোনো কোনো পরিবর্তনের মধ্যে অনেক অশুভ লুকিয়ে থাকে। তাই আশা করব আগামীর পরিবর্তন যেন নতুন ধরনের অশুভের জন্ম না দেয়। এটুকু আশা নিয়ে শত হতাশার মধ্যেও বেঁচে থাকতে চাই।
গত শুক্রবার দুপুরের খাবার খেয়ে শিশু জিহাদ মায়ের কোলেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। মাও ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। কিছুক্ষণ পর জিহাদ ঘুম থেকে জেগে উঠে তার খেলার সাথীদের সঙ্গে খেলাধুলা করতে বাইরে বেরিয়ে যায়। সেখানে ছোটাছুটি করতে গিয়ে সে একপর্যায়ে একটি পরিত্যক্ত ঢাকনাবিহীন গভীর নলকূপের মধ্যে পড়ে যায়। নলকূপটির ব্যাস ছিল ১৭ ইঞ্চি। নলকূপটি ছিল ৩০০ ফুট গভীর। অর্থাৎ ৩০০ ফুট গভীরেই সে পড়ে গিয়েছিল। ওই সময় তার মানসিক অবস্থা কী দাঁড়িয়েছিল তা বর্ণনাতীত। তার খেলার সাথীরা খবর দিল সে নলকূপের মধ্যে পড়ে গেছে। প্রাথমিকভাবে স্থানীয়রা নলকূপের গভীরে রশি ঢুকিয়ে জিহাদকে উদ্ধারের চেষ্টা করে। কিন্তু অত লম্বা রশি না থাকায় সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়। প্রায় আধঘণ্টা পর ফায়ার সার্ভিসের ৩টি দল ঘটনাস্থলে এসে নলকূপ থেকে জিহাদকে উদ্ধারের চেষ্টা চালায়। অত্যাধুনিক সব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে ওয়াসা ও ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে উদ্ধার অভিযানে অংশ নেয়। রাত ৯টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের লোকেরা শিশুটির কান্নার আওয়াজও শুনেছে। তাদের ডাকে সাড়াও দিয়েছে। রাত ১১টার দিকে বুয়েটের একটি প্রতিনিধি দল ঘটনাস্থলে আসে। প্রায় একই সময়ে ওয়াসার একটি দল ঘটনাস্থলে এসে নিজেদের মধ্যে বৈঠক করে। ওয়াসা এবং বুয়েট ও প্রতিনিধি দলের পরামর্শের পর লোহার তিনটি পাইপ একত্র করে ক্যাচার তৈরি করে পাইপের ভেতরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। ওই ক্যাচারের মুখে ওয়াসার জন্য সদ্য আমদানি করা শক্তিশালী বোর হোল ক্যামেরা স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু সদ্য আমদানি করা ক্যামেরাটি প্রস্তুত করতে এক ঘণ্টারও বেশি সময় ব্যয় হয় বিশেষজ্ঞদের। ওই সময় ওয়াসার পক্ষ থেকে বলা হয়, অত্যাধুনিক ওই ক্যামেরাটি দুই হাজার বর্গফুট পর্যন্ত এলাকায় ঘুরে ঘুরে ছবি এবং শব্দ পাঠাতে সক্ষম। সর্বশেষ রাত ১টায় ক্যামেরাসহ বিশেষভাবে তৈরি ক্যাচার পাইপের ভেতরে প্রবেশ করানো হয়। রাত পৌনে তিনটার দিকে ক্যামেরার ছবি মনিটরে ভেসে ওঠে। এতে একটি পুরনো স্যান্ডেল, কিছু মরা তেলাপোকা ও টিকটিকি আর একটি রশির ছবি ভেসে ওঠে। তবে পানির পাইপটির গভীরতা প্রায় ৭০০ ফুট বলা হলেও ক্যামেরাসহ ক্যাচারটি পাইপের ভেতরে ২৮০ ফুট পর্যন্ত গেছে বলে বিশেষজ্ঞরা জানান। এর নিচেই ছিল ময়লা আবর্জনার স্তূপ। প্রায় আধঘণ্টা পর্যবেক্ষণের পর ঘটনাস্থলে উদ্ধার কাজ তদারকিতে থাকা স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল রাত সোয়া তিনটার দিকে সাংবাদিকদের জানান, পাইপের ভেতর শুধু জীবিত নয়, মৃত কোনো মানুষের অস্তিত্ব মেলেনি। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর ওই বক্তব্যের পর অভিযানের সমাপ্তি ঘোষণা করা হচ্ছে কি-না সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পাইপের ভেতর থাকা ময়লা তুলে ফেলার পর আমরা আরেকবার দেখব। তবে আমরা নিশ্চিত, পাইপের ভেতর কোনো মানুষ নেই। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর চলে যাওয়ার পর ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানান, ওই ময়লা-আবর্জনা তুলে আনার পর আরেক দফা উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করা হবে। মূলত তখন থেকেই উদ্ধার অভিযানে শিথিলতা লক্ষ্য করা যায়। শনিবার সকাল থেকে ফায়ার সার্ভিস ও ওয়াসার সমন্বয়ে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে দ্বিতীয় দফায় উদ্ধার অভিযান শুরু হয়। টানা কয়েক ঘণ্টা অভিযানের পর দুপুর আড়াইটার দিকে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার আহাম্মদ আলী ঘটনাস্থলে সংবাদ সম্মেলন করেন। সংবাদ সম্মেলনে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্ধার অভিযান স্থগিত ঘোষণা করেন। এর পরই শুরু হয় স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবীদের উদ্ধার অভিযান। অভিযান পরিত্যক্ত ঘোষণার ১৫ মিনিটের মধ্যেই তারা শিশু জিহাদকে পাইপের ভেতর থেকে অচেতন অবস্থায় বের করে আনেন। জিহাদকে উদ্ধারের পর ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের হাতেই তুলে দেন স্বেচ্ছাসেবীরা। শিশুটিকে উদ্ধারে খাঁচার মতো নিজস্ব বিশেষ ধরনের জাল বা ক্যাচার ব্যবহার করেন বলে স্বেচ্ছাসেবীরা জানান। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পর চিকিৎসকরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জিহাদকে মৃত বলে ঘোষণা করেন।
সবচেয়ে মর্মান্তিক বিষয় হল, শিশুটি উদ্ধারের আগ পর্যন্ত শাহজাহানপুর থানা জিহাদের বাবাকে বারো ঘণ্টা আটকে রাখে। এমনকি কোথায় জিহাদকে লুকিয়ে রাখা হয়েছে, সে বিষয়ে জানাতে তাকে উল্টো ভয়ভীতিও দেখানো হয়। র‌্যাবের হাতে তুলে দেয়ারও ভয় দেখানো হয়। জিহাদের বাবার এ অবর্ণনীয় দুরবস্থা দেখে মনে হয় তার সন্তান দুর্ঘটনায় পড়ে যাওয়াতে তিনি বড় অপরাধ করে ফেলেছেন। এ যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের একটি প্রবণতা হচ্ছে সবকিছুর মধ্যেই ষড়যন্ত্র ও নাশকতার গন্ধ খুঁজে পাওয়া। ইচ্ছাকৃত নয় এমন দুর্ঘটনার জন্যও ষড়যন্ত্র তত্ত্ব আবিষ্কার করা হয়। দেশের ১৬ কোটি উদ্বিগ্ন মানুষের জন্য স্বস্তির বিষয় হল শেষ পর্যন্ত জনউদ্যোগেই মৃত জিহাদকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব। উন্মোচিত হয়েছে ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার কুটিল চেষ্টা। নিশ্চয়ই ঊর্ধ্বতন কোনো মহল থেকে স্থানীয় পুলিশকে এ আচরণ করতে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছিল। পুরো আচরণটি নার্ভাসনেসেরই বহিঃপ্রকাশ। ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক সেনাদের ওপর নির্দেশ ছিল, Shoot at any moving particle অর্থাৎ নড়ছে-চড়ছে এমন কোনো ধূলিকণার ওপরও গুলি চালাতে হবে। শুকনো পাতার মর্মর ধ্বনি শুনলেও তার ওপর গুলি চালাতে হবে। মার্কিনিরা ভিয়েতনামেও একই পদ্ধতি অনুসরণ করেছিল। ভিয়েতনামের জঙ্গলে ভিয়েতকংরা (ভিয়েতনামের মুক্তিযোদ্ধা) বন-জঙ্গলের মধ্যে কোথাও জড়ো হলে সেখানকার বাতাসে কার্বন-ডাইন-অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার তত্ত্বের ওপর নির্ভর করে সেই জায়গাটি চিহ্নিত করার জন্য স্যাটেলাইট প্রযুক্তি ব্যবহার করা হতো। সে রকম আভাস পেলে সেখানে মার্কিন বি-৫২ বোমারু বিমান থেকে বোমা বর্ষণ করা হতো। এতে দক্ষিণ ভিয়েতনামের বনভূমির বিপুল ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু ভিয়েতকংদের তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। এ ধরনের মানসিকতা যে নার্ভাসনেস থেকে সৃষ্টি হয়, তার মূলে রয়েছে ক্ষমতায় টিকে থাকার ব্যাপারে আস্থার অভাব। সরকার কি সেই আস্থা শূন্যতায় ভুগছে? এর কারণ কি ৫ জানুয়ারির প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন?
যাই হোক, শিশু জিহাদের ট্রাজেডি থেকে আমরা যা শিখলাম তার সারকথা হল, শাহজাহানপুরের ঢাকনাবিহীন নলকূপের মতো অজস্র মৃত্যুফাঁদ সারা দেশে ছড়িয়ে আছে। এসব মৃত্যুফাঁদ তৈরি হয়েছে উন্নয়ন কাজের নামে। এসব মৃত্যুফাঁদ থেকে দুর্ঘটনা রোধে কোনো প্রতিরোধক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় না। এটা রাষ্ট্রীয় দায়িত্বহীনতা। এর জন্য ক্ষতিগ্রস্ত নাগরিক যথাযোগ্য ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারে। দাবি করতে পারে দায়িত্ব পালনে অবহেলাকারীদের কঠোর শাস্তির। ঐতিহাসিকভাবে এ দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীরা সত্য ধামাচাপা দিয়ে থাকেন। কিন্তু সত্য সত্যই। সত্য আপন গৌরবে উদ্ভাসিত হয়। কোনো রকম অস্বীকৃতি সত্যকে চাপা দেয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। ভারতের এক সময়কার রেলমন্ত্রী এবং পরবর্তীকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী একটি রেল দুর্ঘটনার দায় নিয়ে পদত্যাগ করেছিলেন। অথচ রেল দুর্ঘটনার জন্য তিনি কোনোক্রমেই সরাসরি দায়ী ছিলেন না। আমাদের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল যদি লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর দৃষ্টান্ত অনুসরণ করেন, তাহলে সেটা কি তার দলের জন্য ভালো হবে না? জনাব কামাল ভেবে দেখবেন।
ড. মাহবুব উল্লাহ : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক

No comments

Powered by Blogger.