নিজেরাই নিজেদের প্রতিপক্ষ by লুৎফর রহমান

আলোচিত জাতীয় নির্বাচনের পর এক বছর পার করেছে আওয়ামী লীগ। নির্বাচন নিয়ে শুরুতে অস্বস্তি থাকলেও বছরজুড়ে দলীয় কোন্দল আর নেতাদের লাগামহীন বক্তব্যই বেশি অস্বস্তি দিয়েছে ক্ষমতাসীন দলকে। ছাত্রলীগ ও দলের অন্য অঙ্গসংগঠনের অভ্যন্তরীন দ্বন্দ্বে এক বছরে দেড় শতাধিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। বিদায়ী বছরে সরকারবিরোধী তেমন কোন আন্দোলন না থাকায় অনেকটা নির্বিঘ্নে কেটেছে ক্ষমতাসীন দলের সময়। টানা দ্বিতীয় দফা সরকার গঠনের পর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল দল গোছানোকে গুরুত্ব দেয়া হবে নতুন বছরে। এ জন্য বেশ কয়েক দফা চেষ্টাও করা হয়। দলের কার্যনির্বাহী সংসদের একাধিক বৈঠকে দল গোছানোর লক্ষ্যে সারা দেশে তৃণমূল সংগঠনের কাউন্সিল সম্পন্ন ও কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। গত এক বছরে এ কার্যক্রম কিছুটা এগোলেও অনেক জেলায়ই এখনও কাউন্সিল এবং কমিটি গঠনের কাজ শেষ হয়নি। বছর শেষে সম্মেলন হয়েছে বেশ কয়েকটি জেলায়। দলের কেন্দ্রীয় নেতারা সফর করেছেন জেলায় জেলায়। যদিও সম্মেলন করার দীর্ঘ সময় পরও কমিটি গঠন করতে পারেনি ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ। সাংগঠনিক ব্যর্থতা সঙ্গে দলের নেতাদের অথিকথন ও বিতর্কিত মন্তব্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল ক্ষমতাসীন দলের জন্য। জাতীয় নির্বাচনের পর ছয় ধাপে অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনও আওয়ামী লীগের জন্য ছিল বড় অস্বস্তির কারণ। এ নিয়ে প্রথম দুই ধাপে দল সমর্থিত প্রার্থী ব্যাপকহারে পরাজিত হওয়ায় অস্বস্তি দেখা দেয় ক্ষমতাসীনদের মধ্যে। পরবর্তী ধাপগুলোতে দলের প্রার্থীরা ভাল করলেও কেন্দ্র দখল, জালিয়াতি ও সন্ত্রাসের কারণে ব্যাপক সমালোচনা হয় দেশে এবং বিদেশে। এছাড়া দলীয় কোন্দলে খুনোখুনি নেতায় নেতায় দ্বন্দ্বই ছিল আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ। নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুনের ঘটনা বছরের শুরুতেই দলের জন্য এক খারাপ বার্তা বয়ে নিয়ে আসে। এ ঘটনায় দলের স্থানীয় নেতা নুর হোসেন খুনের পরিকল্পনা করেন এবং র‌্যাব ১১-এর তৎকালীন প্রধান তারেক সাঈদ পুরো জড়িত ছিলেন যিনি নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার জামাতা। এ ঘটনায় দলের ভেতরে এবং বাইরে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়। একই ঘটনায় নারায়ণগঞ্জের আরেক আলোচিত নেতা শামীম ওসমানের নাম আলোচনায় থাকায় এটিও অস্বস্তির কারণ হয় আওয়ামী লীগের জন্য। এক হিসেবে দেখা যায় গত দুই মাসেই সরকারি দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষে কমপক্ষে ২৫ জন নিহত হয়েছেন। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, দখলবাজি, মাদক ব্যবসার ভাগবাটোয়ারার কারণে এসব খুনোখুনির ঘটনা ঘটে। গত ২০শে মে ফেনী শহরে প্রকাশ্যে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা একরামুল হক একরামকে। এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের ফেনী সদর আসনের সংসদ সদস্য নিজাম হাজারীর সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ ওঠে। ঘটনার তদন্ত শেষে পুলিশ যে চার্জশিট দিয়েছে তাতে নিজাম হাজারীর নাম না থাকলেও চার্জশিটভুক্ত বেশির ভাগ আসামিই আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী। গত ১৫ই জানুয়ারি যশোরের বেলতলা এলাকায় সন্ত্রাসীদের গুলি ও বোমা হামলায় নিহত হন শহর যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রফিকুল ইসলাম শিপন। এ মামলায় জেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি ফয়সাল খানসহ ১০ জনকে আসামি করে মামলা হয়েছে। গত বছরের ২৯শে জুলাই রাজধানীর গুলশানে গুলি করে হত্যা করা হয় ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক রিয়াজুল হক খান মিল্কীকে। এই ঘটনার সঙ্গে সরাসরি জড়িত একই সংগঠনের নেতা জাহিদ সিদ্দিকী তারেকসহ দু’জন র‌্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত হন। তদন্ত শেষে এই ঘটনায় তারেক ছাড়া আরও ১১ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দেয় র‌্যাব। এর মধ্যে বেশির ভাগই ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী। এদের মধ্যে যুবলীগ নেতা সাখাওয়াত হোসেন চঞ্চল বিদেশে পলাতক ও মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপু কারাগারে। অন্যরা অনেকেই জামিনে রয়েছেন। বর্তমানে মামলাটির অধিকতর তদন্ত  করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি। গত নির্বাচনের পর লক্ষ্মীপুরে নিহত হয়েছেন চরশাহী আওয়ামী লীগ সভাপতি আবদুল মান্নান ভূঁইয়া, রায়পুর পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগ সাধারণ সম্পাদক আবদুল মজিদ, ভাঙ্গাখা ইউনিয়ন যুবলীগ কর্মী রিপন হোসেন, বসিকপুর যুবলীগ নেতা রোমান হোসেন, রামগঞ্জ যুবলীগ নেতা সাইফুল ইসলাম, চন্দ্রগঞ্জ বসুদহিতা ছাত্রলীগ কর্মী মামুন হোসেন, চন্দ্রগঞ্জে ছাত্রলীগের দুই কর্মী রবিউল ইসলাম শিমূল এবং ফরহাদ হোসেন মামুন। তাদের মধ্যে ফরহাদ হোসেন মামুনকে নৃশংসভাবে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে। স্থানীয় আওয়ামী লীগের দ্বন্দ্ব-বিবাদ এবং এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা থেকেই এসব ঘটনা ঘটেছে। দলীয় কোন্দলের কারণে নোয়াখালীর চাটখিলে ১৬ই মার্চ চাটখিল পৌর ছাত্রলীগ নেতা আল-আমিন প্রথমে অপহরণ ও পরে গুলিতে নিহত হন। ৭ই মে অপহরণের পর খুন হন যুবলীগ নেতা শুভঙ্কর চন্দ্র কুঁড়ি। ২৬শে এপ্রিল  যশোরের বেনাপোলে পাল্টাপাল্টি হামলায় খুন হন যুবলীগের দুই কর্মী পুটখালীর ইমান আলী ও উত্তর বারোপোতা এলাকার লালন। এসব হত্যাকাণ্ডের পেছনে দলীয় নেতারাই জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ এসেছে। আর এসব ঘটনার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিচার নিয়ে সন্তুষ্ট নন ভুক্তভোগীরা।  এদিকে বছরের শুরু থেকে নানা বিতর্কে জড়ায় আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ। নিজেদের মধ্যে মারামারির ঘটনায় প্রাণ গেছে কয়েকজনের। দফায় দফায় বন্ধ হয়েছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়। ছাত্রলীগের কোন্দলের কারণে এখনও বন্ধ রয়েছে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। ঐতিহ্যবাহী এ ছাত্রসংগঠনের কর্মীরা নানা সময়ে জড়িয়েছেন বিতর্কিত বিভিন্ন কাণ্ডে। কখনও অস্ত্র হাতে অ্যাকশন, কখনও নিজেদের কর্মীকে খুন করে আলোচনায় এসেছে এ সংগঠনের নাম। আওয়ামী লীগের জন্য বছরজুড়ে বড় অস্বস্তি ছিল দলীয় নেতাদের অতিকথন ও বিতর্কিত মন্তব্য। আওয়ামী লীগ সরকারের আগের মেয়াদের মন্ত্রী একে খন্দকারের লেখা ‘১৯৭১: ভেতরে বাইরে’ গত ৩রা সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে তা নিয়ে তুমুল আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। বইয়ে তিনি লিখেছেন, ১৯৭১ সালের ৭ই  মার্চ বঙ্গবন্ধু তার ভাষণ শেষ করেছিলেন ‘জয় পাকিস্তান’ বলে। আর সশস্ত্র যুদ্ধের কোন প্রস্তুতি  ছিল না রাজনৈতিক নেতৃত্বের। এ বই নিয়ে সংসদ ও সংসদের বাইরে ব্যাপক সমালোচনা হয়। তার এ বই প্রকাশের পর আওয়ামী লীগ নেতারা মুক্তিযুদ্ধের এ সেক্টর কমান্ডারকে রাজাকার বলেও মন্তব্য করেন। ঘরে বাইরে সমালোচনা থাকলেও শেষ পর্যন্ত নিজের অবস্থানেই অনড় আছেন মুক্তিযুদ্ধের উপ-অধিনায়ক। এদিকে একে খন্দকারের বই বিতর্ক কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই হজ, মহানবী সা. ও তাবলীগ জামাত নিয়ে বেফাঁস মন্তব্য করে হঠাৎ সবকিছু এলোমেলো করে দেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কের এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘আমি কিন্তু হজ আর তাবলীগ জামাতের ঘোরতর বিরোধী, আমি জামায়াতে ইসলামীর যতোটা বিরোধী তার চেয়ে তাবলীগ জামাতের ঘোরতর বিরোধী। এই হজে যে কত ম্যানপাওয়ার নষ্ট হয়, হজের জন্য ২০ লাখ লোক আজ সৌদি আরবে গেছে, এদের কোন কাম নেই, এদের কোন প্রডাকশন নেই, শুধু রিডাকশন দিচ্ছে, শুধু খাচ্ছে আর দেশের টাকা দিয়ে আসছে। এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর পুত্র সজিব ওয়াজেদ জয়ের বিরুদ্ধে কথা বলেন তিনি। গত ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক আছে দেশে বিদেশে। চলছেও এ বিতর্ক। এরই মধ্যে নয়া বিতর্ক হাজির করেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য ও প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচটি ইমাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ আয়োজিত অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, নির্বাচনের সময় (৫ জানুয়ারির নির্বাচন) আমি তো প্রত্যেকটি উপজেলায় কথা বলেছি, সব জায়গায় আমাদের যারা রিক্রুটেড, তাদের সঙ্গে কথা বলে, তাদেরকে দিয়ে মোবাইল কোর্ট করিয়ে আমরা নির্বাচন করেছি। তারা আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে, বুক পেতে দিয়েছে।’ ওই সময় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘তোমাদের লিখিত পরীক্ষায় ভাল করতে হবে। তার পরে ‘ভাইভাটা’ আমরা দেখবো।’ এইচটি ইমামের এমন বক্তব্যের পর দলের ভেতরে-বাইরে শুরু হয় তুমুল সমালোচনা। ক্ষোভ প্রকাশ করেন খোদ প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। এ নিয়ে সরাসরি ক্ষোভ প্রকাশ করেন সিনিয়র নেতারা। তার এ বক্তব্য প্রকাশের পর বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয় এইচটি ইমামের বক্তব্যের মাধ্যমেই ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের প্রকৃত চিত্র উঠে এসেছে। বিএনপির এক নেতা এইচটি ইমামকে নিজেদের লোক বলেও দাবি করেন। যদিও এইচটি ইমাম সংবাদ সম্মেলন করে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করার চেষ্টা করেন। সম্প্রতি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম খুলনায় এক অনুষ্ঠানে মার্কিন সহকারী  পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়াল এবং বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন দূত ড্যান মজিনাকে নিয়ে তাচ্ছিল্য করে বক্তব্য রাখেন। তার এ বক্তব্যে কূটনৈতিক অঙ্গন ও রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক আলোচনা হয়। মার্কিন মন্ত্রীকে দুই আনার মন্ত্রী ও মজিনাকে কাজের মেয়ে মর্জিনা উল্লেখ করে সৈয়দ আশরাফের বক্তব্য সব ধরনের শিষ্টাচার বর্জিত বলে দলের নেতারাই এর সমালোচনা করেন। তার এ বক্তব্য দিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে দলের হাইকমান্ডও। ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে চলে আসা টানাপড়েনের মধ্যে তার এ বক্তব্য আওয়ামী লীগের জন্য বড় ক্ষতির কারণ হয়েছে বলেও মনে করছেন অনেকে। এদিকে দলের প্রবীণ নেতা সমাজকল্যাণমন্ত্রী সৈয়দ মহসিন আলী একটি সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রকাশ্যে ধূমপান করে বেশ সমালোচিত হন। আরেক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের উদ্দেশ্য করে তিনি বিতর্কিত মন্তব্য করেন। তার এ বক্তব্য প্রচারের পর সারা দেশে ব্যাপক সমালোচনা হয়। বছরজুড়ে এমন সব বিতর্ক আর নেতিবাচক কমকাণ্ড দলকে বারবার বিব্রত করলেও দলের নেতারা মনে করছেন বড় দল হিসেবে ছোটখাত ঘটনা ঘটতেই পারে। তবে দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ঠিক পথেই এগোচ্ছে। দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য নুহ উল আলম লেনিন জানিয়েছেন, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব বিচ্ছিন্ন ঘটনা। আওয়ামী লীগ দল হিসেবে লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, দলের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে কিছুটা স্থবিরতা থাকলেও তা কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করা হচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.