ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে অর্থনীতি

উচ্চ সুদ ও বেপরোয়া সার্ভিস চার্জ আঘাত করছে বিনিয়োগে। দীর্ঘ সময় ধরে দেশে বিনিয়োগ হচ্ছে না, ঋণ সরবরাহ কমে গেছে, রফতানি আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে, রেমিটেন্স প্রবাহ কমে গেছে, বাজারে কমেছে ডলারের সরবরাহ। সার্বিক অর্থনীতিতে পড়তে শুরু করেছে এসবের দুষ্ট প্রভাব। এই অবস্থা দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকলে দেশের অর্থনীতি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে গিয়ে দাঁড়াবে বলে আশংকা করেছেন উদ্যোক্তারা। সরকারের পক্ষ থেকে বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য নানা উদ্যোগ নেয়ার কথা বলা হলেও বাস্তবে কোনো কিছুই করা হচ্ছে না। সরকারের নীতিনির্ধারকদের কথা কাগজে-কলমেই থেকে যাচ্ছে। তা আলোর মুখ দেখছে না। ফলে ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডেও গতি আসছে না। উদ্যোক্তারা বলেছেন, অর্থনীতিকে গতিশীল করতে হলে সবার আগে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। বিনিয়োগ অর্থনীতিতে ‘রক্ত সঞ্চালনের’ ভূমিকা পালন করে। বিনিয়োগ বাড়ানো না গেলে অর্থনীতিতে গতি আসবে না। এর জন্য ঋণের খরচ কমাতে হবে। ঋণের সুদের হার কমাতে হবে। ব্যাংকগুলোর মাত্রাতিরিক্তি সার্ভিস চার্জের লাগাম টেনে ধরতে হবে। অবকাঠামোগত সমস্যার সমাধান ও এগুলোর ফি কমাতে হবে। এসব ব্যাপারে শিল্পবান্ধব পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলা হলেও বাস্তবে তার কিছুই হচ্ছে না।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, এর নেপথ্যে রয়েছে দেশ ও সরকারের বিরুদ্ধে গভীর যড়যন্ত্র। কেননা ঋণের সুদের হার ও সার্ভিস চার্জ কমলে দেশে বিনিয়োগ বাড়বে, শিল্প স্থাপন হবে। কর্মসংস্থান বাড়বে। দেশের উন্নতি হবে। কিন্তু একটি চক্র চায় না দেশের উন্নয়ন হোক। এ কারণে তারা চায় ব্যাংকের উচ্চ সুদের হার, সার্ভিস চার্জ না কমুক। যারা সরকারকে এসব বিষয়ে পরামর্শ দিচ্ছে তারা কেউ শিল্পপতি নয়। ফলে তারা শিল্প খাতের সমস্যাগুলো সম্পর্কে জানে না বা জেনেও না বোঝার ভান করে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের অর্থনীতি।
উদ্যোক্তারা বলেছেন, সরকারের উপদেষ্টারা বাস্তব অর্থনীতি সম্পর্কে অবহিত নন। তারা নিজেদের বুদ্ধিমান দাবি করেন। কিন্তু বাস্তব অর্থনীতির জ্ঞান তাদের নেই। এছাড়া তাদের অনেকে ভিন্ন দেশের স্বার্থ সংরক্ষণে তৎপর। এ কারণে দেশের অর্থনীতির অগ্রগতির পথে বাধাকে আরও জোরদার করতে তৎপর থাকে। তাদের মতে, ঋণ নিয়ে ব্যাংকের ভেতরে-বাইরে ব্যাপক দুর্নীতি হয়। এই দুর্নীতির কারণে ব্যাংকের খরচ বেড়ে যাচ্ছে। ফলে প্রকৃত উদ্যোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে দেশের অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে যাবে।
চাহিদা অনুযায়ী টাকার সরবরাহ কম : বাজারে টাকার চাহিদা আছে কিন্তু সরবরাহ নেই। অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যেও যেসব উদ্যোক্তা চলমান প্রকল্পের জন্য ঋণ নিতে চান তাদের চাহিদা অনুযায়ী ঋণের জোগান দেয়া হচ্ছে না। ফলে সেসব উদ্যোক্তাও নতুন করে টাকার সংকটে ভুগছেন। এতে শিল্পের বিকাশ যেমন ব্যাহত হচ্ছে, তেমনি অর্থনৈতিক অগ্রগতিও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঋণের প্রবাহ বেড়েছে মাত্র ২ দশমিক ৯ শতাংশ। আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৩ শতাংশের বেশি। গত অর্থবছরে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ বেড়েছিল প্রায় সাড়ে ১২ শতাংশ।
একদিকে বিনিয়োগ না হওয়ায় বাজারে ঋণের চাহিদা বাড়ছে না। অন্যদিকে যারা ঋণ নিতে চাচ্ছেন তারা চেয়েও পাচ্ছেন না। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকিং খাতে ঘটে যাওয়া জালজালিয়াতির কারণে ব্যাংকাররা এখন ঋণ দিতে অনেক সতর্ক। যে কারণে এখন অনেক ভালো উদ্যোক্তাও ঋণ পাচ্ছেন না। ব্যাংক কর্মকর্তাদের সহায়তায় ঘটা জালজালিয়াতির দায় পড়ছে ভালো উদ্যোক্তাদের ঘাড়ে। ভালো গ্রাহক হিসেবে পরিচিত উদ্যোক্তারাও ঋণ নিতে গেলে ব্যাংকগুলো বিমাতাসুলভ আচরণ করছে।
এলসি নিচ্ছে না ব্যাংক : ব্যাংকগুলোতে ফান্ডেড ঋণ বিতরণে নানা বিধিনিষেধ আরোপিত থাকলেও নন-ফান্ডেড ঋণে বিধিনিষেধ অনেক শিথিল। ব্যাংকের মূলধনের ২০ শতাংশ নন-ফান্ডেড বা এলসিতে বিনিয়োগ করার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু তারপরও ব্যাংকগুলো বর্তমানে এলসি খোলার পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে। গত অর্থবছরে আমদানি খাতে ব্যয় বেড়েছিল প্রায় ১৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবরে এলসি খোলা বেড়েছে ১২ শতাংশ এবং আমদানি ব্যয় বেড়েছে ১১ শতাংশ। সাম্প্রতিক সময়ে এটির প্রবৃদ্ধি আরও কমেছে। গত আগস্টে এলসি খোলা বেড়েছিল ২৭ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে তা কমে দাঁড়ায় প্রায় ১৮ শতাংশ। অক্টোবরের হিসাবে এই হার আরও কম হতে পারে। একই সময়ে এলসির দেনা পরিশোধের পরিমাণও কমেছে। গত আগস্টে এলসির দেনা পরিশোধ বেড়েছিল সাড়ে ৩৮ শতাংশ। গত সেপ্টেম্বরে এসে তা কমে দাঁড়ায় মাত্র ৯ শতাংশে। আমদানি খাতে এলসি খোলার পরিমাণ কমে যাওয়ায় সামনের দিনগুলোতে আমদানির পরিমাণও কমে যাবে। এর মধ্যে বেশির ভাগই হচ্ছে শিল্পের যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল। এসব পণ্যের আমদানি কমলে শিল্প খাতে নেতিবাচক প্রভাব আরও প্রকট হবে।
বিনিয়োগ হচ্ছে না : ব্যাংকের উচ্চ সুদসহ ১১ কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বিনিয়োগ। আশানুরূপ হারে বাড়ছে না দেশী বিনিয়োগ। মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে বিদেশী বিনিয়োগকারীরাও। এসব প্রতিবন্ধকতা দূর করতে পলিসি পর্যায় থেকে বড় ধরনের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না। অন্যদিকে বিনিয়োগ না থাকায় দেশে কর্মসংস্থানের পথ রুদ্ধ হচ্ছে।
বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়ছে বলে জানিয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, বিদেশে টাকা পাচারের সব পথ বন্ধ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। তিনি ধারণা করছেন, টাকা পাচারের কারণেই বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ কমছে।
সূত্র জানায়, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ না থাকা, ঋণের অপ্রাপ্যতা, ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদের হার, অবকাঠামো নির্মাণের অনুমতি না পাওয়া, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, কর প্রদান, বিদেশে টাকা পাচার, বৈদেশিক বাণিজ্য ও সম্পত্তি নিবন্ধন জটিলতা, অসচ্ছলতা ও চুক্তির বাস্তবায়ন জটিলতা বিনিয়োগের সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে কাজ করছে।
বিনিয়োগের অন্যতম সূচক হচ্ছে বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ। বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থা (আইএফসি) তাদের গবেষণা রিপোর্টে বলেছে, বিদ্যুৎ সংযোগ পাওয়ার ক্ষেত্রে বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ অবস্থান হচ্ছে বাংলাদেশের। বিদ্যুৎ সংযোগ পেতে বিশ্বের অন্য কোনো দেশে এত হয়রানি ও বিলম্ব হয় না। পাশাপাশি বিনিয়োগের জন্য ব্যাংক ঋণ প্রাপ্যতার ক্ষেত্রে অবনতি হয়েছে। উদ্যোক্তারা প্রত্যাশা অনুযায়ী ঋণ পাচ্ছে না। ব্যাংক ঋণ পেতে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। ব্যাংক ঋণ না দেয়ার প্রমাণ পাওয়া যায় ঋণের প্রবৃদ্ধি থেকে। ব্যাংক ঋণের অপ্রাপ্যতার সঙ্গে যোগ হয়েছে ঋণের উচ্চ সুদ। এই অতিমাত্রার সুদের হার বিনিয়োগের সবচেয়ে বড় অন্তরায় হিসেবে কাজ করছে। এই উচ্চ সুদ নিয়ে বিনিয়োগ করে উদ্যোক্তারা লাভবান হচ্ছেন না। ফলে নতুন করে ব্যাংক ঋণ নিয়ে বিনিয়োগে যাচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা।
বিনিয়োগের আরেক বড় বাধা হচ্ছে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা। গত বছর রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণেও বিনিয়োগ কমেছে।
বিদেশে টাকা পাচারের পথ তৈরি হওয়ায় বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কমছে এমন আভাস দিয়েছে খোদ অর্থমন্ত্রী। সরকার মনে করছে, বিশ্বের অনেক দেশে টাকা চলে যাওয়ায় বিনিয়োগ বাড়ছে না। গ্লোবাল ফিনান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) তথ্য মতে, ২০১১ সালে ১১৬ কোটি ৮০ লাখ ডলার, ২০১০ সালে ২১৯ কোটি ১০ লাখ ডলার ও ২০০৯ সালে ১০৩ কোটি ৪০ লাখ ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে। এছাড়া ২০০৮ সালে ১৭ কোটি ৯০ লাখ ডলার, ২০০৭ সালে ২৫৮ কোটি ৮৩ লাখ টাকা, ২০০৬ সালে ২৬৪ কোটি ৮০ লাখ ডলার ও ২০০৫ সালে ৬৪ কোটি ৪০ লাখ ডলার সমপরিমাণের অর্থ দেশ থেকে পাচার হয়েছে। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, এই টাকা পাচারের কারণে সম্প্রতি বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কমেছে।
এদিকে ব্যবসা-বাণিজ্য সংক্রান্ত যে কোনো চুক্তি বাস্তবায়ন করতে বাংলাদেশে গড়ে ৪১টি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হয় এবং এক হাজার ৪৪২ দিন পর্যন্ত লেগে যায়। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান এ ক্ষেত্রে তলানিতে। এটি একটি বড় প্রতিবন্ধকতা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে। এছাড়া দেশে কোনো উদ্যোক্তা যদি সম্পত্তি নিবন্ধন করতে চান, সেখানে নানা ভোগান্তি পোহাতে হয়। দক্ষিণ এশিয়ার অন্য কোনো দেশে এ ধরনের ভোগান্তি নেই। একজন উদ্যোক্তার সম্পত্তি নিবন্ধন করতে আটটি ধাপ সম্পন্ন করতে হয়। এতে সময় লাগে ১৪৪ দিন।
সুদ ও সার্ভিস চার্জ কমছে না : সরকারের কথা ও কাজে মিল নেই। উন্নয়ন ও বিনিয়োগ বাড়াতে ব্যাংক ঋণের সুদের হার ১০ শতাংশের নিচে অর্থাৎ সিঙ্গেল ডিজিটে নামানোর সুপারিশ করেছে অর্থ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। ওই বৈঠকে অর্থমন্ত্রী ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর উপস্থিত ছিলেন। সেখানে তারা সুদের হার কমানোর ব্যাপারে একমত পোষণ করেন। কিন্তু বাস্তবে এখনও সুদের হার কমছে না। সরকারি ব্যাংকগুলো খুবই সামান্য কমালেও বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে সুদের উচ্চ হার বিরাজ করছে। পাশাপাশি মাত্রাতিরিক্ত সার্ভিস চার্জ আদায় করা হচ্ছে।
স্থায়ী কমিটির বৈঠকে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘আমানতের সুদের হার অনেক বেশি। এটা কমানো উচিত। মূল্যস্ফীতির সঙ্গে এর সমন্বয় থাকা একান্ত প্রয়োজন। দেশে একটি স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক রেট অবশ্যই প্রতিষ্ঠা করা দরকার। কিছু ক্ষেত্রে সমস্যা হলেও সার্বিক বিবেচনায় বর্তমান ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনা ভালো। তবে ব্যাংকিং কার্যক্রম যাতে আরও একটু ভালো করা যায় সেজন্য দক্ষতা বৃদ্ধির প্রচেষ্টা নেয়া দরকার।’
এদিকে সংসদীয় কমিটি মনে করছে, বিনিয়োগ ও উন্নয়নের সবচেয়ে বড় অন্তরায় ঋণের উচ্চ সুদের হার। এই বাস্তবতা অনুভব করে অর্থমন্ত্রীও মনে করেন, দেশে একটি স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক ঋণের সুদ প্রতিষ্ঠা করা দরকার। বৈঠকের কার্যবিবরণীর সিদ্ধান্তে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়, দেশের উন্নয়নের স্বার্থে বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য বিদ্যমান ব্যাংক ঋণের সুদের হার ১০ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে হবে। অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এগুলো এখনও শুধু কথার মধ্যে রয়েছে। কাজে প্রমাণ নেই। এই বিলম্বের কারণে উচ্চ সুদের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ায় অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি হুমকির মুখে পড়ছে। মুখ থুবড়ে পড়েছে শিল্প খাতে বিনিয়োগ। অস্বাভাবিক চড়া সুদে বিনিয়োগকারীরা ঋণ নিতে মুখ ফিরিয়ে নেয়ায় ব্যাংকিং খাতও অচলপ্রায়। ব্যবসা-বাণিজ্যের এই বন্ধ্যত্বে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে বেকারত্ব দূর করার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্র“তিও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
এদিকে ব্যাংকগুলো ঋণের উচ্চ সুদের নামে মহাজনী ব্যবসায় লিপ্ত রয়েছে। একদিকে চড়া সুদ, অন্যদিকে ৩ মাস পরপর ঋণের সঙ্গে সুদ যোগ করে মূল ঋণের পরিমাণ বাড়ানো হচ্ছে। ফলে বেড়ে যাচ্ছে ঋণের অংক। ঋণের বিপরীতে আবার নেয়া হচ্ছে নানা নামে সার্ভিস চার্জ ও কমিশন। এসব কিছু ঋণের সুদের হার আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে ব্যাংকগুলোর ঘোষিত সুদের হার ১৪ থেকে ১৭ শতাংশ বেড়ে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে ২২ থেকে ২৪ শতাংশে। এদিকে ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদের আগ্রাসী থাবায় আক্রান্ত দেশের সার্বিক অর্থনীতি। এর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ায় অর্থনীতির বহুমুখী ক্ষতি হচ্ছে। উচ্চ সুদের কারণে, শিল্পায়ন ব্যাহত হলে তা ভবিষ্যৎ অর্থনীতির জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন। এছাড়া মাত্রাতিরিক্ত সুদের কারণে পণ্যের উৎপাদন খরচও বেড়ে যায়। যার প্রভাবে বেড়ে যায় পণ্যমূল্য। আর এই সুযোগে নিুমানের ও কম মূল্যের পণ্য আমদানি করে দেশের বাজারে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। মার খাচ্ছে উঁচু মানের দেশীয় পণ্য।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সরকারি গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প তিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক এমকে মুজেরি যুগান্তরকে বলেন, ব্যাংক ঋণের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিট হলে বিনিয়োগ উৎসাহিত হবে। বিনিয়োগের পথে কয়েকটি বাধার মধ্যে ব্যাংক ঋণের সুদ একটি বাধা। বাংলাদেশ রফতানিকারক অ্যাসোসিয়েশনের (ইএবি) প্রেসিডেন্ট আবদুস সালাম মুর্শেদী এ বিষয়ে রোববার যুগান্তরকে বলেন, বিনিয়োগকে উৎসাহিত করতে হলে টার্ম লোনের পরে সুদের ওপর ক্যাপিং করে দিতে হবে। সুদের হারের ওপর এই ক্যাপিং করে দিলে বিনিয়োগের খরা কেটে যাবে। এখন ট্যাক্স হলিডে আছে, সঙ্গে ঋণের সুদের হার কমলে বিনিয়োগে অনেকে উৎসাহিত হবে। কর্মসংস্থান বাড়বে। আমি মনে করি, মেয়াদি ঋণের পর সুদের হারের ওপর একটি ক্যাপিং করার উপযুক্ত সময় এখন। ইতিপূর্বে এ ধরনের পদক্ষেপে ইতিবাচক ফল দেখা গেছে।
পোশাক খাতের অর্ডার কমছে : রফতানি আয়ের প্রধান উৎস তৈরি পোশাক শিল্পে বিপর্যয় শুরু হয়েছে। চলতি বছরে ৪৫০ গার্মেন্ট বন্ধ হয়েছে। এর মধ্যে গার্মেন্ট মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সদস্যভুক্ত ২৮০টি এবং এর বাইরে ১৭০টি। এর মধ্যে প্রায় ৫ শতাংশই ভালো মানের কারখানা। প্রতিদিনই প্রায়ই দু-একটি করে কারখানা বন্ধ হচ্ছে। এতে বেকার হয়ে পড়েছে দুই লাখ শ্রমিক। নতুন কারখানা চালুর হারও কমছে। বিজিএমইএ সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, কাজ না থাকায় খরচ পোষাতে না পেরে এসব কারখানা বন্ধ হচ্ছে। আরও কারখানা বন্ধ হতে পারে বলে আশংকা তাদের। ফলে রফতানি আদেশও কমে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন বড় গার্মেন্ট মালিকরাও। সেপ্টেম্বরে পোশাক রফতানি ৯ দশমিক ৩ শতাংশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ফলে শিল্প কঠিন চাপের মুখে পড়েছে এ শিল্প।
জানা গেছে, আগে বড় কারখানাগুলো বেশি করে পোশাকের অর্ডার নিয়ে অন্য কারখানায় সাব-কন্ট্রাক্টে কাজ করাত। তাদের নামে রফতানি হতো। কিন্তু বর্তমানে বড় কোম্পানিতেই অর্ডার নেই। ফলে একের পর এক গার্মেন্ট বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে বিজিএমইএ সহসভাপতি শহিদুল্লাহ আজিম বলেন, কারখানা বন্ধ হওয়ার অনেকগুলো কারণ আছে। এক নম্বর কারণ হচ্ছে কমপ্লায়েন্স ইস্যু। পাশাপাশি ব্যাংকের সুদসহ ব্যাংকের সার্ভিস চার্জে মালিকদের খরচ বেড়ে গেছে। এছাড়া ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধির কারণে মালিকরা কারখানা চালাতে না পেরে কারখানা বন্ধ করে দিচ্ছে। বিজিএমইএ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, কারখানার সংখ্যা ৫ হাজার ৭৫১টি। চলতি বছরে ২৮০ গার্মেন্ট বন্ধ হওয়ায় তথ্য বিজিএমইএ’র পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। আর তাদের বাইরে ১৭০টির মতো কারখানা বন্ধ হয়েছে। ফলে তারা ধারণা করছেন ২ লক্ষাধিক শ্রমিক বেকার হয়েছে। আর বন্ধ হওয়া কারখানার মধ্যে ২০ শতাংশ হচ্ছে শিফট হওয়া এবং ৪০ শতাংশ শেয়ার্ড বিল্ডিং কারখানা। বাকিগুলো সাব-কন্ট্রাক্টে কাজ করা কারখানা। পাশাপাশি নতুন কারখানা চালুর হার কমে আসছে। ২০১৪ সালে নতুন কারখানা হয়েছে ৮০টি। ২০১৩ সালে যা ১৪০টি এবং ২০১২ সালে ২০০টি। অর্থাৎ নতুন করে বিনিয়োগ হচ্ছে না।

No comments

Powered by Blogger.