ট্রেন-কাভার্ড ভ্যান সংঘর্ষ, নিহত ৬

(কমলাপুর কনটেইনার ডিপোতে স্টেশনমুখী একটি ট্রেনের সঙ্গে কাভার্ড ভ্যানের সংঘর্ষ (ডানে), নিহতের এক স্বজনের কান্না (বাঁয়ে) -নিজস্ব ছবি) কমলাপুর কনটেইনার ডিপোতে স্টেশনমুখী একটি ট্রেনের সঙ্গে কাভার্ড ভ্যানের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছে ৬ জন। নিহতরা হলেন- নাঈম ইসলাম (১৬), মজিবুর রহমান (৬০), আলমগীর হোসেন (৪৫), অজ্ঞাত আরও ৩ জন। এরমধ্যে দু’জন পুরুষ, একজন মহিলা। এছাড়া, আহত হয়েছেন অন্তত অর্ধশত ট্রেনযাত্রী। এর মধ্যে গুরুতর আহত ১৪ জনকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ঘটনার পরপরই দুর্ঘটনাস্থলে ছুটে যান রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক। ঘটনা তদন্তে রেলওয়ের বিভাগীয় পরিবহন কর্মকর্তা নাজমুল হাসানকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে আগামী তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শী ও ট্রেনযাত্রীরা জানান, গতকাল দুপুরে নারায়ণগঞ্জ থেকে একটি লোকাল ট্রেন কমলাপুর রেল স্টেশনে যাচ্ছিল। দুপুর ১২টা ৫০ মিনিটে ট্রেনটি স্টেশনের পাশের কনটেইনার ডিপোতে ঢুকে পড়ে। এসময় ডিপোর পশ্চিম পাশের এসএম কার্গো সার্ভিসেস লিমিটেডের একটি কাভার্ড ভ্যান (ঢাকা মেট্রো ট-১১-৮৮৫৪) ঘোরানোর জন্য রেললাইনের ওপর তুলে দেয়। এতে ট্রেনের ইঞ্জিনের পরের বগিতে সজোরে ধাক্কা লাগে। কাভার্ড ভ্যানের সামনের অংশ ট্রেনের বগির ওপর উঠে যায়। কাভার্ড ভ্যানের সামনের অংশসহ ট্রেনের ওই কামরাটি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে একদিকে হেলে পড়ে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের ৯টি ইউনিট ঘটনাস্থলে গিয়ে আটকে পড়া যাত্রীদের উদ্ধার করে। এসময় ট্রেনের বগির ভেতর থেকেই একজনের লাশ উদ্ধার করা হয়। এছাড়া, কাভার্ড ভ্যানের ইঞ্জিনের অংশ থেকে চালকের সহযোগীর লাশ উদ্ধার করা হয়। চালকের ওই সহযোগীই কাভার্ড ভ্যানটি চালাচ্ছিল। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, দুর্ঘটনার পরপরই কামরার ভেতরে আটকেপড়া যাত্রীরা চিৎকার করতে থাকে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীসহ ট্রেনের অন্য কামরার যাত্রীরা তাদের উদ্ধারের চেষ্টা চালায়। ট্রেনের জানালা ও দরজা দিয়ে আটকে পড়া যাত্রীদের বের করে আনা হয়। হরতাল থাকায় ট্রেনটি যাত্রীতে ঠাসা ছিল। আটকে পড়া যাত্রীদের উদ্ধারের পর গুরুতর আহতদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আরও চার জন নিহত হন। ট্রেন-কাভার্ড ভ্যান সংঘর্ষের পর ঘটনাস্থলে ছুটে যান রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক, রেল পুলিশের ডিআইজি মল্লিক ফখরুল ইসলামসহ রেলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। ঘটনাস্থলে রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক বলেন, কাভার্ড ভ্যানটির চালক হয় নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছিল, নয়তো তার গাফিলতির কারণে দুর্ঘটনাটি ঘটেছে। দুর্ঘটনার কারণ খতিয়ে দেখতে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। মাসুদ নামে এক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, তিনি ডিপোর ভেতরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। নারায়ণগঞ্জ থেকে একটি ট্রেন আসছিল। অপরদিকে পশ্চিম পাশের কাভার্ড ভ্যানটি পূর্বদিকে যাচ্ছিল। কাভার্ড ভ্যানটি ট্রেন লাইনের উপরে চলে আসলে ট্রেনের সঙ্গে ধাক্কা লাগে। এ সময় কাভার্ড ভ্যানের সামনের অংশ এবং ট্রেনের ইঞ্জিনের  পেছনের বগিটি আঘাতে হেলে যায়। প্রত্যক্ষদর্শী শিশু আল আমিন জানায়, গেণ্ডারিয়া থেকে ট্রেনে উঠেছিল সে। কমলাপুর আসার সঙ্গে সঙ্গে একটা ট্রাক ট্রেনের উপরে চলে আসে। কাশেম নামে ট্রেনের ইঞ্জিনের পেছনের বগির ছাদে থাকা এক যাত্রী বলেন, ট্রেনটি যখন স্টেশনের আগে কনটেইনার ডিপোতে ঢোকে, কাভার্ড ভ্যানটি তখন পশ্চিম থকে পূর্বের দিকে যাচ্ছিল। গতিও খুব বেশি ছিল না। কিন্তু ট্রেন দেখেও চালক না থামিয়ে এগিয়ে গেলে প্রথমে ইঞ্জিনের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় এবং কাভার্ড ভ্যানটি ঘুরে গিয়ে ইঞ্জিনের পেছনের বগিতে সজোরে আঘাত করে। ওই অবস্থায় লরিটি প্রায় ২০ গজ ছেঁচড়ে নিয়ে ট্রেনটি থেমে যায়। ডিপোর ভেতরে দাঁড়িয়ে থাকা মিজান নামে এক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, ট্রেন আসতে দেখে ডিপোর আনসার সদস্যরা কাভার্ড ভ্যান চালককে থামার সঙ্কেত দিয়েছিলেন। কিন্তু চালক না থামিয়ে ট্রেন লাইন পার হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। এরপর চোখের পলকে দুর্ঘটনা ঘটে যায়। তিনি বলেন, ইঞ্জিনের সঙ্গে সংঘর্ষের পর লরিটি ছিটকে এসে ধাক্কা দিলে পেছনের বগিটি কাত হয়ে লাইনে পড়ে যায়। ওই অবস্থায় ট্রেন আরো এগিয়ে যাওয়ায় কাভার্ড ভ্যানের চেসিস পুরো ভেঙেচুরে যায় এবং ট্রেনের বগির একপাশ ভেঙে দুমড়ে যায়। আইসিডি এলাকা ঘুরে দেখা যায়, পুরো আইসিডির মাঝ বরাবর দিয়ে রেল লাইন। পূর্ব ও পশ্চিম পাশে মালামাল লোড করার জন্য কাভার্ড ভ্যানগুলো অবস্থান করে। কখনো পূর্ব পাশে আবার কখনো পশ্চিম পাশে মালামাল লোড করা হয়। দুই পাশে লোহার গেট থাকার কথা থাকলেও কোন পাশেই পুরো লোহার গেট ছিল না। দুই পাশেই  অল্প একটু লোহার গেট ছিল। লোহার গেট না থাকার কারণে কাভার্ড ভ্যানটি রেল লাইনের উপরে ওঠে যায় বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন। এছাড়া, কাভার্ড ভ্যানটি চালক না চালিয়ে তার সহযোগী চালাচ্ছিল। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক আনসার বলেন, দীর্ঘ দিন ধরে গেটটি নেই। গেটটি থাকলে হয়তো আজ এ ঘটনা ঘটতো না। কমলাপুর রেলওয়ে থানার ওসি আবদুল মজিদ জানান, ঘটনাস্থলেই দুই জনের মৃত্যু হয়েছে। হাসপাতালে পাঠানোর পর আরো চার জনের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় রেলওয়ের সিনিয়র উপ-সহকারী প্রকৌশলী আব্দুল মতিন মণ্ডল বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেছেন। এদিকে হাসপাতাল সূত্র জানায়, দুর্ঘটনার পর দুপুরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ১৫  জনকে ভর্তি করা হয়। এর মধ্যে চারজনকে মৃত ঘোষণা করে হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসকরা। দুর্ঘটনাস্থলে ও হাসপাতালে নিহতদের সবার লাশ ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে পাঠানো হয়েছে। বর্তমানে ঢাকা মেডিক্যালে আরো এগারো জন ভর্তি আছেন। তারা হলেন- বাবুল হোসেন (৪৩), নাসির হোসেন (৩০),  গোলাম মোস্তফা (২৫), বিল্লাহ (২৭), অজ্ঞাত পুরুষ (৪০), দিলদার (৪০), জাবেদ আলী (৪০), মিজানুর রহমান (৩০), হারুনুর রশীদ হারুন (৪০), সাবের হোসেন (৩৫), সুমন (৩৫)। আহতদের মধ্যে নাসির, গোলাম  মোস্তফা, অজ্ঞাত পুরুষসহ তিনজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাদের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) পাঠানো হয়েছে। আহত সুমন জানান, তিনি নারায়ণগঞ্জের পাগলা এলাকায় থাকেন। পেশায় বাসের হেলপার। ডিউটি করার জন্য তিনি নারায়ণগঞ্জের ওই লোকাল ট্রেনে করে ঢাকায় আসছিলেন। ওই ট্রেনের ইঞ্জিনের তৃতীয় বগির দরজার সামনে তিনি বসা ছিলেন। কমলাপুর রেলস্টেশন কাছাকাছি হওয়ায় ট্রেনের গতি কম ছিল। ট্রেনটি যখন কনটেইনার ডিপো পার হচ্ছিল এসময় একটি কনটেইনারবাহী কাভার্ড ভ্যান ট্রেনের দ্বিতীয় বগিকে ধাক্কা দেয়। এতে ওই বগির অধিকাংশ যাত্রীসহ আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা পথচারীরা আহত হন। আমি আতঙ্কে ট্রেনের দরজা দিয়ে লাফ দেয়ায় কোমরে এবং বাম পায়ে আঘাত পাই। আহত গোলাম মোস্তফা জানান, তিনি দুর্ঘটনাকবলিত দ্বিতীয় বগিতে ছিলেন। বগিতে তিলধারণের ঠাঁই ছিল না। অনেকে ঝুলেও ছিলেন। ওই বগির কম বেশি সবাই আহত হয়েছেন। ওই ট্রেনের যাত্রী রেলওয়ের কর্মচারী ওয়েম্যান এনামুল হক জানান, তিনি ওই ট্রেনের পেছনে বসা ছিলেন। ট্রেনটির গতি কম হওয়ায় বগিটি হেলে যায়। অনেক যাত্রী আতঙ্কে লাফিয়ে পড়েন। নিহত নাঈম ইসলামের খালু আব্দুর রশিদ জানান, নাঈমের পিতার নাম ইউনুস আলী। তার গ্রামের বাড়ি বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ থানার খোদাবকশকাটি এলাকায়। সে স্থানীয় নেসারিয়াবাদ এলাকার একটি আলিয়া মাদরাসার নবম শ্রেণীর ছাত্র। তিনি আরো বলেন, গত ১০ দিন আগে নাঈম গ্রামের বাড়ি থেকে তাদের বাড়ি ঢাকার কমলাপুরে আসে। সে আমাদের বাড়িতেই ছিল। নিহত মজিবুরের স্ত্রী সকিনা বেগম জানান, তার স্বামী মিরপুরের শেয়ালবাড়ির ৭ নম্বর রোডের ১৪ নম্বর বাড়িতে পরিবারের সঙ্গে থাকতেন। ব্যানারের কাঠির ব্যবসা করতেন। তিনি বলেন, গতকাল ভোর সাড়ে ৫টায় তিনি নারায়ণগঞ্জে মাল সরবরাহ করতে যান। পরে সেখান থেকে ট্রেনে ফেরার পথে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে মারা যান। তাদের সংসারে এক ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে। মজিবুরের পিতার নাম আবদুল হক। তাদের গ্রামের বাড়ি মুন্সীগঞ্জের লৌহজং এলাকায়। এদিকে দুর্ঘটনার পর ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বিকাল পাঁচটার দিকে উদ্ধারকাজ শেষ হলে এ রুটে আবার ট্রেন চলাচল শুরু হয়।

No comments

Powered by Blogger.