সমাজ ভাবনা- জমি নিয়ে ‘ডিজিটাল’ জমিদারি by মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম

আমার তখন একেবারে শিশু বয়স। সবেমাত্র কথা বলতে শিখেছি। তখন থেকেই আমার আব্বা আমাকে দিয়ে কবিতা আবৃত্তি করাতেন। কবিতা আবৃত্তি করতে বললে, সবার সামনে দাঁড়িয়ে, দু’হাত পেছনে নিয়ে, খুবই আগ্রহের সাথে আমি তা মান্য করতাম। নজরুলের ‘লিচু চোর’, রবীন্দ্রনাথের ‘বীর পুরুষ’ অথবা ‘অন্তর মম বিকশিত কর...’, ‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি...’ ইত্যাদি অনেক কবিতা অনর্গল আবৃত্তি করতাম।

শৈশবে যেসব কবিতা আমার কণ্ঠস্থ ছিল তার মধ্যে আমার কাছে খুবই প্রিয় ছিল রবীন্দ্রনাথের ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতাটি। এ কবিতায় জমি থেকে উচ্ছেদ হওয়া এক গরিব কৃষকের যে হূদয়গ্রাহী কাহিনীর বর্ণনা রয়েছে তা আমার শিশুমনকে আলোড়িত করে তুলতো। সেই কাহিনীকে ভিত্তি করে হিন্দি চলচ্চিত্রের প্রখ্যাত অভিনেতা বলরাজ সাহানী অভিনীত ‘দো বিঘা জমিন’ সিনেমা নির্মিত হয়েছিল। শিশু বয়সে সে সিনেমাও আমি দেখেছি। সে সিনেমা দেখে চোখ পানিতে ভরে গেছে। যুগটি ছিল সামন্তবাদী জমিদার-জোতদারদের যুগ। তার পরে সমাজে অনেক পরিবর্তন এসেছে। সামন্তবাদী-উপনিবেশবাদী সমাজ ব্যবস্থার বদল হয়েছে। গোটা বিশ্বে এখন পুঁজিবাদ আসন গেড়ে বসেছে। কিন্তু জমি নিয়ে ‘জমিদারির’ খেলা শেষ হয়নি। যে খেলা এখন নতুন রূপ লাভ করেছে। এখন তাকে আধুনিক ও পুঁজিবাদী ‘ডিজিটাল-জমিদারি’ বলে আখ্যায়িত করা যায়। এখনো চলছে ‘রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙ্গালের ধন চুরি’-এর ট্র্যাজিক সব ঘটনাবলী। এসব নিষ্ঠুর খেলা আজও আমার এই প্রবীণ হতে থাকা মনকে একইভাবে বেদনায় আলোড়িত করে।

 ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতাটির প্রথম কয়েকটি লাইনে কবি লিখেছেন—

“শুধু বিঘে দুই ছিল মোর ভুঁই, আর সবই গেছে ঋণে।

বাবু বলিলেন, ‘বুঝেছ উপেন? এ জমি লইব কিনে।’

কহিলাম আমি, ‘তুমি ভূস্বামী, ভূমির অন্ত নাই—

চেয়ে দেখ মোর আছে বড়জোর মরিবার মতো ঠাঁই।’

শুনি রাজা কহে, ‘বাপু, জানো তো হে, করেছি বাগানখানা,

পেলে দুই বিঘে প্রস্থে ও দিঘে সমান হইবে টানা—’

এককালে ‘রাজা’দের বাগানকে দৈর্ঘ্যে ও প্রস্থে সমান করার বিলাসী খেয়াল পূরণের জন্য ‘উপেনদের’ জমি এভাবে গ্রাস করা হতো। এখন যুগ বদলেছে। এখন উপেনদের যত্সামান্য ভিটে-মাটি-জমি হুড়হুড় করে প্রবেশ করছে পুঁজির রাক্ষসী মুখগহ্বরে।

অতীতে একসময়ে জমি-জমার ওপর কোনো ধরনের ব্যক্তিমালিকানার ব্যবস্থা ছিল না। সমগ্র ধরিত্রীর যাবতীয় সম্পদ ছিল সব মানুষের সাধারণ সম্পত্তি। সমাজে যেদিন থেকে শ্রেণি বিভাজনের উদ্ভব, তখন থেকে ক্রমান্বয়ে উত্পাদন উপকরণাদির ওপর ব্যক্তিমালিকানা ব্যবস্থা চালু হতে থাকে। জমি-জমার ক্ষেত্রেও তা প্রসারিত হয়। মধ্যযুগের সামন্তবাদী ব্যবস্থায় অনেক ক্ষেত্রেই জমি-জমা ছিল সম্রাটের সম্পত্তি, যা খাজনার বিনিময়ে সাধারণ নাগরিকরা ব্যবহারের সুযোগ পেতো। জমি কেনা-বেচা হতো না। রাজা-বাদশাহরা পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তা দখল করে নিজেদের দখলে নিয়ে আসতো। পরবর্তীতে একসময় জমি-জমার ওপর ব্যক্তিমালিকানা প্রতিষ্ঠা পায়। তা পরিণত হয় ব্যক্তিগত সম্পদে। কিছুটা দীর্ঘায়িত উত্তরণকালীন পর্বের মধ্যদিয়ে পার হয়ে তা অন্য দশটা পণ্যের মতো বাজারের কেনা-বেচার সামগ্রী হয়ে ওঠে। সেই সময়কালটি ছিল পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় মানব সমাজের উত্তরণ প্রক্রিয়াকালে। পুঁজিবাদের বর্তমান পর্যায়ে ভূ-সম্পত্তি ‘বাজারের-শক্তি’ ও তার নিয়ম-কানুনের অধীনস্থ হয়ে পড়েছে। জমি নিয়ে জমিদারিতে এমন ‘ডিজিটাল’ বাস্তবতার আছর পড়েছে।

অন্যান্য পণ্যের মতো জমি-জমার দামও নির্ধারিত হয় তার তথাকথিত চাহিদা ও সরবরাহের আপেক্ষিক পরিমাণ দ্বারা। পুঁজিবাদের নিয়মানুসারে জমি-জমার ব্যবহারিক মূল্যের চেয়ে প্রধান হয়ে ওঠে সঞ্চিত পুঁজি হিসেবে জমি-জমার মূল্য। সম্পদ সঞ্চয় করার ক্ষেত্রে একসময় প্রধান উপকরণ হিসেবে বিবেচিত হতো সোনা। সেক্ষেত্রে জমিজমা এখন হয়ে উঠেছে সোনার তুলনায় অনেক বেশি মূল্যবান। তার একটি বড় কারণ হলো, ভূ-সম্পত্তির কল্পনাতীত মূল্যবৃদ্ধির হার। বাংলাদেশে জিডিপির প্রায় ৮০ শতাংশ হলো অপ্রদর্শিত কালো টাকা। এই অবৈধ টাকা দিয়ে সোনা কিনে সঞ্চয় করে রাখার পরিবর্তে জমি-জমা কিনে বিনিয়োগ করে রাখাই এখন বহুগুণ বেশি লাভজনক। লুটপাটের মাধ্যমে আত্মসাত্কৃত কালো টাকার সরবরাহ বিপুল পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। এর কারণে জমি কেনার পেছনে টাকার সরবরাহও বেড়ে গেছে। জমির জন্য এই বাড়তি চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে জমির সরবরাহ বাড়ার যেহেতু কোনো সুযোগ নেই, তাই জমি-জমার দাম লাফিয়ে-লাফিয়ে বেড়ে চলেছে।

সব দেশেই জমির প্রতি মানুষের মায়া অপরিসীম। আমাদের দেশে তা আরো অনেক বেশি। ঐতিহাসিক ও সামাজিক কারণ ছাড়াও তার একটি বড় কারণ হলো আমাদের দেশের অতি ঘনবসতিপূর্ণ বাস্তবতা। পৃথিবীর সব দেশের মধ্যে বাংলাদেশে জমির অনুপাতে জনসংখ্যা হলো সবচেয়ে বেশি। জমির আইলের একইঞ্চি এদিক-ওদিক করা নিয়ে জান কবুুল করতেও এদেশের মানুষ পিছপা হয় না। জনসংখ্যা যত বাড়ছে, জমির দুষ্প্রাপ্যতাও তত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বহুদিন পর্যন্ত জমির মালিকানার পরিমাণ ছিল মর্যাদা ও ক্ষমতার উত্স। বর্তমানে তা অধিকতরভাবে হয়ে উঠেছে বিত্ত-বৈভবের ও বিনিয়োগের সবচেয়ে উত্কৃষ্ট উপকরণ।

জমির আপেক্ষিক আর্থিক মূল্য কি পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে তার একটি হিসাবের দিকে নজর দেয়া যাক। পঞ্চাশের দশকে বিঘা প্রতি ৫ হাজার টাকা দামে ধানমন্ডি এলাকায় প্লট বরাদ্দ করা হয়েছিল। ষাটের দশকে বিঘা প্রতি ৪০ হাজার টাকা দামে গুলশানের প্লট বরাদ্দ করা হয়েছিল। আজকাল গুলশান এভিনিউতে মূল সড়কের পাশের জমি কাঠা প্রতি ৭ কোটি টাকায় (অর্থাত্ বিঘা প্রতি ১৪০ কোটি টাকায়) এবং ভেতর দিকের জমি কাঠা প্রতি ২ কোটি টাকায় (অর্থাত্ বিঘা প্রতি ৪০ কোটি টাকায়) বিক্রি হচ্ছে। পক্ষান্তরে, সোনার দাম স্বাধীনতার আগে আগে ছিল ১২০ টাকা ভরি, যা এখন প্রায় ৪১ হাজার টাকায় উঠেছে। ডলারের দাম ৪.৭৬ টাকা থেকে বেড়ে বর্তমানে ৭৮ টাকা হয়েছে। স্বাধীনতার আগের দামের তুলনায় বর্তমান মূল্যমান হিসেব করলে দেখা যায় যে, ডলারের ক্ষেত্রে সে দাম বৃদ্ধি পেয়েছে ১৬.৪ গুণ, সোনার ক্ষেত্রে তা বৃদ্ধি পেয়েছে ৩৪১ গুণ, আর ঢাকার গুলশান এলাকার জমির ক্ষেত্রে তা বেড়েছে জমির অবস্থান বিশেষে ১০ হাজার গুণ থেকে ৩৫ হাজার গুণ। অর্থাত্ দেখা যাচ্ছে যে, সোনার দামের চেয়ে জমির দাম বেড়েছে ক্ষেত্রবিশেষে তিরিশগুণ থেকে শতগুণ পর্যন্ত। ডলারের তুলনায় সেই বৃদ্ধির পরিমাণ তো ১৫শ’ গুণেরও বেশি। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, জমি এখন সোনার চেয়ে শতগুণ দামি সম্পদ হয়ে উঠেছে। কার্ল মার্কস বলেছিলেন যে, মুনাফার পরিমাণ এক শতাংশ বাড়ানোর স্বার্থে প্রিয়জনের গলায় ছুরি চালানোসহ এমন কোনো অপরাধ নেই যা করতে পুঁজিপতিরা দ্বিধা করে না। এ থেকে সহজেই অনুমান করা যায় যে, একখণ্ড জমি হাতিয়ে নিতে আধুনিক ‘ডিজিটাল জমিদাররা’ কতটা হীন পথ অবলম্বন ও ঘৃণ্য অপরাধ সংঘটিত করতে পারে।

আবাসন ব্যবসা এখন সোনার খনির চেয়ে মূল্যবান সম্পদে পরিণত হয়েছে। নানা কারসাজির মাধ্যমে সাধারণ মানুষের বাপ-দাদার সম্পত্তিসহ জমি-জমা হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে। বর্ধিত দামের লোভ দেখিয়ে তাদেরকে জমি বিক্রি করতে বাধ্য করা হচ্ছে। অনেক রকম জবরদস্তিও করা হচ্ছে। চলতি বাজারের লোভনীয় মূল্যতেও যদি সাধারণ মানুষ তার জমি বিক্রি করে, সেই প্রাপ্ত অর্থ থেকে যে বাত্সরিক সুদ সে পাবে, জমির দাম সেই তুলনায় বছর-বছর বাড়বে তার চেয়ে শতগুণ বেশি হারে। ফলে দীর্ঘমেয়াদী বিচারে সম্পদের স্থানান্তর ঘটতে থাকবে গরিব ও মধ্যবিত্ত জমি বিক্রেতাদের থেকে জমি-জমার বিত্তবান ক্রেতাদের কাছে।

আবাসন ব্যবসায়ীরাও মধ্যস্বত্বভোগী হিসেবে বিপুল সম্পদ হাতিয়ে নিতে সক্ষম হচ্ছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আবাসন প্লটের ক্রেতারা প্রায় সর্বাংশেই সমাজের বিত্তবান মানুষ। এমনকি গরিব বস্তিবাসীদের ও নিম্নবিত্তদের জন্য যে ভাষানটেক পুনর্বাসন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল, সেই প্রকল্পের ফ্ল্যাটগুলোও গরিব মানুষদের বদলে বেআইনীভাবে বিত্তবানদের কাছে বিক্রি করা হয়েছে। এভাবেই ‘জমি-জমা’ ‘ও তাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা আবাসন ব্যবসা হয়ে উঠেছে গরিবকে আরো গরিব ও ধনীকে আরো ধনীতে পরিণত করে সমাজের বৈষম্যকে অকল্পনীয় মাত্রায় বৃদ্ধি করার একটি ব্যবস্থা।

কোটি কোটি টাকায় লাল হয়ে ওঠা লুটেরাদের অবৈধ অর্থে ফুলে-ফেঁপে উঠছে আবাসন ব্যবসা। আবাসন ব্যবসায়ীরা নাগরিক জীবনের বৃহত্তর স্বার্থকে ধ্বংস করে তাদের ব্যবসা চালাচ্ছে। শহরগুলোর মধ্যদিয়ে ও আশপাশ দিয়ে প্রবাহিত নদী, নালা, খাল এবং বিদ্যমান জলাশয়গুলো ভরাট করে তারা ভূ-সম্পদ বেদখল করে তা তাদের আবাসন প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করে নিচ্ছে। গাছপালা কেটে প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্ট করছে। রাস্তাঘাটের জন্য প্রয়োজনীয় জমি ছেড়ে না রেখে অপরিকল্পিতভাবে বাড়ি-ঘর-ফ্ল্যাট নির্মাণ করে চলেছে। ড্রেজার দিয়ে অথবা ট্রাকে বালি-মাটি এনে নির্বিচারে নিচু জলাভূমি ভরাট করে আবাসন প্রকল্প তৈরি করে চলেছে। ভরাট হওয়ার আগে জলাবদ্ধ থাকা অবস্থাতেই কাগজের ম্যাপে প্লট এঁকে সেগুলো বহুশত গুণ দামে বিক্রি করে দিচ্ছে। অবৈধ কালো টাকার কারবারের সাথে এভাবে যুক্ত হচ্ছে দ্বিতীয় দফায় আরেক প্রস্থ অবৈধ কার্যকলাপ। এখনো ডেভেলপাররা জলাভূমিতে মাটি ফেলে মনুষ্যসৃষ্ট চর তৈরি করে হাউজিং প্রজেক্টের প্লট তৈরি করছে। স্বাধীনতার আগে ঢাকা শহরে ৪৭টি খাল ছিল। বেশিরভাগ খালের প্রস্থ ছিল ১৫০ ফুটের বেশি। বর্তমানে এসবের মধ্যে ২৫টি খাল বিলুপ্ত হয়েছে, ২২টি খাল অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখলেও সেগুলো সংকুচিত হয়ে চওড়া নালার রূপ গ্রহণ করেছে। এই অবস্থা সৃষ্টির জন্য ভূমি-দস্যুরাই দায়ী।

ঢাকা শহর বর্তমানে বস্তুত বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। মহানগরকে বাঁচানোর জন্য যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ নিতান্তই অত্যাবশ্যক, সেসবকে ভিত্তি করে ‘ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান’ বা ড্যাপ নামে মাস্টার প্ল্যান প্রস্তুত করা হয়েছিল। পর্যালোচনা কমিটির মাধ্যমে সেই ড্যাপ রিভিউ করার কাজের চূড়ান্ত নিষ্পত্তিও হয়েছিল। জলাবদ্ধতা, পরিবেশ-প্রতিবেশ, পানি সঙ্কট, উন্মুক্ত স্থান, বন্যা প্রবাহ এলাকা, কৃষি এলাকা, জলাশয়, জলাধার রক্ষা ইত্যাদি প্রতিটি বিষয়কে প্রয়োজনীয় ন্যূনতম বিবেচনায় নিয়ে ড্যাপ চূড়ান্ত করা হয়েছিল। ২০১০ সালের ১৫ জুলাই ড্যাপের চূড়ান্ত গেজেটও প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু জমি নিয়ে যারা আধুনিক ‘ডিজিটাল জমিদারি’ চালায়, সেই শক্তিমান বিত্তশালীদের কলকাঠি সঞ্চালন ও ষড়যন্ত্রে সেই ড্যাপকে বস্তুত হত্যা করা হয়েছে। জমি নিয়ে এসব আধুনিক ‘ডিজিটাল নব্য-জমিদারদের’ জমিদারি আর চলতে দেয়া যায় না। কারণ তাতে দেশ ও জনগণের সর্বনাশ ঘটে চলেছে। সময় এসেছে এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার।

>>>লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি
E-mail : selimcpb@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.