চকিত স্মৃতি by আবুল মনসুর

১৯৬৬ সালে আমি যখন তৎকালীন আর্ট কলেজে ভর্তি হই তখন কাইয়ুম চৌধুরীকে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছি। আর্ট কলেজ থেকে পাস করে বের হয়ে কর্মজীবনে প্রবেশ করার পর তার সঙ্গে আগের সম্পর্ক আরও গভীর হয়েছে। এ সম্পর্ক সবসময় অক্ষুণ্ন ছিল।
বর্তমানে আমাদের চারপাশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে রুচিবোধ ও নান্দনিকতার যে ছোঁয়া দেখতে পাই তা এসেছে মূলত কাইয়ুম চৌধুরী হাত ধরে। বিশেষত গ্রন্থের প্রচ্ছদ অংলকরণ, পোস্টার ও বিভিন্ন সাজসজ্জায় বর্তমানে যে সৃজনশীল নান্দনিকতার পরিচয় দেখতে পাই তা একসময় ছিল না। এ ক্ষেত্রে তিনি পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছেন।
তিনি ছিলেন অগ্রণী চিত্রলিল্পীও। বিভিন্ন ক্ষেত্রে তিনি সফলতার পরিচয় দিলেও নিজের জন্য তিনি কখনও কিছু চাননি। তিনি সবসময় পরের জন্য অর্থাৎ দেশের সর্বসাধারণের জন্য অবদান রাখতে চেষ্টা করেছেন। তিনি যে সরল ও সাধারণ জীবনযাপন করতেন এটাও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ৫০-এর দশকের শেষের দিকে তিনি যখন মুদ্রণ বিষয়ক শিল্পের বিভিন্ন শাখায় কাজ শুরু করেন, তখন সর্বত্রই ছিল গতানুগতিক ও পুরনো ধারার প্রভাব। কিন্তু তিনি এসব কাজে তার ব্যতিক্রমী মেধার স্বাক্ষর রাখার ফলে আমাদের চারপাশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে একটি রুচিশীল পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।
কাইয়ুম চৌধুরী ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। তিনি ছড়া, কবিতা রচনায় দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি সবসময় বিভিন্ন সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে নিজেকে নিযুক্ত রেখেছেন। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মহান মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত সব প্রগতিশীল আন্দোলনে সবসময় তিনি থাকতেন সামনের সাড়িতে।
বিদেশ ভ্রমণের সময় তিনি সব সময় স্কেচ খাতা, রং, পেন্সিল ইত্যাদি সঙ্গে রাখতেন। দীর্ঘ ভ্রমণেও তিনি আমাদের অনেকের মতো ক্লান্ত হতেন না। লক্ষ করেছি, ভ্রমণের ক্লান্তি ভুলে কাজে ডুবে যেতেন। তিনি ছিলেন সঙ্গীতে অন্তঃপ্রাণ। আমরা অনেকে ওই সঙ্গীতের অনুষ্ঠানে দু-একদিন গেলেও তিনি সারাদিনের কর্মব্যস্ততার মাঝেও সঙ্গীতের ওই অনুষ্ঠানে প্রতিদিনই যেতেন। ৮২ বছর বয়সী এ মানুষটির প্রাণশক্তি দেখে বিস্মিত হতে হয়।
কাইয়ুম চৌধুরীর চিত্রকর্মে আবহমান বাংলার যে পরিচয় ফুটে উঠেছে, এটাও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এভাবে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে তিনি একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে সফল জীবনযাপন করেছেন। তার চলে যাওয়া দেশের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। আমরা যারা তার স্নেহধন্য, আমাদের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের স্বল্পসংখ্যক শ্রদ্ধেয় মানুষের অন্যতম।
আবুল মনসুর : লেখক, অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.