বাংলাদেশে অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ব্যবসা, নির্বিকার প্রশাসন -আল জাজিরার প্রতিবেদন

অপহরণের পাঁচদিন পর সিরাজগঞ্জের ডোবায় পাওয়া গিয়েছিল ছয় বছর বয়সী শিশু হারুন-উর রশিদের নিথর দেহ। তার শরীর থেকে কিডনি কেটে নেয়া হয়েছে। হারুন বাংলাদেশের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়ে অবৈধ ব্যবসার শিকার। হারুনের বাড়ি তেবারিয়া গ্রামে। গত ২২শে এপ্রিল সে নিখোঁজ হয়ে যায়। এরপরই তার পিতা কর্তৃপক্ষকে জানান। পুলিশ এক সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে। সে জানায়, এক ব্রিজের নিচে নেয়ার আগে হারুনকে নেশাজাত দ্রব্য দিয়ে অচেতন করা হয়েছিল। ব্রিজের নিচে অপেক্ষা করছিল ঢাকা থেকে যাওয়া তিন ব্যক্তি। সন্দেহভাজন ওই ব্যক্তি জানায়, ব্রিজের নিচেই এক সার্জন হারুনের অপারেশন করে কিডনি সংগ্রহ করে। বাংলাদেশে মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিয়ে ভয়াবহ এক ব্যবসার একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে আল জাজিরায়। সেখানে তুলে ধরা হয়েছে এ সব কাহিনী। হারুনের পিতা আবদুল হান্নান বলেন, ঘটনার পাঁচ দিন পর পুলিশ জানায়, আরেক গ্রামের পাশে তারা হারুনের মৃতদেহ খুঁজে পেয়েছে। আমি গিয়ে দেখি তার পিঠ কেটে রাখা হয়েছে। তিনি বলেন, হারুন হাসিখুশি এক শিশু ছিল। আমার মন কাঁদছে। আমি কি বলবো? আমি যদি আমার হৃদয়টা দেখাতে পারতাম, তবে হয়তো আপনি আমার অবস্থা বুঝতে পারতেন। তারা আমার পরিবার আর আমার সুখ ধ্বংস করে দিয়েছে। বাংলাদেশের অত্যন্ত দরিদ্র এলাকা তেবারিয়ার মানুষরা অত্যন্ত দরিদ্রতার মধ্যে বসবাস করেন। অনেকে আইনের শাসন না থাকাকে দায়ী করছেন। অকার্যকর ও দুর্নীতিপরায়ণ কর্তৃপক্ষের কারণে হারুনের মতো এ গ্রামের ১৫ শিশু হারিয়ে গেছে। এব্যাপারে মন্তব্য জানতে চাইলে ঢাকার পুলিশ অস্বীকৃতি জানায়। হারুনকে অপহরণের দায়ে তিন ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কিন্তু ঢাকার মূল সিন্ডিকেটের ব্যাপারে কোন অভিযানের কথা শোনা যায়নি। গ্রামের দরিদ্র মানুষরা মামলার খরচ চালাতে পারেন না। হারুনের পিতা আবদুল হান্নান বলছিলেন, তিনি এ কারণেই কোন মামলা করতে পারেন নি। তাছাড়া, তিনি নিশ্চিত ছিলেন তার শিশুর হত্যাকারীরা শাস্তি পাবে না। মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির নৃতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক মনির মনিরুজ্জামান ১২ বছর ধরে বাংলাদেশের গরিব মানুষের মাঝে এ ব্যবসার প্রভাব নিয়ে গবেষণা করছেন। তবে কেবল অপহরণ করে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনাই যে ঘটে তা নয়- অনেকে স্বেচ্ছায় নিজের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রি করেন। স্থানীয় দালালদের মাধ্যমে বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রি করে দেয়া হয়। এরপর ওই দালালরা স্থানীয় ও ঢাকার সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সেসব অঙ্গ ক্রেতার কাছে বিক্রি করে। আইন প্রয়োগের অভাবে দরিদ্র মানুষদের টাকা দিয়ে তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়ে যেতে পারে দালালরা। মনিরুজ্জামান বলেন, যদি সরকারের কাছ থেকে সত্যিকার উদ্বেগ দেখা যেতো, তাহলে হয়তো আমরা কিছু পদক্ষেপ দেখতে পেতাম। কিন্তু আমরা তেমন কিছু দেখি নি। আইনের প্রয়োগ হচ্ছে না। এছাড়া, বিচার ব্যবস্থার দুর্বলতায় অনেক মামলাই দুর্বল হয়ে যায়। ভারত সীমান্তবর্তী জয়পুরহাট জেলায় মানব প্রত্যঙ্গ পাচারের ঘটনা উদ্‌ঘাটিত হয়। পুলিশ স্থানীয় দালালদের আটক করে। এছাড়া, ঢাকা ভিত্তিক সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধেও তদন্ত শুরু করে। পরে জানা যায় অর্ধশতাধিক মানুষ তাদের লিভার বা কিডনি বিক্রি করে দিয়েছেন। সেবার এ ঘটনা বেশ আলোচনার জন্ম দেয়। কিন্তু স্থানীয় দালালদের আটকের মাধ্যমেই সব কিছুর সমাপ্তি ঘটে। মনিরুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশের ওই দালাল ও ভারতে তাদের নেটওয়ার্ক খুঁজে বের করে পুলিশ দারুণ কাজ করেছে। কিন্তু ওই দালালরা প্যারোলে মুক্তি পেয়ে আবারও অপকর্মে যুক্ত হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। ধারণা করা হচ্ছে, দালালরা নির্বিঘ্নে ব্যবসা চালানোর জন্য পুলিশ কিংবা স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে ঘুষ দেয়। এব্যাপারে বেশ কয়েকবার অনুরোধ করলেও দুর্নীতির অভিযোগ ও প্রত্যঙ্গ ব্যবসা নিয়ে কোন মন্তব্য করতে রাজি হয়নি পুলিশ। মূলত ঋণে জর্জরিত হতদরিদ্র মানুষকে সহজে টাকা আয়ের প্রলোভন দেখিয়ে এ কাজ করে দালালরা। অনেকের সঙ্গে আবার প্রতারণাও করা হয়। জয়পুরহাটের ঘটনায় দেখা গেছে, ভুক্তভোগীদের নকল পাসপোর্ট, পরিচয়পত্র ও অন্যান্য জিনিসপত্র দিয়ে ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর প্রত্যঙ্গ দাতা ও গ্রহীতার মধ্যে পারিবারিক সমপর্ক প্রমাণের জন্য নকল দলিল সরবরাহ করা হয়। এরপর কলকাতাতেই হয়ে যায় অপারেশন। মনিরুজ্জামানের মতে, জয়পুরহাটের ঘটনা কেবল একটি চক্রের কাজকেই নির্দেশ করে। তবে দেশব্যাপী এ ধরনের চক্র সক্রিয় এবং এ ধরনের অবৈধ ব্যবসা চলমান। এসব দালালের বিশাল নেটওয়ার্কও রয়েছে। কিন্তু সরকারি কর্তৃপক্ষ বা পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয় না। এব্যাপারে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মন্তব্য চেয়েও পাওয়া যায় নি। সেসব দালালের বিরুদ্ধে পুলিশের নিষ্ক্রিয় ভূমিকার ব্যাপারে কেবল নীরব ক্ষোভ গ্রামবাসীর মাঝে। তাদের মতে, পুলিশ যদি পদক্ষেপ নিতো, তাহলে মানুষ এখনও নিজেদের প্রত্যঙ্গ বিক্রি করে কিভাবে? কিংবা শিশুদের অজ্ঞান করে প্রত্যঙ্গ কেটে নেয়ই বা কিভাবে? অনেক মানুষ বাচ্চাদের নিজেরাই স্কুলে নিয়ে যান। সামান্য সময়ের জন্য সন্তানদের একা ছাড়তে ভয় পান তারা। আবদুল হান্নান নিজের একমাত্র ছেলে হারুনকে হারানোর পর কন্যাকে নিয়েও একই ভয়ে ভীত।

No comments

Powered by Blogger.